মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৮- কুঁজো আর ভূত- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কানাই বলে একটি লোক ছিল, তার
পিঠে তার পিঠে ছিল ভয়ঙ্কর একটা কৃঁজ।
বেচারা বড্ড ভালমানুষ ছিল, লোকের অসুখ-
বিসুখে ওষুধপত্র দিয়ে তাদের কত উপকার
করত। কিন্তু কুঁজো বলে তাকে কেউ ভালবাসতনা।
কানাইয়ের ঝুড়ির দোকান লোক ছিল। আর
কোনো ঝুড়িওয়ালা তার মত
ঝুড়ি বুনতে পারত না।
তারা তাকে ভারি হিংসা করত, আর তার
নামে যা-তা বলে বেড়াত।
তা শুনে লোকে ভাবত, কানাই বড় দুষ্টু লোক।
তাকে দেখতে পেলে সকলে মুখ
ফিরিয়ে থাকত। বেচারার দুঃখের সীমাই
ছিল না।
এত বড় কুঁজ
নিয়ে মাথা গুঁজে চলতে কানাইয়ের বড়ই কষ্ট
হত। একদিন সে একটু দূরে এক জায়গায়
ঝুড়ি বেচতে গেল, আর দিন
থাকতে ঘরে ফিরতে পারল না।
পথে একটা পুরনো বাড়ির
কাছে এসে এমনি অন্ধকার হল, আর তার এতই
কাহিল বোধ হল যে, আর চলা অসম্ভব।
সে জায়গাটা ভারি বিশ্রী;
লোকে প্রাণান্তেও সে পথে আসতে চায়
না। বলে, ওটা ভূদের বাড়ি। কিন্তু
কানাইয়ের বড্ডই পরিশ্রম হয়েছে, চলবার আর
সাধ্য নেই। কাজেই সে সেখানে পথের
পাশে একটু না বসে আর কি করি?
কতক্ষণ সে এভাবে বসে ছিল তার কিন্তু ঠিক
নেই। বসে থাকতে থাকতে তার মনে হল, যেন
সেই পুরনো বাড়িটার ভিতর থেকে আওয়াজ
আসছে অনেকগুলো গলা মেলে। আহা,
কি সুন্দর সুরেই গাইছে। শুনে কানাইয়ের
প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সে অবাক
হয়ে খালি শুনতেই লাগল। গানের
সুরটি অতি আশ্চর্য, কিন্তু কথা কালি এইটুকুঃ
‘লুন হ্যায়,তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’
শুনতে শুনতে কানাই একেবারে মেতে গেল।
সে ভাবল যে তারও গানটা না গাইলেই
চলছে না। কাজেই সেও খুব
করে গলা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ধরলঃ
‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়,
হিং হ্যায়!’
এইটুকুই গেয়েই ঝাঁ করে তার বুদ্ধি খুলে গেল,
সে আরো উঁচু সুরে গাইল
‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়,
চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’
কানাই এই কথাগুলো খুব গলা ছেড়েই
গেয়েছিল। সে গলার আওয়াজ যে সেই
বাড়ির ভিতরের গাইয়েদের
কানে গিয়ে পৌঁছিয়েছিল, তাতে আর কোন
ভুল নেই। সে গাইয়েগুলো ছিল অবশ্য ভূত।
তারা সেই নূতন কথাগুলো শুনে এতই খুশি হল
যে, তখনই ছুটে কানাইয়ের কাছে না এসে আর
থাকতে পারল না।
তারা এসে কানাইকে কোলে করে নাচতে নাচতে সেই
বাড়ির ভিতরে বেয়ে গেল, আর
যে আদরটা করল! মিঠাই যে তাকে কত
খাওয়াল, তার অন্ত নেই। তারপর
সকলে মেলে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলঃ
‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্লী হ্যায়,
হিং হ্যায়!’ ‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়,
চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’
কানাইকেও তাদের
সঙ্গে নেচে নেচে গানটি গাইতে হল। তখন
তার মনে হল, ‘কি আশ্চর্য, আমি কুঁজ
নিয়ে চলতে পারি না, আমি আবার নাচলুম
কি করে?’ বলতে বলতেই তার
হাতখানি পিঠের দিকে গেল-এ কি? তার
সে কুঁজ যে আর নেই! একজন ভূত বলল, ‘কি,
দেখছিস বাপ? ওটা আর ওখানে নেই। ঐ দেখ,
তোর পাশে পড়ে আছে।’
সত্যি সত্যে সে কুঁজ আর কানাইয়ের
পিঠে ছিল না, তখন তার পাশে পড়ে ছিল।
আহা! কানাইয়ের তখন কি অনন্দই হল। আর
হালকা আর আরাম বোধ হল এমনি যে,
সে তখনই
সেইখানে মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
তারপর যখন পরদিন সকালে তার ঘুম ভাঙল,
তখন সে দেখল যে সেই বাড়ির
বাইরে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে।
ভূতেরা তাকে একটি চমৎকার নূতন পোশাক
পরিয়ে সেখানে এনে রেখে গিয়েছে। তখন
সে তাড়াতাড়ি উঠে, মনের
সুখে বাড়ি চলে এল। সেখানকার
লোকেরা তার মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল
করে তাকায়, কেউ তাকে চিনতে পারে না।
সে যে তাদের সেই কুঁজো কানাই,
ভূতেরা তার কুঁজ ফেলে তার এমনি সুন্দর
চেহারা করে দিয়েছে, এ কথা তাদের
বোঝাতে তার অনেকক্ষণ লেগেছিল।
তারপর দেখতে দেখতে কানাইয়ের কুঁজের
গল্প দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। যে শুনল, সেই ভাবল
যে, এমন আশ্চর্য কথা আর কখনো শোনে নি।
এখন আর লোকে তাকে দেখে মুখ
ফিরিয়ে থাকে না;
তারা হাসতে হাসতে ছুটে এসে তার
সঙ্গে কথা কয়, আর বাড়ির লোককে তার এই
আশ্চর্য খবর শোনাবার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ
করে নিয়ে যায়। কত লোকে শুধু সেই গল্প
শোনাবার জন্যই তার ঝুড়ি কিনতে আসে।
ঝুড়ি বেচে সে বড়লোক হয়ে গেল।
এমনি করি দিন যাচ্ছে। তারপর একদিন
কানাই তার ঘরের দাওয়ায় বসে ঝুড়ি বুনছে,
এমন সময় একটি বুড়ি সেই
পথে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাগো,
কেবলহাটি যাব কোন পথে? কানাই বললে,
‘এই ত কেবলহাটি। তুমি কি চাও?’ বুড়ি বলল,
‘তোমাদের গ্রামে নাকি কানাই
বলে কে আছে, ভুতেরা তার কুঁজ
সারিয়ে দিয়েছিল। তার মন্তরটা তার কাছ
থেকে শিখে নিতে পারলে আমাদের
মানিকের কুঁজটাও সারিয়ে নিতুম।’
কানাই বলল, ‘আমি ত সেই কানাই
ভূতেরা আমারই কুঁজ সারিয়ে দিয়েছিল। এর
ত মন্তর-টন্তর কিছু নেই, তারা রাত
জেগে গাইছিল, আমি পথের
ধারে শুয়ে শুয়ে তাদের গানে নতুন
কথা জুড়ে দিয়েছিলাম।
তাইতে তারা খুশি হয়ে আমার কুঁজ সারিয়ে,
নূতন পোশাক পরিয়ে দিয়েছিল।’ বুড়ি তখন
খুঁটে খুঁটে সব কানাইয়ের কাছ
থেকে জেনে নিয়ে তাকে অনেক আশীর্বাদ
করে সেখান থেকে চলে গেল।
সেই বুড়ির ছেলে যে মানিক, তার
পিঠে ছিল কানাইয়ের কুঁজের চেয়েও ঢের বড়
একটা কুঁজ। লোকটা এমনি দুষ্ট আর
হিংসুটে ছিল যে পাড়ার লোকে তার
জ্বালায় অস্থির থাকত। সেই মানিকের কুঁজ
সারাবার জন্য তার বাড়ির লোকেরা একদিন
রাত্রে তাকে গাড়ি করে এরে ভূতের বাড়ির
কাছে রেখে গেল।
সেখানে পড়ে পড়ে মানিক ভাবছে,
ভূতেরা কখন গান ধরবে, আর
তাতে সে কথা জুড়ে দেবে, আর তার কুঁজ
সেরে গাবে। তারপর যেই
ভূতেরা বলেছেঃ ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায় ,
ইম্লী হ্যায়,’ অমনি মানিক আর তাদের শেষ
করতে না দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘গুরুচরণ ময়রার
দোকানের কাঁচা গোল্লা হ্যায়।’
তখন গানের তাল ভেঙে ত গেলই,
কাঁচাগোল্লার নাম শুনে অনেক ভূতের
বমি পর্যন্ত হতে লাগল। ভূতেরা এ সব
জিনিসকে বড্ড ঘৃণা করে, এর নাম
অবধি শুনতে পারে না। কাজেই
তারা তাতে বেজায় চটে দাঁত
খিঁচুতে খিচুতে এসে বললম ‘কে রে তুই অসভ্য
বেতালা বেটা, আমাদের গান
মাটি করে দিলি? দাঁড়া তোকে দিখাচ্ছি!’
এই বলে তারা কানাইয়ের সেই
কুঁজটা এনে মানিকের কুঁজের উপর
বসিয়ে এমনি করে জুড়ে দিল যে আর কিছুতেই
তাকে তাকে তুলবার জো নেই।
পরদিন মানিকের বাড়ির
লোকেরা এসে তাকে দেখে অবশ্য খুবই
আশ্চর্য আর দুঃখিত হল। কিন্তু গ্রামের
লোকেরা বলল, ‘বেটা যেমন দুষ্টু,
তেমনি সাজা হয়েছে।’