কয়েক বছর আগে আমার একবার অতিপ্রাকৃত
অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার এক মৃত বন্ধু
আমার কাছে ফিরে এসেছিল। ওই
অস্বাভাবিক ঘটনাটি মনে পড়লে আজও
আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই ...
বছর কয়েক আগের কথা । বর্ষাকাল। রাতদিন
দফায় দফায় বৃষ্টি। এক রাতে ভিজে অফিস
থেকে বাড়ি ফিরেছি। আমি তখন ঢাকায়
একাই থাকি। মা-বাবা থাকেন যশোর ।
আমার তখনও ঘরসংসার পাতা হয়নি। মা-
বাবা অবশ্য বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
অবশ্য আমার বন্ধনহীন জীবন বই পড়ে আর
আকাশকুসুম ভাবনায় গা ভাসিয়ে বেশ
কেটে যাচ্ছিল।
রাতে ঘুমাবার আগে কিছুক্ষণ বই পড়ি।
সে রাতেও বই পড়তে-পড়তে কখন
যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোররাতে আমার ঘুম
ভেঙে গিয়েছিল । জানালায় ঝিরঝির বৃষ্টির
শব্দ। টের পেলাম মোবাইলের রিংটোন
বেজে চলেছে। বালিশের পাশ
থেকে মোবাইল তুলে দেখি অপরিচিত
নাম্বার। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম-হ্যালো।
আমি ওয়াহেদ। ওপ্রান্ত থেকে যান্ত্রিক স্বর
ভেসে এল।
ওয়াহেদ? আমি অবাক হয়ে বললাম।
কেন, তোর মনে নেই,
আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম?
কথাটা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম।
হ্যাঁ ওয়াহেদ নামে আমার এক সহপাঠী ছিল
অবশ্য। সেই ওয়াহেদ ফোন করেছে? এত দিন
পর? এই সময়ে? বিস্ময়ের
ধাক্কা সামলে বললাম, ওয়াহেদ?
যাক। চিনতে পারলি তাহলে?
হ্যাঁ। কতদিন পর। এখন কোথায় থাকিস?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওয়াহেদ বলল,
আমি দেশের বাইরে থাকি। এ মাসে একবার
দেশে আসছি। তখন তোর সঙ্গে একবার
দেখা করতে চাই।
অবশ্যই। বললাম। আমারও কেমন কৌতূহল
হচ্ছিল। ওকে খুব পছন্দ করতাম। ভারি সহজ
সরল ছিল। ভীষণ পাখি পছন্দ করত ...
ওয়াহেদ বলল,
দেশে ফিরে আমি তোকে আমার
ঠিকানা জানিয়ে দেব। সতরই জুলাই তোর
সঙ্গে দেখা করব।ঠিক আছে?
আমি বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু
শোন,ওয়াহেদ, তুই আমার টেলিফোন নাম্বার
পেলি কই ?
উত্তর না-দিয়ে ফোনটা কেটে দিল ওয়াহেদ।
ঠিক ওই দিনই আরেকটি কাকতালীয়
ঘটনা ঘটল ...
সন্ধ্যের পর অফিস থেকে ফিরছি । বৃষ্টি ঠিক
পড়ছিল না। তবে আকাশ মেঘলাই ছিল।
আমি একটা গলির মুখে ঢুকছিলাম।ঠিক তখনই
ছেলেবেলার বন্ধু জাফর- এর সঙ্গে অনেকদিন
পর দেখা হয়ে গেল।ওর সঙ্গে যশোরে একই
স্কুলে পড়েছি। ওর বাবার বদলীর চাকরি।
আমরা যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন
ওরা য়শোর থেকে খুলনায় চলে যায়। তারপর
আর জাফর-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল
না।
জাফরই আমায় চিনতে পেরে ডাক ছিল,
শাহেদ।
আমার নাম শুনে থমকে গেলাম। তারপর
জাফরকে দেখে অবাক। প্রাণবন্ত
ছেলে জাফর।
দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। প্রাথমিক
কুশল বিনিময়ের পর
আমরা একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। আফটার অল
এতদিন পর দেখা। অনেক প্রশ্ন অনেক কৌতূহল
জমে আছে। বেশ ভালো চাকরি করে জাফর।
বিয়েও করেছে। ইন্সটলমেন্টে ফ্ল্যাটও
নাকি কিনেছে মীরপুরে।
কথায় কথায় ওকে জিগ্যেস করলাম, তোর
ওয়াহেদকে মনে আছে জাফর?
