মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ১০০- অতৃপ্তি


কেয়ারটেকার ঘরগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল । দোতলার লম্বা বারান্দার একদম প্রান্তে এসে সে শেষ ঘরটা খুলল । সবকটা ঘরেরই একই অবস্থা । সিলিং থেকে ঝুল নেমে এসেছে । কোনও কোনও ঘরে পলেস্তারা খসে পড়েছে । আসলে প্রায় চার যুগ ব্যবহার না করার ফলে যা হয়ে থাকে । সুজিত দেখল এ ঘরটার অবস্থা তাও সামান্য হলেও ভালো । সে কেয়ারটেকারকে বলল, “তাহলে এক কাজ করো, এ ঘরটাই একটু পরিষ্কার-টরিস্কার করে দাও । এটাতেই থাকা যাক” ।
কেয়ারটেকার ঘরে ঢুকে পরিষ্কার করতে লেগে গেল । সুজিত বাইরে এল । পড়ন্ত বিকেলের রোদটা বেশ মোলায়েম লাগছে । সিগারেট ধরাল । কলকাতা থেকে আসতে লাগলো ঘণ্টা দেড়েক । দুপুরেই পৌঁছে যেত । বাদ সাধল অফিস । নামী সংবাদপত্রের বড় রিপোর্টার । ক্রাইম বিভাগে । সকালেই রওনা দেবে ঠিক করেছিল । হঠাৎ সকালেই ফোন এল অফিস থেকে । নবীনচাঁদ বড়াল লেনে খুনের খবর । স্টোরি কভার করতে যেতে হবে সুজিতকেই । কেননা অন্য যিনি আরও একজন মেন ক্রাইম রিপোর্টার তিনি চিকেন পক্সে আপাতত ঘরবন্দি । বিরক্তিটা মনে চেপেই যতটা সম্ভব দ্রুততার সাথেই সুজিত স্টোরি টা কভার করেছে । ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝামেলা । সেই থেকে রাগের মাথায় খুন । স্টোরি টা করতে করতে সুজিতের ই ইচ্ছা করছিল খুনি টাকে খুন করে দেওয়ার । না, ভাইকে মেরেছে বলে নয়, সুজিতের সময়মত বেরনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় । বোঝ ! তবে সুজিতের একটি সুন্দর শখ আছে । সেটি হল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের উৎসাহেই পড়াশোনা করা, তারপর সেগুলো নিয়ে লেখালিখি । ইতিমধ্যে সে একজন সাহিত্যিক হয়ে উঠেছে । দুটো বই সে লিখেছে, একটা মায়াপুরের বিদেশী-বিদেশিনীদের নিয়ে আর একটা বিভিন্ন দেশের রুপকথা, উপকথা নিয়ে । এখন তার ইচ্ছা হয়েছে, কলকাতা ও কলকাতার আশেপাশের মফস্বল এলাকায় যেসব শতাব্দী-প্রাচীন বনেদি বাড়িগুলো আছে, তাও নামী কোনও পরিবারের বাড়ি নয়, যেগুলোর কথা সাধারনত শোনেনি কেউ, সেইরকম বাড়ি । কেননা সুজিতের মনে হয়েছে, এই বাড়িগুলির দেওয়াল, মেঝে, কড়িবরগা, সিলিং, বাগান এইসবের সঙ্গে যেসব ইতিহাস জড়িয়ে আছে, তা যেমন আকর্ষণীয় তেমনই রোমাঞ্চকর হবে মানুষের কাছে । তাই এরকম বহু বাড়ির নাম খুঁজে খুঁজে সে বার করছে, সেখানে গিয়ে পারলে থাকছে । স্থানীয় বৃদ্ধদের সঙ্গে যারা মোটামুটি বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে জানে, তাদের সাথে কথা বলে নিজের মত করে সেগুলো নোট করছে । সেই সূত্রেই নিমতার এই মিত্রবাড়িতে আসা ।
“হয়ে গেছে বাবু । একবার দেখে নিন” । কেয়ারটেকারের ডাকে সুজিত ঘরটায় এসে চোখ বোলাল । মোটামুটি চলনসই । থাকা যাবে । সে বলল, “বাঃ, ফাইন” । হঠাৎ তার মনে হল, আরে, ঘরে তো খাট-ফাট নেই । মাটিতে শুয়েছে সে, এই কাজের সূত্রেই দু-একবার । কিন্তু ইদানীং কোমরের ব্যথার জন্যে ডাক্তার মাটিতে শুতে বারণ করেছে । সে কেয়ারটেকার কে বলল, “আচ্ছা, খাট হবে না, না ?”
