মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৩৩- ভোরের শেষ আলো

আমি কি করছি বুঝতে পারছি না ।
ভার্সিটিতে আজকাল সবাই কেমন যেন
জটলা পাকাচ্ছে । ছোট্ট রুমটাতেও
বসে বসে কেমন যেন একঘেয়ে জীবন
হয়ে যাচ্ছে । বন্ধুরাও আজকাল তেমন
একটা আসে না ।লেখালেখি শুরু করার
পর থেকে খাওয়া দাওয়া ঠিক মত
করতে পারিনা ।
কারন কি করছি আমি নিজেই
জানিনা । তবে আমি ভাল
টেকনিসিয়ান কাজ করতে পারি । আর
একটু সময় পেলে মাঝে মাঝে টুকটাক
অখাদ্য গল্প কবিতা লিখি । সেই
সুবাদেই ভার্সিটিতে মুটামুটি সবাই
একটু চেনে ।
আগে মাঝে মাঝে বাড়িতে যেতাম ।
কিন্তু এখন তেমন একটা যাই না । অনেক
দিন হয় মাকে দেখি না ।
মা প্রতি সপ্তাহে একটি চিঠি দেয়
বাড়ি যাওয়ার জন্য । কিন্তু সময়
করে উঠতে পারি না । কেউ এসে দরজায়
করা নাড়ছে । আবির
দড়জাটা তাড়াতাড়ি খুলো ...
জরুরি কথা আছে ।
আমিঃ কি হয়েছে রাহাত ?
রাহাতঃ চারদিকে মিলিটারি বাহিনী নেমে গেছে ।
ওরা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে মারছে ।
আমাদের এখনি বের হতে হবে ।
আরমান ,রাকিব ,রিয়াদ , জয়নাল ভাই
সবাই অপেক্ষা করছে ।
আমিঃ তো আমি কি করবো ?
রাহাতঃ চলো যুদ্ধে যেত হবে ।
কোন কিছু না ভেবেই বেরিয়ে পড়লাম
।নিচে নামতেই অনেক দিন পড়
সবাইকে দেখে মনটা ভরে গেল । কিন্তু
সবাই কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে ।
বলা নেই কওয়া নেই বললেই হল যুদ্ধ
(মনে মনে) ভার্সিটির পেছনের জঙ্গল
পথ ধরে এগিয়ে চলছি সবাই । কার
মুখে কোন কথা নেই।পেছনের
দিকে কেমন যেন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ।
শব্দটা কেমন যেন পরিচিত ।
কিরে রাহাত শব্দটা কিসের রে ।
জয়নাল ভাইঃ আরে বলদ ওটা গুলির শব্দ ।
আমিঃ ও তাই !
রাকিব ভাইঃ না ওইটা আমার বিয়ের
আতসবাজি ফোটানোর শব্দ ।
আমিঃ আমিতো ভাবছিলাম
কি না কি ?
আরমান ভাইঃ তুই আর কবে চালাক
হবি রে ?
আমিঃ আমার
সাথে এশারে বিয়া দিয়া দেন ।
জঙ্গল পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই
একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে দেখা গেলোচল
সবাই ।
গাড়িতে উঠে এটা ভাঙ্গা বাড়িতে এসে উঠলাম
। সবাই গোল হয়ে বসে মিটিং শুরু হল ।
রিয়াদ ভাই এটা বড় কাগজ
মেঝেতে রেখে আমাকে বলল ছক
বিছানো শুরু কর ।
আমরা এখন ভুতের গলির শেষ প্রান্তে এই
বাড়িটায় আছি । কাল ডাক্তার চাচার
বাড়িতে যেতে হবে ।
আমিঃ ডাক্তার
চাচা টা কেডা রাকিব ভাই ।
রাকিব
ভাইঃ আরে গাধা ওটা আমাদের
ক্লাসের পিউলির বাবা ।
আমিঃ ও আচ্ছা লোকটার নাম
শুননা গলাডা শুকায়ে গেছে গা।
আমিঃ জয়নাল ভাল ১০টেহা দেন ।
জয়নাল ভাইঃ কি করবি ?
