দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতে পারে । দুষ্টু হিসেবে রাব্বির দ্বিতীয়টি আর নেই ।
ছোট্টবেলা থেকে তার দুষ্টামির মাত্রাটা অনেক বেশী থাকায় , তার
নামডাক দুষ্ট রাব্বি নামেই পরিচিত ছিল । আর মেয়েদের
কাছে তো একেবার শয়তান পোলা । মেয়েদের একমাত্র ভয়ের কারণও সে ।
যখন রাস্তা দিয়ে তারা স্কুলে যেত, কখনো রাস্তার
পাশে লুকিয়ে থেকে ডিল ছোড়া ! আবার কখনো গাছের পাতার
আড়ালে থেকে ফল খেয়ে তার কিছু অংশ দিয়ে ডিল ছোড়ে মারা ।
এটা ছিল তার দুষ্টামির কিছু বৈশিষ্টের মধ্যে একটি । আর বিকেল
হতেই কয়েকটা বন্ধুকে নিয়ে পাশের গ্রামের কিছু মানুষকে জ্বালানোর
উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া । হয়ত কারোও গাছের ফল চুরি, আবার কোন
মানুষকে কথার দ্বারা পাগল করে দেওয়া । এ কারণে পাশের
গ্রামেও দুষ্টু হিসেবে তার খ্যতি কম ছিলনা । আর প্রতিদিন বাড়ি ফিরতেই
দেখত একগাধা বিচারের নালিশ নিয়ে বিচার করার জন্য বসে থাকত তার বাবা ।
ছেলেটার একটা ভাল অভ্যাস ছিল, সে কখনো মিথ্যা বলতোনা । তাই
সে মিথ্যে গাজাখুরী গল্প বানিয়ে বলতে পারতোনা, এর জন্যই
মারও খেতে হতো বাবার হাতে । প্রতিরাতে এভাবে প্রহার করার পর,
তার বাবা ভাবত ছেলেটা বুঝি এবার ভাল হয়েই যাবে । কিন্তু সকাল হতেই
দেখা যেত দুষ্টু রাব্বি খেতাবেই । একদিন তার
বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য নিয়ে যায় । কিন্তু স্যারদের কাছেও
তার নামডাক পরিচিত ছিল বলে অনেক
স্যারেরা ভর্তি করাতে প্রথমে রাজি হয়নি । এক স্যারের
অনুরোধে তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয় ।
তার পর থেকে প্রতিদিন স্কুলে যেত । স্কুলের পড়াও সে সহজে শিখতে পাড়ত ।
কিন্তু দুষ্টুমিটা একটুও কমেনি । আয়তন টা কিছুটা কমেছিল তখন । আগে যেহেতু
সারা গ্রামটাকে জ্বালাতো, এখন সে স্কুলটাকেই পুড়ায় । যার জন্য
স্যারদের হাতে অনেক মারও খেতে হত তাকে ।
কিন্তু পড়ালেখায় ভাল থাকার কারনে স্যারেরা তাকে নিয়ে ভাল
কিছু আশাও করত । আর বাবা তো খুশীই কারন ছেলেটার নামে আর কোন বিচার আসেনা । এইভাবেই তার কেটে যায় প্রাথমিক ও
মাধ্যমিক লেখাপড়া । মাধ্যমিকে অবশ্য বাবার মুখ সন্তুষ্ট করার মতই
একটা রেজাল্টও করেছিল সে । মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে তার ফুফুর
বাড়িতে বেড়াতে যায় সে । সেখানে তার সম
বয়সী একটা ফুফাতো ভাই থাকায় দিনকাল ভালই কাটছিল তার । একদিন
সে ফুফাতো ভাইয়ের সাথে তার স্কুলে যায় । ক্লাস শেষে স্কুলের
মাঠটায় যখন আড্ডা দিতেছিল তখন একটা মেয়েকে দেখে তার ভাল
লেগে যায় । মেয়েটার নাম স্বর্নালী । পরিবারের একমাত্র আদরের মেয়ে ।
বাবা মা আর দুইভাই নিয়ে তার পরিবার । খুব সুখের পরিবার , তাই
স্বর্ণালীর কোন কিছুরই অভাব হতনা । চাওয়া মাত্রই পূরণ করে দিত তার
বাবা । আর স্বর্ণালী রাব্বির ফুফাতো ভাইয়ের
সহপাঠী ছিল । একদিন রাব্বি তার ফুফাতো ভাইকে বলে দিল
স্বার্ণালীকে ভাল লাগার কথা । আর স্বর্ণালীকে রাজী করানোর সমস্ত দায়
ভারটাও তার হাতেই দিল । প্রথমে স্বর্ণালী রাজী ছিলনা । কিন্তু
সারাদিন তার পিছনে পড়ে থাকত ছেলেটা । অনেক দিন
এভাবে চলে যাওয়ায় স্বর্ণালী কিছুটা দুর্বল
হয়ে আসে রাব্বির প্রতি । ব্যাস তাদের প্রেমও শুরু । এক সময়ের গ্রামের সেরা দুষ্টু
