এটি আরবের প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় জাতি। আদের পরে এরাই সবচেয়ে বেশী খ্যাতি ও পরিচিতঅর্জন করে। কুরআন নাযিলের পূর্বে এদের কাহিনী সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। জাহেলীযুগের কবিতা, ও খুতবা সাহিত্যে এর ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায়। আসিরিয়ার শিলালিপি, গ্রীস,ইসকানদারীয়া ও রোমের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ভুগোলবিগণও এর উল্লেখ করেছেন। ঈসা আলাইহিসসালামের জন্মের কিছুকাল পুর্বে ও এ জাতির কিছু কিছু লোক বেঁচেছিল। রোমীয় ঐতিহাসিকগণের মতে,এরা রোমীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে এদের শত্রু নিবতীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
উত্তর পশ্চিম আরবের যে এলাকটি আজো 'আল হিজর' নামে খ্যাত সেখানেই ছিল এদের আবাস।আজকের সউদী আরবের অন্তর্গত মদীনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজায রেলওয়ের একটি ষ্টেশন রয়েছে,তার নাম মাদায়েনে সালেহ।এটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল হিজর।সামূদজাতির লোকেরা পাহাড় কেটে যেসব বিপুলায়তন ইমারত নির্মাণ করেছিল এখনো হাজার হাজার একরএলাকা জুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। এ নিঝুম পুরীটি দেখে আন্দাজ করা যায় যে এক সময়ে এ নগরীরজনসংখ্যা চার পাঁচ লাখের কম ছিল না। কুরআন নাযিল হওয়ার সময়কালে হেজাযের ব্যবসায়ী কাফেলাএ প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতো।
হিজ্র ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় শহর । মদীনার উত্তর পশ্চিমে বর্তমান আল'উলা শহরের কয়েক মাইলদূরে এ শহরটির ধবংসাবশেষ পাওয়া যায় । মদীনা থেকে তাবুক যাবার সময় প্রধান সড়কের ওপরই এজায়গাটি পড়ে । এ উপত্যকাটির মধ্য দিয়ে কাফেলা এগিয়ে যায় । কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী কেউ এখানে অবস্থান করে না । হিজরী আট শতকে পর্যটক ইবনে বতুতা হজ্জেযাবার পথে এখানে এসে পৌঁছেন । তিনি লেখেন : " এখানে লাল রংয়ের পাহাড়গুলোতে সামুদ জাতিরইরামতগুলো রয়েছে । এগুলো তারা পাহাড় কেটে কেটে তার মধ্যে নির্মাণ করেছিল । এ গৃহগুলোরকারুকাজ এখনো এমন উজ্জ্বল ও তরতাজা আছে যেন মনে হয় আজই এগুলো খোদাই করা হয়েছে ।পচাগলা মানুষের হাড় এখনো এখানকার ঘরগুলো মধ্যে পাওয়া যায় ।( আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য সূরাআ'রাফের ৫৭ টীকা দেখুন )
এ জাতিটি সম্পর্কে কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে যে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তা থেকে জানাযায়, আদ জাতির পরে দুনিয়ায় এ সামুদ জাতিই উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। جَعَلَكم خُلَفَاء من بعد عَادٍ (الاعراف : ৭৪) । কিন্তু তাদের সভ্যতার অগ্রগতিও শেষ পর্যন্ত আদ জাতির উন্নতি ওঅগ্রগতির মতো একই রূপ পরিগ্রহ করে। অর্থাৎ জীবন যাত্রার মান উন্ন থেকে উন্নততর এবং মনুষ্যত্বেরমান নিম্নতর থেকে নিম্নতর হতে থাকে। একদিকে সমতল এলাকায় সুউচ্চ ও সুরম্য প্রাসাদোপম অট্টালিকাএবং পার্বত্য এলাকায় অজন্তা-ইলোরার পর্বত গূহার মতো সূরম্য প্রাসাদ নির্মিত হতে থাকে। আরঅন্যদিকে সমাজে শিরক ও মূর্তি পূজার প্রবল জোয়ার চলতে থাকে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠ ভরে উঠতে থাকেজুলুম-নিপীড়নের প্রাবল্যে। জাতির সবচেয়ে অসৎ দুষ্কৃতিকারীরা তার নেতৃত্বের আসনে বসেছিল। হযরতসালেহের সত্যের দাওয়াত কেবলমাত্র নিম্নশ্রেণীর দুর্বল লোকদেরকেই প্রভাবিত করছিল। উচ্চ শ্রেণীরলোকেরা শুধুমাত্র এ কারণেই তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল যে, انَّا بالَّذِى امنتم به كَافِرُوْنَ"যেবিষয়ের প্রতি তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছো তা আমরা মেনে নিতে পারি না।"
