লেখক - মুনীর আহমদ।
ক্ষুধায় পেটটা ভালই নাড়াচাড়া দিচ্ছে। প্রাইভেট পড়াতে এসেছি সুমাইয়াকে। এই মেয়েটাকে সেই দশম শ্রেণী থেকেই পড়াচ্ছি। এখন ও এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।
সুমাইয়ার বাবা সেনাবাহিনীর অফিসার এবং মা গৃহিণী। আমি একজন সাধারণ মানুষ। অভাবী মানুষও বলা যায়। অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ি। আমার ইনকাম এর রাস্তা হলো টিউশনি করা। টিউশনির টাকায় নিজে চলি, আর গ্রামে মায়ের কাছে কিছু টাকা পাঠাই।
আমার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। গ্রামে মা আর ছোট ভাই থাকেন। আমার পাঠানো টাকায় তারা কোনমতে চালিয়ে নেন।
যা বলছিলাম। এখন সন্ধ্যা। ক্ষুধায় কাতর হয়ে গেছি। দুপুরে কিছু খাইনি। অবশ্য প্রায়ই আমি দুপুরে কিছু খাইনা। এতে কিছু অর্থ বেচেঁ যায়।
অর্থ হাতে থাকলে কিছু কাজে লাগানো যাবে, খেলে তো শেষই হয়ে যায়, এটা আমার যুক্তি।
সুমাইয়াকে প্রায় ৩ বছর ধরে পড়াচ্ছি। পড়ানোর প্রথম দিন থেকেই দেখতাম আমাকে কিছু নাস্তা দেয়া হতো। এতে অনেক উপকার হয়েছে। দুপুরে অভুক্ত থাকি, নাস্তাটা পেয়ে তাই অখুশি হওয়ার কারণ নেই।
আজ হয়তো ব্যতিক্রম। আধঘণ্টা হয়ে গেল পড়াচ্ছি, এখনো নাস্তা নিয়ে কাজের মেয়েটা আসেনি। নাস্তা হয়তো আসবে না, এই কথা মনে হতেই ক্ষুধাটা আরো বেড়ে গেল।
হয়তো ইকটু অন্যমনস্ক ছিলাম তাই সুমাইয়া ডাক দিলো,
- ভাইয়া ...
-- হু, বলো।
- আপনি কি কিছু ভাবছিলেন?
-- নাতো।
- ও। আচ্ছা, আমি ইকটু ভিতরের ঘর থেকে আসছি।
সুমাইয়া কেন ভিতরের ঘরে গেল কে জানে। এই মেয়েটাকে পড়িয়ে অনেক শান্তি পেয়েছি। মেধাবী ছাত্রী। কিছু বোঝানোর জন্য অত পরিশ্রম করতে হয়না।
খাবারের ট্রে হাতে সুমাইয়া ঘরে ঢুকলো। আমি ইকটু লজ্জিত বোধ করলাম। সুমাইয়া কিছু বুঝে ফেললো নাকি। সুমাইয়া বলল,
- আজকে কাজের মেয়েটা অসুস্থ তাই নাস্তা দিয়ে যেতে পারেনি।
-- আরে সমস্যা নাই। তুমি কষ্ট করে আনতে গেলে কেন!
সুমাইয়া কিছু বললো না। ইকটু বাঁকানো হাসি দিলো। আমি খাবার হাতে নিলাম। ক্ষুধা নিয়ে অতদিকে তাকানোর সময় কই। চা, দুই টুকরো বিস্কুট এবং দুই টুকরো কেক।
আমার জন্য এইই বেশি। খাবার শেষ করে দেখি সুমাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বিব্রতবোধ করলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে ইকটু অন্যভাবে হয়তো খাবার শেষ করে ফেলেছি। সুমাইয়া বলল,
- ভাইয়া, আজও আপনি সাদা শার্টটি পড়ে এসেছেন!
-- লাল শার্টটা ধুয়ে দিসি।
- আপনার আর শার্ট নাই? শুধু লাল আর সাদা, লাল আর সাদা!
আমার আসলেই আর শার্ট নাই। এই দুটোই শার্ট। দুইদিন আগে দেখলাম, লাল শার্টটিও ইদুরে কেটে ফেলেছে। এই কথা অবশ্য সুমাইয়াকে বলা যায়না, তাই চুপ করে রইলাম।
সুমাইয়া বলল,
- আমি আপনাকে একটা শার্ট গিফট দিবো, কালো শার্ট।
-- আচ্ছা দিও। এখন পড়ায় ইকটু মনোযোগ দাও।
(দুই)
১৩ ই ফেব্রুয়ারি। আজ সারাদিন ভার্সিটিতেই কাটালাম। জিতু, ইমরান, লাবণী দের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডাও দিলাম।
সন্ধ্যায় সুমাইয়াকে পড়াতে গেলাম ওদের বাসায়। সুমাইয়ার সাথে দেখা হলো না। ওর মা এর সাথে কথা হলো। সুমাইয়ার আংটি বদল হয়ে গেছে, এক সেনাবাহিনীর অফিসারের সাথে। তাই আজ আর পড়বে না।
আমি ছুটি পেলাম। বাসার দিকে ফিরছি। ক্ষুধা মরে গেছে, চিন্তাশক্তিও ভোঁতা হয়ে গেছে। কেন? সুমাইয়ার জন্য?? আজ বুঝলাম সুমাইয়াকে আমি পছন্দ করতাম ভালবাসতাম!