ছেলেটি স্বর্ণালীর প্রেমে পড়ে একেবারে সুবোধ
বালকে পরিণত হয়ে যায় । ছেলেটা দিনরাত স্বর্ণালীর
প্রেমে বিভর হয়ে থাকত । কিছুদিন পর সে ফুফুর
বাড়ি থেকে চলে আসে । আসার সময় স্বর্ণালীকে তার বাবার ফোন
নাম্বারটা দিয়ে আসে । বাড়িতে আসার পর রাব্বিকে তার
গ্রামটা যেন এক অন্য চরিত্রেই দেখতে পায় । তার এমন সুবোধ
আচরণে গ্রামের অনেকেই অবাক হয়ে যায় । যেই
ছেলেটা সারা গ্রামটাকে মাতিয়ে রাখত, সেই ছেলেটাকে একা একা সারাদিন
একটা ডায়রী নিয়ে পড়ে থাকতে দেখলেতো অবাক হওয়ারই কথা ।
সারাদিন ডায়রীটায় কি যেন লিখত আর একটা হাসিমাখাঁ মুখ
নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ত । একদিন খুব সকালে রাব্বির বাবার
নাম্বারে একটা কল আসে । হ্যালো আসসালামামু আলাইকুম
রাব্বি বলছেন ? না আমি তার বাবা ।
ও আংকেল রাব্বিকে একটু দেয়া যাবে ।
তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি রাব্বিকে ডাকছি ।
রাব্বি তখন বাড়ীর সামনে পুকুর পাড়ে একটা হাসিমাখা মুখ
নিয়ে একা বসে কিছু একটা লিখায় ব্যস্ত ছিল । তার বাবার ডাকে বিরক্ত
হয়েই উঠে আসে । কাছে আসতেই তার
বাবা ফোনটা বাডিয়ে দেয় । এই নে তোর ফোন । অবাক হয়েই
ফোনটা রিসিভ করে রাব্বি । হ্যালো !
কেমন আছ ? কন্ঠটা শুনে বুকটা কেপে উঠল রাব্বির ।
সেটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত গুলোর মধ্যে তার জন্য একটি মুহুর্ত ।
স্বর্ণালীর ফোন । ভাল আছি তুমি কেমন ?
ভাল আর শুন এই নাম্বারটা আমার । বাবা আমাকে একটা ফোন
কিনে দিয়েছে । আরো কয়েকটা কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়
স্বর্ণালী । সেদিনটা রাব্বির খুব আনন্দেই কাটে । রাতে বাবার
কাছে আবদার করে বসে একটা ফোন কিনে দেওয়ার জন্য ।
কিন্তু প্রথমে রাজী না হলেও বার বার করে বলার
কারনে পরবর্তীতে একটা ফোন কিনে দেয় ।
ফোনটা পাওয়ার পর প্রথমেই স্বর্ণালীকে ফোন করে । তার পর
থেকেই রাব্বি আর স্বর্ণালীর প্রেমটা নতুন মাত্রা পায় । যখনি মন চায়
ফোন দিয়ে কথা বলা । হাসি আর
গল্পে সব সময় মাতিয়ে থাকত তাদের মন ।
উচ্চ মাধ্যমিকে রাব্বি শহরের একটা কলেজে ভর্তি হয় । স্বার্ণালীও
একই শহরের একটা পলিটেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় । সেই সুবাধে তাদের
প্রেমটা আরো জমে উঠে । প্রতিদিন চাইলে দেখা করতে পারত ।
এভাবে তাদের জীবন ভালোই কেটে যাচ্ছি ল । একটুখানি দেখা আর
ছোট্ট অভিমানে তাদের প্রেমটাও পূর্নতা পেয়ছিল । এভাবে উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষা চলে আসে রাব্বির । পরীক্ষার আগে স্বর্ণালী রাব্বির
পড়ালেখা ভাটা দেখে নিজের ফোনটা বন্ধ করে রাখে । রাব্বিও জানত
যাতে রাব্বি একটা ভাল রেজাল্ট করতে পারে । তার জন্যই ফোনটা অফ
রাখে স্বর্ণালী । রাব্বিও পড়ালেখাটা ভাল করেই
চালিয়ে যেতে লাগল । পড়ার ফাকে যখন স্বর্ণালীকে মনে পড়ত, তখন
আকাশের শুকতারাটার দিকে তাকিয়ে থাকত ।
শুকতারাটা যদি মেঘের আড়ালে ডাকা পড়ত, তখন এই
ভেবে স্বান্তনা পেত যেন এক আকাশের নিচেই তারা আছে ।
দেখতে দেখতে রাব্বির পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যায় ।
পরিক্ষাটা ভালও হয় তার । পরিক্ষার পর রাব্বি আর স্বর্ণালীকে শহরের বিভিন্ন
স্তানে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যেত । কখনো দেখা যেত পার্কে, কখনো কলেজ