আমিঃ সিগারেট খামু ।
ফাজলামো করস ভাত ।ডাল , খাওয়ার
টেহা নাই সিগারেট খাবি ।
আমিঃ সিগারেট খাওয়া কি অপরাধ
নাকি বাবা । সিগারেট ই
তো আরতো কিছু খাবার চাই নাই ।
রাকিব ভাইঃ নে খা তাও তুপ থাক
শয়তান ।
রিয়াদ ভাইঃ কাল রাকিব , রাহাত,
বাপ্পি যাবি ডাক্তার চাচার
বাড়িতে ঐখানে রিফাত কিছু
ইনডিয়ান মেশিন গান দিয়া আইছে ঐ
গুলা নিয়া আসবি আর হাবলা শয়তান
টারে কিছু মেডিসিন (বোম বানিনোর
সরঞ্জাম) সহ রাখয়া আইবা ।
আমিঃ ভাই আমি যামু না মোর ভয়
করতাছে ।
আরমান ভাইঃ তোর আবার ভয় করে এই
প্রথম শুনলাম।
সবাই আমাকে পাগল
ভাবে তাতে আমার কি ...
জয়নাল ভাই বলল তাই যাইতাছি আর
কেউ বলল মাথা ফাটিয়ে দিতাম ।
সকালেই পিউলি দের
বাড়িতে আসলাম ।
একটু আগে বাপ্পি ,রাহত ওদের বিদায়
করলাম।
পিউলি এসে আমাকে একটি রুমে নিয়ে বলল
আপনি আপনার কাজ করতে পারেন ।
আপনাকে কেউ দিস্টাব করবেনা ।
আমিও হাবলুর মত কোন
কথা না বলে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র
বের করে কাজ শুরু করলাম ।
দুপুরে রুম থেকে উঠে খাবার
টেবিলে গেলাম । ডাক্তার
চাচা পিউলি আর ১৩-১৪ বছর এর
একটি মেয়ে ।
মেয়েটিকে দেখে কেমন যেন মনে হয় ।
রান্নাটা খুব ভাল হয়েছে ।
গ্রামে গেলে আমার মা ও এই রকম
রান্না করে আমাকে খাওয়াতো ।
ডাক্তার চাচা বলল
বাবা এখানে তোমার কোন
অসুবিধা হচ্ছে নাতো ।
আমিঃ জ্বী না ।
ডাক্তার চাচা কোন হেল্প
লাগলে বলবে কিন্তু কেমন । যদি কোন
কাজে আসতে পারি ।
লোকটাকে যা মনে করেছিলাম ঠিক
তা না অনেক ভাল ।
হাতটা ধুয়ে রুমে এলাম ।
আমি শুনতে পাচ্ছি ।
পিচ্চি মেয়েটা বলছে আব্বু দেখ
লোকটাকে কেমন পাগলের মত লাগছে ।
বলে কি মাইয়া আমি কিনা পাগল ।
ভার্সিটির কত মাইয়া আমার জন্য
পাগলী হইয়া গেল ।
ডাক্তার চাচা বলছে নওশীন
পচা কথা বলে না মামনি। ও মেয়েটার
নাম তাহলে নওশীন । ও পাশ
থেকে নওশীন এর আম্মু বলছে জানা নেই
শুনা নেই এরকম
একটা ছেলেকে বাড়িতে থাকতে দিলা ।
ঘরে দুইটা মেয়ে । আর কিছু
শুনতে পেলাম না ।
রাকিব ভাই এর দেওয়া গুল্লিপ এর
পেকেট থেকে একটা জ্বালিয়ে আবার
ও কাজে মন দিলাম । কতক্ষন
যে চলে গেছে বলতে পাব না ।
রুমে অনাকাঙ্খিত একজনের প্রবেশ এ
কাজে দিক থেকে মনটা উঠে গেল ।
ছি আপনি সিগারেট খান । হুম ।
আপনি তো পচা ।
আমিঃ তোমার নাম নওশীন তাইনা ?
নওশীনঃ আপনি কি করে জানেন ।
এগুলো কি করেন আপনি ।
আমিঃ তোমার আপুর কাছ
থেকে শুনেছি আর কাজ করছি ।
নওশীনঃ আপনার নাম কি আবির ?
