মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৩১- জীবনদা

এইভাবে জীবনদার দেখা পাবো। কখনও
স্বপ্নেও ভাবিনি। কেউই হয়তো কখনও
এইরকমভাবে ভাবেনি। তবুও
আমি দেখা পেলাম জীবনদার। আমি খুব
পছন্দ করতাম জীবনদাকে। সকালবেলা তার
হোটেলে রুটি দিয়ে নাস্তা না খেলে সারাদিনই
আমার পেট খালি খালি মনে হতো। রুটির
সাথে তার ভাজি কি যে স্বাদ ছিলো।
জীবনদা আমারে দেখলেই
বলতো কি চা খাবা?
জীবনদার যেদিন দেখা পেলাম সেদিন
ছিলো অমাবশ্যা। গুটগুটে অন্ধকার।
বিছানার এপাশ-ওপাশ করছি। কিন্তু
কিছুতেই ঘুম আসছেনা। ক্যাসিও
ঘড়িটা মাথার কাছেই ছিলো। ২টা বাজে।
কিছুটা বিরক্ত
হয়ে বিছানা থেকে উঠে বাজারে চলে আসলাম।
হাতে সেই ক্যাসিও ঘড়িটা।
অন্ধকারে তেমন কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা।
বাজারে একটা মানুষও চোখে পড়লোনা।
আমি হাটঁতে হাটঁতে কালিমন্দিরের
কাছে চলে আসলাম। এই দিকটায়
অন্ধকারটা যেনো আরো গভীর। মনে হয় এই
অন্ধকারই কাউকে গিলে ফেলতে পারে।
হালকা বাতাসে ধূপের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
বরাবরই ধূপের গন্ধটা আমার
কাছে ভালো লাগে। তাই কালিমন্দিরের
একদম সামনে চলে আসলাম। মন্দিরের
ভিতরে দীপবাতি জ্বলছে। হঠাৎ করে আমার
কালির মূর্ত্তির দিকে চোখ পড়লো। ভয়
পেয়ে গেলাম। জ্বিহবা বের
করে হাতে বলিদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনে হচ্ছে প্রাণ
পেলে এখনি বুঝি ঝাপিয়ে পড়বে। তাই
এদিকটা থেকে সরে আসতে জোড়ে পা চালালাম।
জীবনদার হোটেলটার সামনে এসে পড়েছি।
বাজারের মাঝখানে হোটেলটার
চারদিকে খোলা। শুধুমাত্র একটা চালা।
বসার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে।
কিছুটা হাফিয়ে পড়েছি ভেবে একটা বেন্চে বসলাম।
সুনসান নিরবতা। সারা বাজার ঘুমাচ্ছে।
আকাশের
পানে মিটিমিটি তারা খুঁজতেছিলাম
মনে হয়।
হঠাৎ................ চা খাবা এমন কথায় লাফ
দিয়ে উঠলাম। কে কে বলে আমার
গলা কেঁপে উঠলো। এই আ-মি তোমার
জীবনদা। জী-ব-ন-দা........
সামনে তাকাতেই অন্ধকারে জীবনদার
অস্তিত্ব অনুভব করলাম। খুবই অপ্রস্তুত
ভঙ্গিতে বলে উঠলাম জীবনদা আপনি...........
..........।
জীবনদার মুখ দিয়ে কোন কথায় বের
হচ্ছেনা। আমার দিকে চোখ বড় বড়
করে তাকিয়ে আছে। উনার
তীক্ষ্নদৃষ্টি আমার চোখও
নামাতে দিলোনা। মনে হচ্ছে উনার চোখ
দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়বে এখনি।
মনে পড়ে গেলো জীবনদা মারা গেছে একবছর
হয়ে গেছে। ক্যান্সার হয়েছিলো।
উনি যে রাতে মারা যায় সেদিন ব্যাপক ঝড়-
বৃষ্টি ছিলো। ঝড়ের তীব্রতা একটু
কমলে তারাতারি করে তাকে দাহ
করতে নিয়ে যায়।
এই এলাকায় একটা রেওয়াজ
বহুলভাবে প্রচলিত ছিলো যে কেউ
মারা গেলে চিহ্নিত কিছু
ব্যাক্তি ছিলো যারা সবসময় লাশের
সৎকারে উপস্থিত থাকে। জীবনদার
সৎকারেও তারা ছিলো। দাহ করার সময়
জীবনদার দুই ছেলেও ছিলো। দাহ করার
অর্ধেক সময়ে ঝড়ের তীব্রতা অনেক
বেড়ে যায়। ফলে জীবনদার অর্ধমৃত লাশ
নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে সবাই চলে আসে। এর
পর থেকেই নাকি প্রায়ই
জীবনদাকে দেখা যায়। গভীর রাতে কেউ
যদি একলা বের হয় তখনি নাকি জীবনদা বের
হয়ে আসে এবং তার সাথে চলতে বলে।
বুঝতে পারলাম আমিও এখন সেই
মুহুর্ত্তে দাঁড়িয়ে আছি।
কিছুটা কি অপ্রস্তুত, ইতস্তত বোধ করছি। বার
বার চেষ্টা করেও কন্ঠ দিয়ে কোন স্বর বের
হচ্ছিলোনা। গাঁয়ের সমস্ত
শক্তি দিয়ে কন্ঠের সমস্ত তীব্রতায়
ডাকলাম জীবনদা........। এইবার
জীবনদা চিৎকার করে উঠলো। খুব কঠিন
এবং রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো আমার
সাথে চলো।
বলতে বলতে জীবনদা হাঁটতে লাগলো।
আমিও পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম।
প্রতিটা নিঃশ্বাস
যেনো প্রতিধ্বনি হয়ে আমার
কানে এসে লাগছে। চারদিকের
আবহাওয়া যেনো এক ঝাপটায় ভেপসা গরম
হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম গায়ের শার্ট
টি ভিজে যাচ্ছে। কখন যে বাজার পার
হয়ে চড়ে চলে আসলাম বুঝতে পারলামনা।
মোটামুটি নিশ্চিত বুঝতে পারলাম
আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মনে হচ্ছে আর বুঝি ফিরে আসা হবেনা।
নাকের মাঝে ধূপের গন্ধ এসে লাগলো।
পুরা কাঠের গন্ধের তীব্রতাও বেশ
ঝাঁঝালো। ঠিক শশানঘাট টার
মাঝখানে এসে জীবনদা থামলো। বেশ
অন্ধকার চারদিক। জীবনদার
চেহাড়াটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা।
জীবনদা ডাক দিলো কইরে তোরা?