কেয়ারটেকার কি যেন ভাবল একটু । তারপর বলল, “দাঁড়ান । হয়ে যাবে । আমার ঘরে দুটো তক্তাপোষ । একটায় আমি শুই । একটাতে আমার বউ । ও বাপের বাড়ি গেছে । আসবে সপ্তাহখানেক বাদে । ওর টা এনে দিচ্ছি আপনাকে । তক্তাপোষে অসুবিধা হবেনা তো আপনার ?”
সুজিত বলল, “না, তা হবে না । তোমার বাড়ি কতদূরে ?”
কেয়ারটেকার বলল, “এই কাছেই । কেন বলুন তো ?”
সুজিত বলল, “না ভাবছিলাম তুমি একা আনতে পারবে নাকি আমি সঙ্গে যাব ?”
কেয়ারটেকার বলল, “ধুর, কি যে বলেন বাবু ! এমন কিছু ভারী নয় । আপনি দাঁড়ান আমি এক্ষুনি এলে দিচ্ছি” ।
কেয়ারটেকার চলে যেতে সুজিত সুটকেস খুলে নিজের জিনিসপত্র বার করল । টর্চ, মশার তেল, ডায়রি, পেন, তোয়ালে, সাবান, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম ইত্যাদি । এসব যখন সে বার করছিল তখন যেন হঠাৎ সুজিতের মনে হল, কেউ যেন “হুঁ” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । একটু অবাক হলেও সে সামলে নিল । কিছুক্ষণ পর কেয়ারটেকার ফিরল । সঙ্গে একটি মধ্যবয়সী লোক । দুজনে মিলে তক্তাপোষটাকে ঘরের এক কোণায় রাখল । কেয়ারটেকার সুজিতকে বলল, “বাবু, এ হচ্ছে দুখিরাম । আপনার রান্না-বান্না সব করে দেবে । রাত্রে থাকবেও বলেছে” ।
সুজিত খুশি হল । বলল, “বাঃ, তাহলে তো খুবই ভালো । বেশ, আমি তো রান্নার জিনিস সঙ্গে এনেইছি । দুখিরাম, তুমি তাহলে এখন আমাদের সবার চা করে ফেলো তো” ।
কেয়ারটেকার কে সুজিত বলল, “ওকে নিয়ে তো এলে । ও থাকবে কোন ঘরে ?”
কেয়ারটেকার বলল, “সে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি । ভাববেন না” ।
ব্যবস্থা করে দিল সে । পাশের ঘরটায় । একটা মাদুরেই হয়ে যাবে বলল । সন্ধেবেলা বাড়ি যাওয়ার সময় কেয়ারটেকার সুজিতকে বলল, “বড় বাথরুম তো দেখলেন ই । রাত্রে যদি বাথরুম করতে যেতে হয় তো...”
হঠাৎ সুজিত যেন আপনমনেই বলে উঠল, “পাশের দুটো ঘর পরে...”
কেয়ারটেকার চমকে উঠল, বলল, “সেকি, আপনি জানলেন কি করে ? ওটা তো আমি আপনাকে দেখাইনি । ওটা বাথরুম বলে কেউ বুঝতেও পারবে না । আপনি কি আগে কখনও এসেছিলেন এ বাড়িতে ?”