সামূদ জাতির লোকেরা আলকুরা ' উপত্যকায় পাথর কেটে কেটে তার মধ্যে গৃহ নির্মাণ করেছিল। সম্ভবতইতিহাসে তারাই প্রথম জাতি হিসেবে চিহ্নিত যারা পাহাড়ের মধ্যে এভাবে ইমারত নির্মাণের রীতি প্রচলনকরেছিল।
আদ জাতির সভ্যতার উল্ল্যেখযোগ্য বৈশিষ্ট ছিল, তারা উচু উচু স্তম্ভ বিশিষ্ট ইমারত নির্মান করতো। ঠিকতেমনি সামুদ জাতির সভ্যতা তার চেয়ে যে সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টের জন্য প্রাচীনকালেরজাতিসমূহের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তা ছিল এই যে, তারা পাহাড় কেটে তার মধ্যে ইমারত নির্মাণকরতো। তাই সূরা আল ফজরে যেভাবে আদকে 'যাতুল ইমাদ' (ذات العماد) বলে অর্থাৎ স্তম্ভের অধিকারীপদবী দেয়া হয়েছে ঠিক তেমনি সামুদ জাতির বর্ণনা একথার মাধ্যমে করা হয়েছেঃ
الَّذِيْنَ جَبُوا الصََّخْرَ بِالوَادِ -
"এমন সব লোক যার উপত্যাকায় পাহাড় কেটেছে।" এ ছাড়া কুরআনে একথাও বলা হয়েচে যে, তারানিজেদের দেশের সমতল ভূমিতে বড় বড় প্রাসাদ নির্মান করতোঃ
تَتَّخِذُوْن َ من سُهًولِهَا قُصُوْرًا -
এসব গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি ছিল৷ فَرِهِيْنَ শব্দের মাধ্যমে কুরআন-এর ওপর আলোকপাত করে।অর্থাৎ এসব কিছু ছিল তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব, সম্পদ, শক্তি ও প্রযুক্তির নৈপুন্যের প্রদর্শনী। কোন যথার্থপ্রয়োজনের তাগিদ এর পেছনে কার্যকর ছিল না। একটি বিকৃত ও ভ্রষ্ট সভ্যতার ধরণ এমনিই হয়ে থাকে।একদিকে সমাজের গরীব লোকেরা মাথা গোঁজারও ঠাঁই পায় না আর অন্যদিকে ধনী নেতৃস্থানীয় লোকেরাথাকার জন্য যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাসাদ নির্মাণ করে ফেলে তখন প্রয়োজন ছাড়াই নিছক লোকদেখাবার জন্য স্মৃতিস্তম্ভসমূহ নির্মাণ করতে থাকে।
সামূদদের এ গৃহ নির্মাণ শিল্পটি ছিল ভারতের ইলোরা , অজন্তা গূহাও অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত পর্বত গাত্রেরগৃহের ন্যায়। অর্থাৎ তারা পাহাড় কেটে তার মধ্য বিরাট বিরাট ইমারত তৈরী করতো। মাদায়েনে সালেহএলাকায় এখনো তাদের এসব ইমারত সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে। সেগুলো দেখে এ জাতিস্থাপত্য বিদ্যায় কেমন বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছিল, তা অনুমান করা যায়।
সামুদ জাতির এ ইমারতগুলোর কিছু সংখ্যক এখনো টিকে আছে। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি(লেখকঃসাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী রঃ) নিজে এগুলো এ জায়গাটি মদীনা তাইয়্যেবা ও তাবুকেরমধ্যবর্তী হিজাযের বিখ্যাত আল'উলা নামক স্থান, (যাকে নবীর জামানায় 'ওয়াদিউল কুরা' বলা হতো)থেকে কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত। স্থানীয় লোকেরা আজও এ জায়গাকে 'আল হিজর' ও 'মাদ্য়ানেসালেহ' নামে স্মরণ করে থাকে। এ এলাকায় 'আল উলা' এখনো একটি শস্য শ্যামল উপত্যকা। এখানেরয়েছে বিপুল সংখ্যক পানির নহর ও বাগিচা। কিন্তু আজ হিজরের আশেপাশে বড়ই নির্জন ও ভীতিকরপরিবেশ বিরাজমান। লোকবসতি নামমাত্র। সবুজের উপস্থিতি ক্ষীণ। কূয়া আছে কয়েকটি। এরই মধ্যে একটিকূয়ার ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের মধ্যে একথা প্রচলিত আছে যে, হযরত সালেহ (আ)-এর উটনী সেখানথেকে পানি পান করতো। বর্তমানে এটি তুর্কী আমলের একটি বিরান ক্ষুদ্র সামরিক চৌকির মধ্যে অবস্থিত।