জীবনদা ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই
চারদিকে শব্দ হতে শুরু হলো।
পোড়া মানুষের গন্ধে বমি উদ্বেগ হলো।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েই
সামনে তাকাতেই দেখি সর্বশরীর
পোড়া একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে পিছনের দিকে সরে আসতেই কার
সাথে যেনো ধাক্কা লাগলো। তাকিয়েই
চিৎকার করে উঠলাম। দেখি গলার উপর
থেকে পুরা মুখটা জলসে গেছে।
বাকি সবকিছু ঠিক আছে। চিৎকার
করে আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু
চারদিকেই দেখি অর্ধপুড়া মৃত মানুষের ভীর
আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বুঝতে পারলাম জীবনের শেষ
প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে আর
ধরে রাখতে পারছিলামনা। এমন সময়
জীবনদার ডাকে সম্বিত ফিরে ফেলাম।
তাকিয়ে আৎকে উঠলাম। জীবনদার
চেহাড়াও দেখি অর্ধপুড়া। কন্ঠ
না বুঝলে হয়তো জীবনদাকে চিনতেই
পারতামনা। জীবনদা বলতে শুরু করলো -
এইখানে যাদেরকে তুমি দেখছো সবাই
মারা গেছে। অনেককেই তুমি চিনতে। এ
হলো গোপাল...... ও হলো.........।
আমার চোখ কপালে উঠলো।
জীবনদা আবার বলতে শুরু করলো।
এখানে যারা এসেছে তাদের কারো সৎকারই
ঠিক মতো হয়নি। তাই তাদের আত্নার এ
বিদ্রোহ।
গোপাল জীবনদার কথা কেড়ে নিলো।
বললো- আমি যেদিন মারা গেলাম সেদিন
ছিলো অমাবস্যা। বিকেল থেকেই
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। সন্ধার ঠিক আগ
মুহুর্ত্তে হঠাৎ করে বুকে প্রচন্ড চাপ দিলো।
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই নাক-মুখ
দিয়ে রক্ত আসা শুরু হলো। সবাই সন্তস্ত
ভাবে দৌড়াতে শুরু করলো।
আমি বুঝতে পারলাম প্রাণ
বায়ুটা চলে যাবে। সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল
করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একসময়
মারা গেলাম। শুরু হলো কান্নাকাটি।
কান্নার
সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো শো শো ঝড়
আর বৃষ্টি। এর মাঝে কেউ কেউ আমার সৎকার
নিয়ে ব্যস্থ হয়ে গেলো। খড়ি, ঘি, ঠাকুর
সবাই রেডি। ঝড়-বৃষ্টিটা একটু কমতেই
আমাকে শশানে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার
মুখে আগুন দেওয়া হলো। দাউ দাউ
করে জ্বলে উঠতেই যেনো আর প্রকৃতির সহ্য
হলোনা এই দাহন করার ক্ষমতা। আবার শুরু
হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। ঠাকুরের ইশারায়
আমাকে আমার আত্নীয়রা সৎকার শেষ
না করেই নদীতে ছুঁড়ে ফেললো। কি দোষ
ছিলো আমার? আমার মৃত শরীরের? আমার
আত্নীয়রা কি পারতোনা আরেকটু
অপেক্ষা করতে?
বৃদ্ধ কে যেনো একজন খুক খুক
করে কেশে উঠলো।
বলতে লাগলো আমি যেদিন মারা গেলাম
সেদিন ছিলো পূর্ণিমা। প্রচন্ড গরম।
আমাকে চিতায় শুয়ে যখন মুখে আগুন
দিয়ে দিলো অল্পতেই আমার সারা শরীর
পুরে গেলো। বৃদ্ধ মানুষ শরীরে মাংসই
বা কি আছে? কিন্তু
হাড়গুলো যেনো কিছুতেই পুড়ছিলোনা।
শেষে আমাকেও
না পুড়িয়ে ফেলা দিলো নদীতে।
আরেকজন কি যেনো বলতে চাইলো?
জীবনদা থামিয়ে দিয়ে বললো তুমি চলে যাও।
আমাদের মিশন শেষ হয়েছে। আর কখনও
ফিরে আসবোনা...........................