আমার প্রশ্ন শুনে জাফর- এর মুখে মেঘ
জমে উঠল। চায়ে চুমুক না-দিয়ে সিগারেট
ধরালো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, আছে।
কেন?
ওয়াহেদ আজ আমাকে ফোন করেছিল।
অসম্ভব!
অসম্ভব মানে? আমি অবাক।
ওয়াহেদ তো ...
কী!
ও তো বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই মানে? আমার মনে হল আমার
পায়ের নীচের মেঝে হঠাৎ সরে গেছে।
জাফর
এসব কী যা তা বলছে। ওয়াহেদ
বেঁচে না থাকলে আজ
ভোরে আমাকে কে ফোন করল?
জাফর চুপ করে থাকে। গভীরভাবে কী যেন
ভাবছে।সিগারেট টানতেও ভুলে গেছে। একটু
পর সচেতন হয়ে উঠল। এক মুখ
ধোঁওয়া ছেড়ে বলল, গত বছর আমি অফিসের
কাজে নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম । ওখানেই
হঠাৎ এক সাবওয়ে স্টেশনে অনেক বছর পর
ওয়াহেদের সঙ্গে দেখা।ওই
আমাকে চিনতে পারল। দেখে জড়িয়ে ধরল।
তারপর? আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল।
রেষ্টুরেন্টের গুঞ্জন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল
বলে মনে হল।
জাফর বলল, ওয়াহেদের বাড়ি ব্রুকলিনের
আটলান্টিক অ্যাভিনিউতে । জোর
করে নিয়ে গেল। বউ ক্যাথেরিন আর
মেয়ে সুজানা কে নিয়ে ছোট্ট সুখি সংসার ।
তোর কথাও জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম,
তোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।
তারপর?
তোর কথাই বেশি বলছিল ওয়াহেদ। বলল যে,
তোরা নাকি ভালো বন্ধু ছিলি।
একসঙ্গে পাখির বাসা খুঁজতিস। একবার
নাকি তুই ওকে ওর জন্মদিনে মাটির
টিয়া পাখি উপহার দিয়েছিলি । আজও যত্ন
করে পাখিটা রেখে দিয়েছে বলল।
হ্যাঁ। বললাম। আর তখনই আমার দপ
করে মনে পড়ে গেল ... ওয়াহেদ-এর জন্মদিন
ছিল সতরই জুলাই। কেমন ধাঁধার
মধ্যে পড়ে গেলাম। আশ্চর্য! কবে কত বছর
আগে ওয়াহেদকে ওর জন্মদিনে মাটির
টিয়া পাখি উপহার দিয়েছিলাম,
পাখিটা আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
জাফর বলল, নিউইয়র্কে আমি সপ্তাহখানেক
ছিলাম। তখনই ওয়াহেদ- এর মৃত্যু সংবাদ
পেলাম।
আমি কেঁপে উঠলাম।মুখ
থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল, মারা গেল?
কীভাবে?
কার অ্যাক্সিডেন্ট।অফিস থেকে ফিরছিল।
তারিখটা আমার মনে আছে। সতরই জুলাই।
বলে এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ল জাফর।
আশ্চর্য!আমি জাফর এর দিকে তীক্ষ্ম
চোখে তাকালাম। ধোঁওয়ার ভিতরে ওর মুখ
কিছু আবছা দেখায়। জাফর বলল, ক্যাথেরিনই
আমাকে ফোন করেছিল। আমি কাজ
ফেলে ব্রুকলিনে ছুটে যাই ।যদিও আমার
ভীষণই অস্বস্তি লাগছিল। ওদের
কী শান্ত¦না দেব-বিপর্যস্ত ক্যাথেরিন, তিন
বছরের ফুটফুটে সুজানা। তাই বলছিলাম
ওয়াহেদ তোকে ফোন
করবে কোত্থেকে। তোর
কোথাও ভুল হচ্ছে না তে শাহেদ?
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব
বুঝতে পারছি না। ওয়াহেদ যে নাম্বার
থেকে ফোন করেছিল সেটি এখনও আমার
মোবাইলে সেভ করা আছে।
খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। জাফর-
এর মোবাইলটা বাজল। কার সঙ্গে কিছুক্ষণ
কথা বলল সে।তারপর কথা শেষ করে ফোন অফ
করতে করতে বলল, আমি আজ উঠি রে ।
শাশুড়িকে নিয়ে একবার ডাক্তারের
কাছে যেতে হবে। এই যে আমার কার্ড।
যোগাযোগ রাখিস দোস্ত।
বলে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে চলে যায় জাফর।
আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম করছিল। ঘোরের
মধ্যে রেষ্টুরেন্ট
থেকে বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে কখন
বাড়ি এসেছি। সতরই জুলাই তারিখটা মাথার
ভিতরে ঘুরছিল। ওয়াহেদ কেন ওর জন্মদিনের
দিনই আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে? ও
যদি বেঁচে না-ই থাকে তো তাহলে কে আমার
সঙ্গে দেখা করতে চাইছে?
রাতে ভালো ঘুম এল না। ঘুমটা বারবার
ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। একবার ঘুমের মধ্যেই
যেন ... কী একটা গাছ দেখতে পেলাম,
গাছটা বেশ বড় । গাছ থেকে অনেক
পাখি উড়ে গেল ...সবুজ রঙের
পাখি মনে হল...টিয়াপাখি মনে হল ...
দৃশ্যটা কেমন পরিচিত মনে হল ...মনে হল
বহুদিন আগে দেখেছি ...
সতরই জুলাই ভোরবেলা ওয়াহেদ- এর ফোন
পেলাম।
ওয়াহেদ বলল, আজ ফ্রি আছিস?
আছি। আমার কন্ঠস্বর কেমন
ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনালো।
তাহলে চলে আয়।বলে গ্রিন রোডের এক
বাড়ির ঠিকানা দিল ওয়াহেদ। আটাত্তর বাই
বি । দুপুরের দিকে যেতে বলল ।
ঠিক আছে। কিন্তু শোন, তুই আমার টেলিফোন
নাম্বার কই পেলি?
উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে গেল ওয়াহেদ।
কেমন হতভম্ভ হয়ে গেলাম। প্রবল
অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরল। একবার মনে হল
জাফর মিথ্যে বলেছে।আবার মনে হল
তা কী করে হয়। জাফর- এর
ভিজিটিং কার্ডটা বের করলাম। একবার
মনে হল ওকে ফোন করি, সব খুলে বলি।
পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলাম।
আমি চাইনা জাফর আমায় পাগল ঠাওরাক।
কেমন ঘোরের মধ্যে সকালটা কাটল ...
দুপুরের দিকে কোনওমতে নাকেমুখে কিছু
গুঁজে ঘর থেকে বেরুলাম। গ্রিন রোডের
ঠিকানাটা আমার পরিচিত না।
তবে খুঁজে নিতে সমস্যা হবে না।ছুটির দিন।
মেঘশূন্য ফিরোজা রঙের আকাশ ।
ঝরঝরে রোদ উঠেছে। ভীষণ নার্ভাস
লাগছিল।
অস্বস্তি এড়াতে সিএনজিতে একটা সিগারেট
ধরালাম। তামাকের স্বাদ বিস্বাদ ঠেকল ।
সরু গলির ভিতরে অনেকটা হেঁটে শেষ পর্যন্ত
বাড়িটা খুঁজে পেলাম। আটাত্তর বাই
বি লেখা কালো রঙের লোহার গেট।
দারোয়ান গোছের কাউকে দেখতে পেলাম
না। কলিং বেলও নেই। ঠেলা দিতেই
খুলে গেল। জানতাম খুলে যাবে। ওয়াহেদের
ফোন পাওয়ার পর থেকেই কেমন রহস্যময়
ঘটনা ঘটছে।জাফর- এর সঙ্গে এত বছর পর
দেখা হয়ে যাওয়াটাও কি নিছক কাকতালীয়?