কূয়াটি একবারেই শুকনা। এ এলাকায় প্রবেশ করে আল উলা'র কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমরা সর্বত্রএমনসব পাহাড় দেখলাম যা একেবারেই ভেংগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পরিষ্কার মনে হচ্ছিল, কোনভয়াবহ ভূমিকম্প এগুলোকে নীচে থেকে উপর পর্যন্ত ঝাঁকানি দিয়ে ফালি ফালি করে দিয়ে গেছে। এধরণের পাহাড় আমরা দেখতে দেখতে গিয়েছি পূর্বের দিকে আল'উলা থেকে খায়বার যাবার সময় প্রায়৫০ মাইল পর্যন্ত এবং উত্তর দিকে জর্ডানে রাজ্যের সীমানার মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত।এর অর্থ দাঁড়ায়, তিন চারশো মাইল দীর্ঘ ও একশো মাইল প্রস্থ বিশিষ্ট একটি এলাকা ভূমিকম্পে একেবারেধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আল হিজরে আমরা সামুদ জাতির যেসব ইমারত দেখেছিলাম ঠিক একই ধরণের কতিপয় ইমারত আমরাপেলাম আকাবা উপসাগরের কিনারে মাদ্য়ানে এবং জর্ডান রাজ্যের পেট্টা (PETRA) নামক স্থানেও।বিশেষ করে পেট্টায় সামূদী প্যাটার্নের ইমারত এবং নিবতীদের তৈরী করা অট্টালিকা পাশাপাশি দেখাগেছে। এগুলোর কারুকাজ ও নির্মাণ পদ্ধতিতে এত সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই এক নজরদেখার সাথে সাথেই বুঝতে পারবে এগুলো এক যুগেরও নয় এবং একই জাতির স্থাপত্যের নিদর্শনও নয়।এগুলোরও আলাদা আলাদা ছবি আমি পাশের পৃষ্ঠায় দিয়েছি।
তাবুক যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ এলাকা অতিক্রম করছিলেন তখন তিনিমুসলমানদেরকে এ শিক্ষানীয় নিদর্শনগুলো দেখান এবং এমন শিক্ষা দান করেন যা এ ধরনেরধ্বংসাবশেষে থেকে একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।এ জায়গায় তিনি একটিকুয়ার দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলেন, এ কুয়াটি থেকে হযরত সালেহের উটনী পানি পান করতো। তিনিমুসলমানদেরকে একমাত্র এ কুয়াটি থেকে পানি পান করতে বলেন এবং অন্য সমস্ত কুয়া থেকে পানি পানকরতে নিষেধ করেন। একটি গিরিপথ দেখিয়ে তিনি বলেন, এ গিরিপথ দিয়ে হযরত সালেহের উটনীটিপানি পান করতে আসতো।তাই সেই স্থানটি আজো ফাজ্জুন নাকাহ বা উটনীর পথ নামে খ্যাত হয়ে আছে।তাদের ধ্বংসস্তুপগুলোর মধ্যে যেসব মুসলমান ঘোরাফেরা করছিল তাদেরকে একত্র করে তিনি একটিভাষণ দেন। এ ভাষণে সামুদ জাতির ভয়াবহ পরিণাম তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন,এটি এমন একটি জাতির এলাকা যাদের ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হয়েছিল। কাজেই এ স্থানটি দ্রুতঅতিক্রম করে চলে যাও। এটা ভ্রমনের জায়গা নয় বরং কান্নার জায়গা।
অর্থাৎ আদ জাতির পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। তোমরা যদি আদদের মতো বিপর্যয় সৃষ্টি করতেথাকো, তাহলে যে মহান আল্লাহর অসাধারণ ক্ষমতা এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে তারজায়গায় তোমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন, সেই মহা শক্তিধর আল্লাহই আবার তোমাদেরকে ধ্বংসকরে দিয়ে অন্যদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন।