আজ থেকে বছর দুই আগের কথা । বাংলাদেশে আমার পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়িতে বেড়াতে যাব বলে কলকাতা স্টেশন থেকে চরে বসলাম মৈত্রী এক্সপ্রেসে । বিকেলে ঢাকায় পৌঁছেই গাড়ি করে রওনা দিলাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে । জায়গাটা আসলে গারো পাহাড়ের নীচে এক ছোট্ট জনপদ, জনবসতিও তেমন নেই বললেই চলে । আর রাতে যখন গ্রামে পৌঁছালাম, তখন রাত দশটা হবে । অথচ মধ্যরাতের মতো নিকষ কালো অন্ধকার । সত্যি এরকম গ্রাম আমি আর দুটো দেখিনি । সময়টাও জানুয়ারী মাস, জম্পেশ ঠান্ডা ।রাত্রে খাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়লে বাইরে এসে আমি বসেছিলাম । আঠারো বছর বয়স আমার, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হওয়ায় “ভয়” শব্দটাই ছিল অজানা । রাত তখন বোধ করি এগারোটা । প্রকৃতির অপরূপ রূপে বিমোহিত হয়ে ছিলাম ।
হঠাৎ কে এক যুবতী মেয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারিনি । হঠাৎ তার গলার আওয়াজে একটু চমকেই উঠলাম, সে বললো, “দিদিমণি, এত রাত্তিরে তুমি বাইরে কেন ? এখানে একা থাকবে না একদম, ভয় পাবে । যাও, ঘরে যাও এখনি ।” আমি বললাম, “ভয় পাবো? কাকে দেখে? তোমাকে? আর তুমিই বা কে?” হেসেই ফেললাম । সে শুধু শক্ত গলায় বলল, “তুমি এখনি ঘরে যাও।” জানিনা কেন, তার আদেশের স্বরটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলামনা, ঘরে এসে শুয়ে ঘুমিয়েও পড়লাম কখন ।
পরের দিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম দাদার সাথে অঞ্চলটা ঘুরে দেখতে । ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল । রাতে খাওয়া হলে জানলার পাশে শুয়ে রবীন্দ্রনাথের “কঙ্কাল” পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা । হঠাৎ মাঝরাতে শরীরে একটু অস্বস্তি বোধ করায় বাইরে বেড়িয়ে একাই গেলাম বাথরুমে, গ্রামের বাড়িতে বাথরুম সাধারণত একটু দূরেই হয় । হাতে টর্চ নিয়ে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতে পারলাম না । দরজাটা একটু টেনে রেখে তারপর হাতে মুখে জল দিচ্ছিলাম । বাড়ির এই বাথরুমটার উপরে কোন ছাদ নেই, একটা বিরাট পুরানো অশ্বথ্থ গাছ বাথরুমের উপরটা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে । গাছ থেকে কুয়াশার দু-এক ফোঁটা জল গায়েও পরছে । হঠাৎ করে যেন বাথরুমের দরজার বাইরে একটা কিসের ঝমঝম শব্দ শুনতে পেলাম, ভাবতে ভাবতে আবার শব্দটা হলো, এবার তার সাথে স্পষ্ট নূপুরের আওয়াজ পেলাম । এত রাত্রে কেউ কি তবে ঘুম থেকে উঠেছে ? দরজাটা খুব আস্তে খুলতে গিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে অজান্তেই শিউরে উঠলাম, যদিও বাইরে কাউকেই দেখলাম না । এই হদ্দ গ্রামে এত রাত্রে ভূতের থেকেও বড় শত্রু মানুষ হতে পারে । ঘরে ফেরার সময় স্পষ্ট শুনলাম নুপূরের শব্দটাও আমাকে অনুসরন করছে । এবার সত্যিই কেমন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো শরীরে, সাহসে ভর করে পিছনে ফিরলাম, কোন মানুষের অস্তিত্ব টের পেলাম না । কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেন চাপা কন্ঠে বলছে, “ ঘরে যাও । বিপদ বিপদ ।” কি অদ্ভুত, এ গলা তো কালকের রাত্রের সেই মেয়েটিরই । আমি বললাম, “ তুমি কে? কোথায় ? দেখতে পাচ্ছি না কেন ? আমার সঙ্গে মজা করছো ?” এবার একদম আমার গায়ের উপরেই প্রায় উত্তর এলো, “ তুমি ভুল করছো, কেন তর্ক করে সময় নষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছ ? বিপদে পড়বে, অযথা দাড়িয়ো না, বললাম তো । অযথা কৌতুহল দেখিয়ো না, যাও ঘরে যাও ।” শেষের শব্দটা রীতিমতো হুকুমের মতো ঠেকলো আমার কাছে । এক অজানা ভীতির সঙ্গে কেমন যেন এক একরোখামি আমাকে পেয়ে বসলো । আমি বললাম, “ না আমি যাব না, হয় তোমার পরিচয় দাও নয়তো আমার সামনে এস ।” কি আশ্চর্য্, এবার সেই অদৃশ্য ভাষনকারী আমার একগুয়েমী দেখে রাগ না করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো, আর বললো, “ তুমি আমাকে দেখতে পারবে না, আর দেখলেও তা তুমি সইতে পারবে না, তাই তোমাকে যেতে বলছি বারবার।” আমি এবার কিছুটা ভয় পেলাম বোধহয়, আমার গায়ের ভিতরে কেমন যেন এক ঠান্ডা রক্তস্রোত বয়ে চলেছে বোধ করলাম । এই রকম এক নিঃশব্দ ভৌতিক পরিবেশেও নিজেকে শক্ত রেখে বললাম, “ তুমি কি তবে ভুত নাকি? দেখ ভুত বলে কিছু আমি বিশ্বাস করি না, তুমি ভুতই হও বা লুকিয়ে থাকা কোন ঈশ্বরীই হও, আমি তোমাকে চাক্ষুস করতে চাই ।” “ঠিক আছে নিজেকে শক্ত রেখো, তোমার যখন রোখ চেপেছে ।” সে বলল বটে কিন্তু আর আমি কোনো আওয়াজ পেলাম না । অব্যবহিত সময়ের মধ্যেই আমার নাকে এক বিকট পোড়া গন্ধ এসে লাগতে আরম্ভ করলো । কিসের গন্ধ এটা? এবার সত্যিই ভয় লাগল । চারিদিকে তাকিয়ে গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ অশ্বথ্থ গাছে আমার দৃষ্টি আটকে গেল । দেখলাম, অশ্বথ্থ গাছের সামনে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে, আর সেই আগুনে জীবন্ত পুড়ে যাচ্ছে আমার কাল রাতে দেখা সেই মেয়েটি । তার সেই নিটোল মুখটা কি বিভৎস ভাবে পুড়ে যাচ্ছে । এও কি সম্ভব? কিন্তু তখন এসব ভাবার বিন্দুমাত্র শক্তিও আমার আর ছিলনা । আমার কন্ঠ অবরুদ্ধ, চিৎকার করার চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারলাম না, কোনরকমে আড়ষ্ট হয়ে আসা শরীর টাকে নিয়ে একছুটে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, তারপর আর কিছুই মনে নেই । জ্ঞান আসলে চোখ খুলে দেখি সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । পিসি বলল, “কাল অত রাতে একা কেন বেড়িয়েছিলি বাথরুমে? জানিস, আগের বছর কালকের দিনেই একটা মেয়ে ওই অশ্বথ্থ গাছের তলায় গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, তারপর থেকে ওই দিকটায় রাতে কেউ যায়না । তুই কি কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস?” আমার আড়ষ্ট গলা দিয়ে শুধু অস্ফুটে একটাই উত্তর বেড়িয়ে এল, “না” ।।