সুজিত অপ্রস্তুতে পড়ল । সে বুঝেছে, সে নিজে যেন কথাটা বলেনি, তাকে দিয়ে যেন কেউ বলাল । সে বলল, “কি জানি এমনিই মনে হল” ।
কেয়ারটেকার কি বুঝল কে জানে আর কথা বাড়াল না । সব বুঝিয়ে দিয়ে, চাবি সুজিতের হাতে দিয়ে চলে গেল । তবে তার মনে সন্দেহ যে থেকে গেল সেটা সুজিত বুঝল । সে চলে যেতে সুজিত দুখিরামকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা দুখিরাম, অনেক পুরনো বনেদি বাড়ি । তা এরকম বাড়ি নিয়ে যেরকম বদনাম-টদনাম থাকে, সেরকম কিছু নেই তো ?” কথাটা তার মনে হয়েছিল একটু আগের সেই দীর্ঘশ্বাসটা মনে আসাতে । হতে পারে মনের ভুল, তাও জিজ্ঞাসা করল সে । দুখিরাম বলল, “ভূতের কথা বলছেন তো বাবু । না, সে বদনাম নেই এ বাড়ির । থাকলে কি আর আমি রাতে থাকতে রাজি হতুম ! আগেও দু-একজন রাত কাটিয়েছেন এখানে । কেউ কখনও কিছু খারাপ ব্যাপার বলেনি” ।



সন্ধে আটটা । সন্ধে না বলে রাত বলাই ভালো । নিমতাকে এখন মোটামুটি শহর-ই বলা যায় । কিন্তু এই বাড়িটা যেন সেই শহরে থেকেও শহর থেকে দুরের কোনও গ্রহের । সময়টা যেন এখানে কয়েক যুগ আগে থেমে গেছে । ইলেক্ট্রিসিটি কোনও এককালে থাকলেও এখন যে নেই সেটা বোঝাই যায় । গোটা বাড়িটা প্রেতপুরীর আকার নিয়েছে । কিন্তু সুজিতের কাছে সেই প্রেতপুরী, প্রেতপুরী বলে মোটেই মনে হচ্ছে না । তার কেবলই মনে হচ্ছে, কোনও এক জাদুবলে যেন বাড়িটা জেগে উঠেছে । অনেক বছর ধরে যেন ঘুমিয়েছিল । আরও একটা খটকা সুজিতের, সেটা হল ওর যেন অনেক কিছুই চেনা বলে মনে হচ্ছে বাড়িটার । গতকাল আসার পর থেকেই এটা মনে হচ্ছে । আজ সকালে একাই ঘুরে ঘুরে দেখছিল সুজিত । একাধিক জায়গায় তার মনে হয়েছে এই জায়গায় সে কোনওসময় ছিল, এই জায়গায় সে কোনওসময় ছিল । একতলার একটা ঘর সে চাবি দিয়ে যখন খুলছিল, তখন তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, এই ঘরে একটা আরামকেদারা রাখা থাকত জানালার পাশে । সে ঢুকে অবাক-ও হয়েছিল একটু । এঘরে যে এককালে আরামকেদারা ছিল সেটা বোঝা গেল জানালার পাশে দেওয়ালে দাগ দেখে । এরকম দাগ সে আগেও দুটো এরকম বাড়িতে দেখেছিল । বারুইপুরের এক বাড়িতে এই দাগ তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল একজন । তারপর আবার একটি ঘরে ঢোকার সময় তার মনে হল এই ঘরে পাংখা টানত । এবং কি আশ্চর্য, সে ঘরে সত্যি একটি পাংখা র দড়ি ঝুলছিল কড়িবরগা থেকে । সুজিতকে নেশার মত পেয়ে বসছিল এই খেলাটা । এরকম আরও অনেক ঘরের সম্বন্ধেই সে কিছু না কিছু একটা ভাবছিল । এবং সেটাই মিলে যাচ্ছিল । এবং এই ভাবনাটা সে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই ভাবছিল ।
কি হচ্ছে এগুলো তার সাথে ! একটু আগে রাতের খাওয়া খেয়ছে সুজিত । দুখিরামের রান্নার হাত ভালোই । সে এঁটো থালা বাসন নিয়ে চলে যাবার পর সুজিত হাতমুখ ধুয়ে এসে ঘরে একা চুপচাপ বসেছিল । হঠাৎ তার মনে হল কে যেন খুব একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল । সুজিতের চমকে ওঠার কথা ছিল । তাও সে চমকে উঠল না । যেন এটা তার কাছে প্রত্যাশিত-ই ছিল । হঠাৎ যেন কে বলে উঠল, “কুমা-আ-আ-আ-র”
কুমার ? কে কুমার ? সুজিতের মনে যেন আসতে চেষ্টা করছিল কিছু একটা । কিন্তু এল না । অনেক চেষ্টাতেও এল না । এই ফাঁকা বাড়িতে একা সে আর দুখিরাম । দুখিরাম মনে হয়না কিছু অস্বাভাবিক টের পেয়েছে । অন্তত তার হাব ভাব দেখে তাই মনে হয় । এইরকম অবস্থায় সুজিতের অস্বস্তি হবার কথা কিন্তু হচ্ছে না তো । বরং তার খুব ভালো লাগছে । কিরকম ভালো লাগা এ, সুজিত বলে বোঝাতে পারবে না ।