ব্যথিত মনে বাসায় ফিরলাম। বাসা বলতে ভাড়া বাসা। দুই রুমের বাসায় আমরা ছয়জন একসঙ্গে থাকি, সবাই ভার্সিটির স্টুডেন্ট।
শাকিল বলল, আমার নামে পার্সেল এসেছে। দেখলাম জুতার সাইজের মতো একটা বাক্স। বাক্স টি খুলতেই একটি কালো শার্ট বেড়িয়ে পড়লো, সাথে একটি চিঠি। আমি চিঠিটি পড়া শুরু করলাম।
(তিন)
প্রিয় সাব্বির,
ভাই বলতে পারবো না। অন্য মানুষের সামনে ভাই বলার প্রয়োজন আছে কিন্তু চিঠিতে ভাই বলার প্রয়োজন নেই। কারণ, কখনোই তোমাকে ভাই হিসেবে ভাবিনি। তুমি করেই বলছি, ঠিক আছে?
মনে আছে সাব্বির, একদিন বাবার সাথে রাগ করে অনেক কেঁদেছিলাম। তখন অবুঝ ছিলাম। মাত্র টেনে পড়তাম, অবুঝ থাকাই স্বাভাবিক। তুমি পড়াতে এসে দেখলে আমি তখনো কাঁদছি। তুমি কিছু বললে না, চুপচাপ বসে রইলে। কিছুক্ষণ পরে আমাকে একটি কবিতা লিখে দিলে,
" আমি বলি, কাঁদিস কেন তুই?
তুই বললি, দুঃখ আমার সই!
আমি বলি, দুঃখ দিয়েছে কে?
বল আমায়,
বোমা মেরে সব উড়িয়ে দিবো কই!! "
আমি সেদিন কবিতাটি পড়েই হেসে দিলাম। তোমাকে তখন থেকেই ভাললাগা শুরু হলো।
আজকে তোমার ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। দেখলাম তুমি এক মেয়ের সাথে অনেক হেসে হেসে কথা বলছো! মেয়েটা কে? তুমি কি মেয়েটাকে পছন্দ করো?
আমার এন্গেজমেন্ট হয়ে গেছে। তোমাকে ভালবাসি। তাই অন্য কাউকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা। তোমাকে জানিয়ে দিলাম।
তুমি যদি আমাকে এসে বলো, আমার সাথে যাবে! তাহলে আমি কিন্তু না করবো না।
ইতি,
সুমাইয়া।
(চার)
ব্যস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছি আর ভাবছি, কি করা যায়। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ, আর সুমাইয়া সেনাবাহিনীর অফিসারের মেয়ে। এখন চাইলে সুমাইয়াকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবো কিন্তু যেখানেই যাই সুমাইয়ার বাবা গিয়ে ধরে আনবে।
তখন দুজনের ভবিষ্যৎ কি হবে। মোবাইলের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ পড়লো।
- হ্যালো!
-- হ্যালো, আমি মেজর কামাল। সুমাইয়ার বাবা। তুমি সাব্বির?
- জ্বী আংকেল।
-- তুমি জানো তো সুমাইয়ার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।
- জ্বী জানি।
-- আজ সুমাইয়া পাগলামি শুরু করেছে। ও নাকি বিয়ে করবে না, ও নাকি তোমাকে ভালবাসে, তোমাকে বিয়ে করবে।
আমি চুপ করে রইলাম।
- সাব্বির??
-- জ্বী আংকেল।
- তুমি এখন কি করবে?
-- আপনি বলুন, আপনি যা বলবেন তাইই করবো।
- ঠিক তো?
-- জ্বী।
- তোমার বাসায় আমি তোমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছি। কাল সকালে ঢাকা ছেড়ে যাবে।
-- জ্বী আচ্ছা।
- তোমাকে যেনো আর ঢাকা শহরে না দেখি।
-- আচ্ছা।
(পাঁচ)
রেল স্টেশনে বসে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। আজ সুমাইয়ার দেয়া কালো শার্টটা পড়ে এসেছি। সাথের বন্ধুদের কিছুই জানাই নি। জানলে ওরা মন খারাপ করবে।
সময় কাটছেনা। একটা পত্রিকা কিনলাম। প্রথম পৃষ্ঠার লেখায় চোখ আটকে গেল।
" আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। "
বুক পকেটে সুমাইয়ার দেয়া চিঠিটা ভাজ করে রাখা আছে। ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু শেষ স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলাম।
সাতপাচ ভাবতে ভাবতে পেপারটি হাতে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই হয়তোবা নিঃশব্দে হু হু করে কেঁদে উঠলাম! কেউ দেখলো না। গরীবদের ভালবাসতে নেই!