আপনি অনেক ভাল লিখেন ।
আমিঃ হুম । তুমি কি করে জানলে ।
নওশীনঃ পিউলী আপুর কাছে থেকে ।
আমি আপনার অনেক লিখা পড়েছি ।
আমিঃ এখন যাও আমি কাজ করছি ।
বিকালে বাপ্পি আর রিফাত
এসে দুটো জিনিস (বোম) নিয়ে গেল ।
রাতের খাবার খেয়ে ঘরে বসে আছি ।
নওশীন এর আম্মি এক গ্লাস দুধ
টেবিলে রেখে অনেক খন গল্প করলো ।
যা মনে করেছিলাম ঠিক তা না এ
বাড়ির মানুষ গুলো অনেক ভাল ।
আজ কয়েক মাস কেটে গেল বাইরের
আবহাওয়া দেখতে পাইনা জানিনা ।
মাঝে মাঝে খুব টেনশন হয়
বাড়িতে মায়ের জন্য । কেমন
আছে কে জানে ? হয়তো বেঁচে আছে ।
আর একটু ভাবতেই চোখ এ
পানি চলে এলো ।
রাহাত, রিফাত,
বাপ্পি মাঝে মাঝে আসে কিন্তু অল্প
সময়ের জন্য । আরমান , জয়নাল ,
রাকিব ,রিয়াদ ভাই আর বাকি সবাই
একটা গেরিলা বাহিনী তৈরি করেছে ।
শুনেছি পাকিস্তানী দের নাকে দম
করে রেখেছে ।
নওশীন মেয়েটা আজকাল একটু
বেশি দুষ্টামি করে । যদিও পিউলি আর
ওর মা আমার কাছে আসতে বারন
করেছে । কয়েক দিনের ভিতর এই
অপরিচিত লোক গুলো আপন অনেক
হয়ে গেছে ।
বাড়ি থেকে মায়ের
একটা চিঠি পেয়েছিলাম কাজের জন্য
এখন ও
পড়া হয়নি টেবিলে উপরে রেখে দিয়েছি ।
আজকাল পিউলীর
মাকে দেখলে মায়ের কথা মনে পড়লে ।
তখন নিরবে একা একা কাঁদি ।
চারদিকে পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে । আমাদের বড়
বড় বুদ্ধিজিবি আর
মুক্তিবাহিনী কে রাজকার দের
সাহায্যে হত্যা করছে।
আমার ভাঙ্গা রেডিও
দিয়ে মাঝে মাঝে জয় বাংলার গান
শুনি । নওশীন আজ মুখ গুমরা করে আমার
চেয়ারটার পাশে বসল ।
আমিঃ কি হয়েছে নওশীন ?
নওশীনঃ অনেক দিন হয়ে গেল
স্কুলে যেতে পাচ্ছি না।
আচ্ছা আমি কি আর
স্কুলে যেতে পারবোনা ?
আমিঃ আরে পাগলী মেয়ে আর মাত্র
কয়েক দিন তাহলেই যেতে পারবে।
আমরা দু এক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ
স্বাধীন করবো ।
নওশীনঃ সত্যি বলছেন ! আমার না ভয়
করে যদি ওরা আমাদের
কে মেরে ফেলে ?
আমিঃ আরে কোন ভয় নেই
আমি আছি না ।
নওশীনঃ তাহলে যে দিন দেশ স্বাধীন
হবে সেদিন আমি আপনার হাত ধরে মুক্ত
রাস্তাই বহু পথ হাঠবো ।
আমিঃ ঠিক আছে পাকনা বুড়ি।
রাতে ডাক্তার চাচা খাবার সময় বলল
পাকিস্তানী দের মেন পয়েন্টের কিছু
সমস্যা হয়েছে । ওদের একজন
টেকনিসিয়ান লাগাবে ।
আমি দেরি না করে ডাক্তার চাচার
সাইকেলটায় চড়ে রাহাত এর
দেওয়া ঠিকানায় বেড়িয়ে পড়লাম ।
ইসতিয়াকের চায়ের দোকানের
পেছনের দিকে আরমান , রাকিব আর
জয়নাল ভাই কে পেয়ে গেলাম ।
তিনজনের চোখ ই লাল
হাতে সিগারেট ।
জয়নাল ভাইঃ এই হতছাড়া তুই
এখানে কি করছিস ।
আমিঃ মন চাইলো তাই তোমাদের
সাথে সিগারেট খেতে চলে এলাম ।
রিয়াদ ভাই কোথাই ?