মাঠে, আবার কখনো পুকুর পাড়ে । তখন প্রতিটা দিন হত তাদের ভালবাসার এক
একটি মহেন্দ্রক্ষণ । কিন্তু এভাবে শহরে ঘুরাঘুরি করার
কারণে কিছু পরিচিত মানুষের নজরে এসে যায় তারা । তাদের
ভালবাসার কথা জেনে ফেলে অবিভাবকেরাও । ঈদকে সামনে রেখে দুজনই
বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে । দুজন দুজনকে গিফ্ট করে সেই ঈদে ।
একদিন সকালে দুজনই বাড়িতে চলে আসে । বাড়িতে আসার
পর স্বর্ণালীর বাবা তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় ।
এবং স্বর্ণালীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে । এদিকে স্বর্ণালীর
সাথে কথা না বলতে পারায় রাব্বির দিনকাল অসস্তিতে কাটতে লাগল ।
কোন পথ না পেয়ে তার ফুফাতো ভাইয়ের কাছে ফোন দেয়
রাব্বি । ফুফাতো ভাইটা স্বর্ণালীদের বাড়িতে যায় ।
স্বর্ণালী তাকে কেঁদে কেঁদে সবকিছু খুলে বলে । ফুফাতো ভাইয়ের
কাছে সবকিছু শুনে সেদিন রাব্বি তার ফুফোর বাড়িতে চলে আসে ।
ঈদের পর স্বর্ণালীর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যায় ।
স্বর্ণালী পাশের বাড়িতে এসে তার বান্ধবীর ফোনে রাব্বির
সাথে কথা বলে । এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে যাবে ।
ফুফাতো ভাই সবকিছুর ব্যবস্তা করে দেয় । সেদিন ছিল স্বর্ণালীর বিয়ের আগের
দিন । সন্ধ্যার সময় রাব্বির সাথে কথা বলে বাড়ি থেকে পালায়
স্বর্ণালী । পাশের গ্রামের একটা বাজারে গিয়ে রাব্বির জন্য
অপেক্ষা করতে থাকে ! পালানোর সময় তার ফোনটা বাবার কাছ চুরি করে নিয়ে আসে ।
এসেই রাব্বির সাথে কথা বলে । সে রাত ৯ টার বাসের দুইটা টিকেট কিনে রাখার কথা বলে । স্বর্ণালী দুইটা টিকেট কেটে অপেক্ষা করে তার চিরদিনের
সঙ্গীটাকে পাবার জন্য । ছোট্ট একটা ব্যাগে করে কিছু কাপড় আর
প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিয়ে দাড়িয়ে থাকে স্বর্ণালী ।
প্রতিটা মিনিট যায় স্বর্ণালীর ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে ।আর
ভেসে উঠতে ভালবাসার প্রতিটি সুখের মুহুর্তের । কিছুক্ষণ পর তার
চার বছরের প্রেমটা পূর্নতা পাবে । ঘড়িটায় ঘন্টার কাঠাটা প্রায় নয়টায়
পৌছেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত রাব্বির কোন খবর নেই । এরই মধ্যে বাসের হুইসেল
বাজতে লাগল । স্বর্ণালীর চোঁখে খুব অভিমানে পানি জমতে শুরু করে ।
রাব্বি এমনটা করছে কেন ? ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে ।
বাসের হেলপার সব পেসেন্জারদের ডেকে বাসে উঠাল ।
ধীরে ধীরে বাসটা এগোতে লাগল , স্বর্ণালীর চোঁখ
দিয়ে অজরে পানি ঝরতে লাগল । কিন্তু বাসটায় উঠার সাহস পেলনা । পিছন
থেক কে যেন স্বর্ণালীর মাথায় ঠোকা দেয় । পেছন থেকে একটা কন্ঠ
বেরিয়ে আসে.. কি বাসে উঠবেনা । পেছনে ফিরে স্বর্ণালীর মলিন
মুখটা মুহুর্তের মধ্যে একটা এভারেস্ট জয়ী কোন মানুষের মুখের মত পরিণত
হয়ে যায় । একটা মুচকি হাসি দিয়ে নব জীবন
সঙ্গিটিকে জড়িয়ে ধরল স্বর্ণালী । দেরি করলে কেন ?
কেন ? খুব কষ্ট হয়েছিল ? নিরবে মাথা নাড়ায় স্বর্ণালী ।
সারা জীবন সুখের জন্য এটুকু কি বেশী কষ্ট হয়ে গেল ?
তাহলে কি ইচ্ছে করেই এমনটা করলে ? হুম ! দু জনের মুখেই হাসি ।
উঠে গেল বাসটায় । জীবনের বাসটা তাদের
নিয়ে চলছে অজানা কোন গন্তব্যে ।