এর মধ্যে কি অন্য ব্যাপার নেই?
কিংবা নিউইয়র্কে জাফর-এর সঙ্গে ওয়াহেদ-
এর দেখা হয়ে যাওয়াটা ...
গেটটা অল্প ঠেলে ভিতরে পা দিলাম।
অগোছালো মলিন বাগান অযতেœ পড়ে আছে।
ওপাশে একটি দোতলা বাড়ি।
এককালে হয়তো সাদা রং ছিল -এখন রং-
টং উঠে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে । বেশ
পুরনো বাড়ি। এ ধরনের বাড়ি তো ঢাকায়
আজকাল ভেঙে ফেলে। কোন
দৈববলে এটি দাঁড়িয়ে আছে কে জানে।
দোতলা বারান্দার গ্রিলে সবুজ রং করা ।
একতলার গ্রিলের রঙও সবুজ। বাড়ির
পিছনে বিশাল একটি কামরাঙা গাছে চোখ
পড়তেই এক ঝাঁক টিয়া ফিরোজা রঙের
আকাশে সবুজ চাদর বিছিয়ে উড়ে গেল ...
একতলায় গ্রিল-বারান্দার একপাশে ছোট্ট
একটি লোহার দরজা । বন্ধ। জানতাম
ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে।
ভিতরে ঢুকে শুকনো বকুল ফুলের গন্ধ পেলাম।
বেশ বড় বারান্দা। কেমন ছায়া ছায়া।
মেঝেতে সাদাকালো ক্ষয়ে যাওয়া মোজাইক
। দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটি বেতের চেয়ার ।
আর
একটি টেবিল। টেবিলের ওপর একটি খবরের
কাগজ ভাঁজ করে রাখা । তার
পাশে একটি চায়ের কাপ। ধোঁওয়া উড়ছিল।
অ্যাশট্রে ভর্তি আধ- পোড়া সিগারেট। কেউ
এখানে বসেছিল? ওয়াহেদ? না, অন্য কেউ?
চারপাশ কেমন নির্জন হয়ে আছে। একটা কাক
ডাকছিল। আমি এখানেই অপেক্ষা করব,
না ভিতরে যাব ঠিক বুঝতে পারছি না।
ওয়াহেদ কি সত্যিই আছে এ বাড়িতে? কিন্তু
তা কি করে সম্ভব? জাফর তো ...
হঠাৎই চোখে পড়ল জিনিসটা। টেবিলের ওপর
একটা টিয়া পাখি। সবুজ রঙের, মাটির তৈরি।
এত বছর পরও চিনতে পারলাম। ওয়াহেদ-এর
জন্মদিনে এই মাটির টিয়াপাখিটাই
ওকে উপহার দিয়েছিলাম।এত বছর পর
এটা এখানে এল কিভাবে? ভাবতেই আমার
শরীরে হিম ছড়িয়ে গেল। কপালের দু’পাশের
শিরা দপদপ করতে লাগল। চোখের সামনে ঘন
কুয়াশার সমুদ্র জেগে উঠছে ...
কে যেন আমার কাঁধ স্পর্শ
করে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে দিল।
ওয়াহেদ?
কেমন ভূতগ্রস্থের মতন
আমি বাগানে নেমে এলাম।
একটু পর গলিতে বেরিয়ে এসে ভাবলাম ...
অশরীরী ওয়াহেদ কে দেখতে পাইনি ঠিকই ...
তবে ও আমার খুব কাছাকাছি এসেছিল ...