আল্লাহর অসংখ্য প্রশংসা যে, (এরসিনাস) খ্রিস্টান পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবেতিনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার সৌভাগ্যে ভূষিত করেছেন। আমার জন্ম ওশিক্ষা রাজধানী ম্যানিলার এক খ্রিস্টান পরিবেশে। এখানে কোনো মুসলিম নেই।ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলগুলোতেই মুসলিমদের অবস্থান সীমিত। বাল্যকালে আমারপরিবার চাইতো গির্জায় আমি বেশি বেশি সময় দেই। বাবা যখন আমাকে গির্জায় নিয়েযাবার সুযোগ করতে পারছিলেন না, তখন আমার বয়সে বড় এক ভাই এলেন। তিনিরোজ আমাকে গির্জায় নিয়ে যেতেন।
আমি যখন যৌবনে পা রাখলাম, গির্জায় যেতে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলাম না।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজ ধর্ম খ্রিস্টবাদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। এসম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা শুরু করলাম। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেলাম, খ্রিস্ট ধর্মেক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্টসহ নানা বিভক্তি। আমার বিস্ময় বেড়ে গেল যখন দেখলামধর্মমতে ব্যাপক বিভক্তি থাকলেও তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে ঈমান না আনারবেলায় এরা সব একাট্টা।
শিক্ষা জীবন শেষে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে আমি সৌদি আরব গেলাম। এই প্রথমআমার মুসলিমদের সংস্পর্শে আসা। আগেই বলেছি ফিলিপাইনে থাকতে আমি কোনোমুসলিমের সঙ্গ পাইনি। ফিলিপাইনের মুসলিমরা তাদের অঞ্চলগুলোতেই সীমাবদ্ধথাকেন। আমরা তাদের সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাই না। সরকারি প্রচার মাধ্যম যাপ্রচার করে অগত্যা আমাদেরকে তা-ই বিশ্বাস করতে হয়। মিডিয়া দেশেরজনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে, দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিমদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যেসবসংঘর্ষ হয় তা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা মুসলমানদেরএকটি উগ্রগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরে। যারা কেবল তাদের দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়।পেতে চায় তাদের রাজনৈতিক অধিকার। আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া যে, আজ আমিযাদের একজনে পরিণত হয়েছি সেই মুসলিম ভাইদের কারও দিকে কখনো অস্ত্র তাককরিনি।
আমি সৌদি আরবে যাওয়ার পরেই কেবল মুসলিম সম্পর্কে জানতে পারি। তাদেরঅবস্থা, আচার ও আকীদা (বিশ্বাস) সম্পর্কে অবহিত হই। আমি যাদের সাঁতার প্রশিক্ষণদিতাম তাদের মধ্যে এক বালক ছিল। বয়স তার অনূর্ধ্ব তেরো। ক্ষুদে এই মুসলিমেরচলাফেরা ও কাজকর্মে লক্ষ্য করতাম দারুণ এক নিয়মানুবর্তিতা। ওর স্বভাব শান্ত।জীবন যাপন সুশৃঙ্খল। আমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির অন্যথা করে না সে কখনো।যথাসময়ে সালাত আদায়ে তার চেষ্টা দেখার মতো। অবসরের সিংহভাগ সময়ই কাটততার নিবিষ্টমনে কুরআন তেলাওয়াতে।
মুসলিম বালকটির ছিল তীক্ষ্ন মেধা আর বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। আমি তারকর্মকাণ্ডের প্রতি লক্ষ্য করছি, তার সঙ্গ আমাকে আনন্দ দিচ্ছে- এতটুকু বুঝতে পেরেইসে আমার সামনে একগাদা ইংরেজিতে অনূদিত ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বইউপস্থাপন করল। ইংরেজি অনুবাদসহ কুরআন শরীফের একটি কপিও দিল। সঙ্গে সেএও বলল, 'আপনি এসব পড়লেই আমার সুবিন্যস্ত জীবন যাপনের রহস্য উদ্ধার করতেপারবেন।'
এই প্রথম ইসলাম সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতা। যত পড়লাম আমার সামনে একে একেঅজানা জগত উদ্ভাসিত হতে লাগল। আমি বা আমার মতো অন্য কেউ এ জগতেরসন্ধান পাননি। এসব পড়ে আমি খুব প্রভাবিত হলাম। বিশেষ করে যখন কুরআনশরীফের তরজমা পড়লাম। এ কিতাবে যে একক স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে, তা আমারচিন্তার সঙ্গে মিলে গেল। এ চিন্তায় আমি খুব তৃপ্তি ও স্বস্থি বোধ করলাম। এরপর আমিপ্রবলভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এমনকি আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণাদেয়ার আগেই নিজের নতুন নামও (আব্দুল করীম) ঠিক করে ফেললাম। আসলেইসলামের সঙ্গে আমার এই পরিচয়ের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের পর এই বালকটিরপ্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। এই পরিচয়ের পরই শুরু হয় হেদায়েতের পথে আমার অভিযাত্রা।
আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন দেখতে লাগলাম আমার সহকর্মীদের সময়মতো সালাতআদায়ের দৃশ্য। আমার কর্মক্ষেত্রেই ছিল মসজিদ। আমি পর্যবেক্ষণ করতাম তাদেরসালাত। কী বিস্ময়কর তন্ময়তায় তারা নামাজে নিমগ্ন হত! সবাই একসঙ্গে রুকু করছে,সিজদা করছে! একই ইমামের পেছনে সবাই কত শৃঙ্খলা ও গুরুত্বের সঙ্গে সালাতআদায় করছে! আমার কর্মস্থলের বন্ধুরাও অনুদারতা দেখাননি। তারা আমাকে জেদ্দায়রাখা এই বালকটির মতই সহযোগিতা করেছেন। যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করেছেন। তারা যখনআমার ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা, ইসলাম নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা এবংসালাতের ব্যাপারে অনন্ত কৌতূহল লক্ষ্য করলেন, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছুকিতাব পড়তে দিলেন।
তাদের দেয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল পাদ্রীদের সঙ্গে আহমদ দিদাতের সংলাপের বই।আমি অনেক শুনেছি, মুসলমানরা অন্যদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে। সৌদি আরবেআসার এগে থেকেই আমার মাথায় এই চিত্র আকাঁ ছিল। কিন্তু এখানে এসে আমি এধরনের কোনো আচরণ দেখলাম না। সিজওয়ার্টের সঙ্গে আহমদ দিদাতের বিতর্কঅনুষ্ঠানের বই আমার মনে অনেক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করল। এই লোকটির ব্যাপারেআমি যার পর নাই বিস্মিত। কিভাবে তিনি একেরপর এক প্রমাণ উপস্থাপন করেন!একটির পিঠে আরেকটি যুক্তি তুলে ধরেন! বর্ণনা আর যুক্তি কোনোটির অভাব নেইতাতে! প্রতিটি আসর পাঠে আমি হেসে মরি আর সিজওয়ার্ট পরাজিত বিষণ্ন হতে থাকে।তার প্রতিক্রিয়া ছিল অতৃপ্ত মানুষের নির্ভুল প্রতিক্রিয়া। তার অবস্থান যে ভ্রান্তির পক্ষে,মুসলমানদের আগে তা খ্রিস্টানও বুঝতে পারছিল।
এক পর্যায়ে আমি আহমদ দিদাতের কাছে চিঠি লিখলাম। এতে আমি তার যুক্তির শাণিতঅস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অসাধারণ ক্ষমতার প্রশংসা করলাম। তার কাছে এধরনের অসত্য থেকে সত্য উন্মোচনকারী বিতর্ক ও সংলাপের বেশি বেশি বই চাইলাম।
এখন আমি খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম।এতদুদ্দেশে আমার সহকর্মীদের কাছে এ জন্য আমার করণীয় কী তা জানতে চাইলাম।আর সেদিনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর, তাঁররাসূলের ওপর এবং শেষ দিবসের ওপর। বিশ্বাস স্থাপন করলাম জান্নাত ও জাহান্নামসম্পর্কেও। সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমি নিজের অপরিমেয় সৌভাগ্য অনুভবকরলাম। আজ অনুগত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করি। আমি সালাত আদায়েমসজিদে যাই। সেখানে সিজদাবনত হয়ে এক অপার্থিব তৃপ্তি ও সুখ বোধ করি। জীবনযাপনেও তেমনি অপূর্ব প্রশান্তির আস্বাদ পাই। আমার অতীত জীবন ছিল বিশৃঙ্খলা আরউদ্দেশ্যহীন হট্টগোলে পূর্ণ। আল্লাহ আমাকে সে অবস্থার বদলে আজ আলো, শৃঙ্খলা,সচ্চরিত্র ও মূল্যবোধের জীবন দান করেছেন। সত্যিই আমি মুসলিম ভাইদের সঙ্গ পেয়েসৌভাগ্যবান। সন্দেহ নেই ইসলাম অনেক মহান ধর্ম। এর সঙ্গে জড়িয়ে ধন্য আমারজীবন।