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সুজিত জানে না । ধড়মড়িয়ে উঠে বসল তক্তাপোষে । উফফ, কি বীভৎস স্বপ্ন রে বাবা ! সুজিত দেখছিল, দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, জ্বলেই চলেছে । একদল নিরীহ মানুষ পাগলের মত ছুটোছুটি করছে । কি ভয়ঙ্কর চিৎকার চারদিকে ! আর একদিকে দাঁড়িয়ে পৈশাচিক হাসি হেসে চলেছে এক বিশালধারী মানুষ । তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে । কে যেন আবার চেঁচাল, ওকে নিয়ে পালাও । ব্যস, তারপরেই আর দেখতে পারেনি সুজিত । আঁ-আঁ চিৎকার করে উঠে বসল খাটে । পাশের ঘর থেকে দুখিরাম কিছু শুনতে পায়নি । সুজিত উঠে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল । বাথরুম পেয়েছে । টর্চ জ্বালতে গিয়েও জ্বালল না । তার হঠাৎ মনে হল, টর্চটা এখন জ্বালানো বোধহয় ঠিক নয় । অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে যেতে যেতে ভালো লাগছিল সুজিতের । দেওয়ালগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ওর হাতের ছোঁয়ায় । ওর-ও মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন পরে কোনও চেনা কারও গায়ে হাত ঠেকছে যা বোধহয় এতদিন ওর কাঙ্ক্ষিত ছিল । প্রতিটা পদক্ষেপ যেন কত জমে থাকা কষ্ট, যন্ত্রণা, অভিমান এক নিমেষে ভুলিয়ে দিচ্ছে । বাড়িটা সুজিতকে বড় ভালবেসে ফেলেছে । সুজিত-ও বাড়িটাকে ।
পরদিন সকাল দশটায় ঘুম ভাঙল সুজিতের । গতকাল রাত্রের কথা তার মনে পড়ল । বাড়িটাকে সত্যিই সে খুব ভালোবেসে ফেলেছে । বাড়ির চিরন্তন বাসিন্দারা সুজিতের থাকাকে অনধিকার প্রবেশ বলে মনে করেনি, বরং পরম সাদরে গ্রহণ করেছে । কিন্তু এই বাসিন্দারা কারা ? কায়াহীন ছায়া তারা নয় । তাহলে সুজিত তাদের অস্তিত্ব বুঝতে পারত । বাড়িটাতে প্রথমদিন ঘোরার সময় সুজিতের মনে হয়েছিল, বাড়ির প্রতিটি কোণায় যেন কিরকম বিষণ্ণতার ছাপ । কিন্তু সেই বিষণ্ণতা অনেকটাই যেন কেটে গিয়েছে তার হাঁটাচলায়, তার কথাবার্তায়, তার ভাবনাচিন্তায় । বরং বেশ একটা সতেজ একটা ভাব এসেছে বাড়িটায় । সুজিতের দারুণ লাগছে এসব । তার আফসোস আগে কেন সে এ বাড়িতে আসেনি ।
দুখিরাম বাবুর পরিবর্তন লক্ষ করেছে ভালোই । কিন্তু সে একটু অবাক বাবুর পরিবর্তনের ধরন দেখে । কেমন একটা অন্যমনস্ক ঘোরে থাকেন ঠিকই তবে বেশ আনন্দেই থাকেন সেটা বোঝা যায় । এর মধ্যে আনন্দের কি আছে অবশ্য সে জানে না । মস্তিষ্কবিকৃতি হলে অবশ্য আলাদা কথা । সেটা মনে হয় হয়নি ।



সুজিত বুঝেছে, এ বাড়ির বাসিন্দারা যতই তাকে গ্রহণ করুক না কেন, তারা ধরা দিতে চান না । সুজিত ও চায় না তারা ধরা দিক । এ যেন এক লুকোচুরি খেলা । তারা আছে, অথচ নেই । সুজিতের খুব ভালো লাগছে এসব । তার লেখা হচ্ছেই না বলতে গেলে । প্রথম দিন যা একটু লিখেছিল । তাও সেটা শুধু বাড়ির বিবরণ মানে জাকে লে-আউট বলে আর কি ! ব্যস, এর বেশি আর কিছু লিখতে পারেনি সে । তার জন্য তার অবশ্য কোনও আক্ষেপ নেই ।
রাত নটা । বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক । একটানা, অবিরাম । সুজিত সেদিনও চুপচাপ বসেছিল । মোমবাতি টা জ্বলছিল । সেটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল । হঠাৎ সেদিনকার মত কে যেন আবার ডাকল, “কুমাআআআআর” । সেই একই সুর । একই রকম ডাকার ধরন । তবে সেদিন একবার ডেকে চুপ করে গিয়েছিল । আজ অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে কেউ । ডাকটা অনেকটা সেইরকম যেমন ভাবে স্নেহময়ী মা তার আদরের ছেলেকে ডাকেন ।
সুজিত উঠে দাঁড়াল । কার উদ্দেশ্যে যেন বলল, “আসছি” । তারপর হেঁটে চলল বারান্দা ধরে ডাকটার উৎস লক্ষ্য করে । সুজিত হাঁটছে । অনেকদিনের জ্বালাযন্ত্রণা যেন ঘুচিয়ে দিচ্ছে সে । তার প্রতিটা পদক্ষেপ যেন জাদুকাঠির ছোঁয়া । জেগে উঠছে চার যুগ আগে ইতিহাস হয়ে যাওয়া মিত্রবাড়ি । সুজিত হেঁটে গিয়ে থামল একদম শেষের ঘরটায় । এই ঘরে তার ঢোকা উচিৎ । তাকে চাইছে এই ঘরের বাসিন্দারা । সুজিত দরজা খুলল...