রাকিব ভাইঃ রিয়াদ , রাহত আর
বাকি সবাইকে নিয়ে একটা ক্যাম্প
ধ্বংশ করতে গেছে । এখন কাজের
কথা বল । খুলে বললাম সব।
অবশেষে আমরা তিনজনেই
পাকিস্তানী দের মেন পয়েন্ট এ
গেলাম । আমার টেকনিসিয়ান কার্ড
দেখিয়ে খুব সহজেই ভিতরে ঢুকলাম ।
জয়নাল আর রাকিব
ভাইকে নিচে রেখে আমি আর আরমান
ভাই একজন গার্ড
সাথে উপরে বিলডিং এ চলে গেলাম ।
ওরে বাবা এখানে দেখি অনেক
গুলা বারুদ ।
কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
বিলডিং এর চারপাশে ভাল
করে দেখে নিলাম । নিচে একটা পুকুর
আছে । আরমান ভাই রুম থেকে বের
হয়ে নিচে জয়নাল আর রাকিব
ভাইকে ইশারায় কেটে পড়তে বলল ।
আবার ও রুমে ঢুকে পকেটের থেকে FIRE
BOX টা বের
করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে দিলাম
ধ্বংশত্তক বস্তুর দিকে ।
সাথে সাথে আমিও কাচের
জানালা ভেঙ্গে পুকুর ঝাপ দিলাম ।
ধ্বংশ হয়ে গেল পাকিস্তানীদের মেন
পয়েন্ট ।
হাহাহাহাহা অনেক আনন্দ হচ্ছে ।
একি কি !
হানাদার বাহিনী পুকুরের দিক আসছে ।
পুকুর থেকে উঠে দৌড়ানো শুরু করলাম ।
হঠাৎ কি যেন আমার বুকের ভিতর প্রবেশ
করলো । তারপর আর মনে নেই ।
মাঝরাতের দিকে জ্ঞান ফিরতেই
নিজেকে আবিষ্কার করলাম নওশীনদের
বাসায় । আমার চারপাশে সবাই
বসে আছে নওশীন আর পিউলী কাঁদছে ।
আন্টির ও চোখ
গুলো ফোলা ফোলা লাগছে ।
বুকে ব্যন্ডেজ । কথা বলতে পাচ্ছি না ।
ডাক্তার চাচা আমার মুখের কাছে কান
নিয়ে বলল কিছু বলবা বাবা ?
আমিঃ আমি এখানে কিভাবে ?
ডাক্তার চাচাঃ আড়মাণ , জয়নাল আর
রাকিব এখানে দিয়ে গেছে ।
আন্টিঃ তোমার এখন কেমন
লাগছে বাবা ?
আমিঃ আস্তে করে বললাম ভাল ।
কে যেন দরজা করা নাড়ছে । আঙ্কেল রুম
থেকে বের হয়ে মেন
দড়জা টা খুলে দিলেন ।
রাহাত এসেছে । কেমন আছেন আবির
ভাই ?
পিউলী বলল কিছুটা ভাল ।
রাহাতঃ সুখবর আবির ভাই
আমরা জয়ী হয়েছি । আমাদের
এতো দিনের কষ্ট সার্থক হয়েছে । সকাল
থেকে আমরা একটি স্বাধীন
দেশে বসবাস করবো ।
আমিঃ রাহাতের কথা গুলো বিশ্বাস
করতে পারছিলাম না । তবুও বিশ্বাস
করতে হলো ।
রাহাতঃ কিন্তু ... আবির ভাই
একটা খারাপ খবর আছে । জয়নাল ভাই আর
রাকিব ভাই ধরা পড়েছে ।
বেচে আছে কিনা জানিনা । আরমান
ভাই গুরুতর আহত ।
আমিঃ আমার শরীরের রক্ত গরম
হয়ে গেল । উঠতে গেলাম কিন্তু
বুকে অনেক ব্যথা উঠতে পারলাম না ।
ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা ।
বুকে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়।
ফজরে আজান দিল চোখ গুলো ঘুমে ঢুলু ঢুলু
করছে । কেন যেন মার কথা ভিষন
মনে পড়ছে । জোরেই বলে উলাম ।
মা আমি আসছি । আবার ও কান্নার রোল
পড়ে গেল ।সবাই কাঁদছে কিন্তু নওশীন
কাঁদছে না । আমি চোখটা একটু
খোলা রাখার চেষ্টা করলাম ।
নওশীন আমার হাতটা ধরে বলল প্লিজ
একটু চোখটা খুলুন । স্বাধীন দেশের
ভোরের মিষ্টি আলো কি আপনি একটু
ছুয়ে দেখবেন ।
আপনিকে না বলেছিলাম আমরা আজ
অনেক পথ হাটবো বলে নওশীন
কেদে উঠলো । আর কিছু
শুনতে পাচ্ছি না আমার খুব
ইচ্ছে করছে একটু মায়ের
কোলে ঘুমাবো ।মায়ের দেওয়া চিঠিও
এখন পড়তে পারিনি । মা আমি আসছি ....
(সমাপ্ত)