বাজারের মুখটায় দেখা হল স্থানীয় একজন সত্তরোর্ধব মানুষ, অবনীশ চৌধুরীর সঙ্গে । আসার দিন চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়ার সময় এনার সাথে আলাপ হয়েছিল সুজিতের । স্থানীয় ইতিহাস ভালোই জানেন বলে এনার সাথে পরে যোগাযোগ করবে বলেছিল সুজিত । আজকে সুজিতকে দেখে তিনি বললেন, “সেকি, এর মধ্যেই চললেন নাকি ?”
সুজিত বলল, “হ্যাঁ” ।
অবনীশ বাবু বললেন, “আপনার কাজ এর মধ্যে হয়ে গেল ? ওই মিত্রবাড়ির কাজ ?”
সুজিত বলল, “হ্যাঁ, তা বলতে পারেন হয়ে গেল” ।
-“কে এত তথ্য দিল আপনাকে ? এখানে এক আমি ছাড়া আর তো কেউ সেরকম এখানকার সম্বন্ধে সেরকম কিছু জানে বলে মনে হয় না । দাঁড়ান, আপনি কি হালদার কাকার কাছে গিয়েছিলেন তথ্যের সংগ্রহে । ওনার নব্বইয়ের ওপর বয়স । উনি অনেক কিছু জানতে পারেন । কিন্তু আমি তো যদ্দুর জানি, তাঁর কথাবার্তা বলার সেরকম জোর নেই” ।
সুজিতের বিরক্তিকর লাগছিল । সে বলল, “আজ্ঞে না মশাই । হালদার বাবুকে আমি চিনি না । আমি কারও কাছে যাইনি । আমার কাজ সত্যিই হয়ে গেছে । এবং সেটা হতে সাহায্য করেছে কুমারজিৎ মিত্র । যাই হোক, আমি চলি । আমার ট্রেন মিস হয়ে যাবে” ।
নামটা শুনে চমকে উঠলেন অবনীশ বাবু । স্মৃতি ঝলক দিয়ে গেল সামান্য । সেটা সত্তর সাল । নকশাল আন্দোলন, ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধ এরকম সরগরম পরিস্থিতির মধ্যে নিমতায় ঘটে গেলেই হাড় হিম করা ঘটনা । মাঝরাত্তিরে মাত্র দু ঘণ্টায় ৫২ জনের একান্নবর্তী জমজমাট মিত্র পরিবার পরিণত হল শ্মশানে । কাদের ষড়যন্ত্রে আগুন লাগানো হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি । সে মামলার নিষ্পত্তি আজও ঘটেনি, ঘটবেও না । হবি তো হ, সেদিন-ই ছিল মিত্রবাড়ির সবচেয়ে খুদে সদস্য কুমারজিতের দু বছরের জন্মতিথি । সারাদিন উৎসব চলেছিল বাড়িতে । সন্ধেবেলা হাজার অতিথির আগমন, কাঙালি ভোজন । মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও যে মানুষগুলো মেতে উঠেছিল আনন্দে সকালে তাদের দগ্ধানো লাশ বের করে পুলিশ । তবে দু বছরের কোনও বাচ্ছার লাশ পুলিশ খুঁজে পায়নি । কুমারজিৎ কে নিয়ে পালিয়ে যায় তার ধাইমা এরকম একটা রটনা হয়েছিল তখন । তারপর চার দশক কেটে গেছে, এসব খবর আর তত প্রাসঙ্গিক ছিল না । সেই কুমারজিৎ সাহায্য করেছে কলকাতা থেকে আসা একজন সাংবাদিককে ? হঠাৎ ছোট হয়ে আসা সুজিতের গমনরত শরীরটাকে দেখতে একটু এগিয়ে গেলেন অবনীশ বাবু । হাঁটাটা কি একদম অবিকল তাঁর একসময়কার দাবার সঙ্গী, কুমারজিতের বাবা সমরজিতের মত নয় ?