১.
নাহ ! সমস্যা কোথায়? কেন হচ্ছে না, কেন? ধ্যাত! নিজের উপর চরম বিরক্ত হয় সে।
"শান্ত হও সিরাস, শান্ত হও, তুমি সমাধানের খুব কাছে দিয়ে ঘুরাঘুরি করছো, এই সময় অধৈর্য হলে হবে না, "তুমি যদি না পার তাহলে আর কেউই পারবে না" নিজেকে নিজে এভাবেই প্রবোধ দিতে থাকেন মহামান্য নিহেতা সিরাস। কিন্তু আর কত? রাতের পর রাত না ঘুমানোর ক্লান্তি এবার চরমে এসে ঠেকেছে আর তার বিস্ফোরণ ঘটে অকস্মাৎ; ভেঙ্গে যায় সব নিয়ন্ত্রণের বাধ; বিপুল আক্রোশে রাইটিং স্ক্রিনের উপর এলোপাথাড়ি হাত চালিয়ে গত কয়েক দিনের অমানুষিক পরিশ্রম করে দাড় করানো চিত্র, সমীকরণ আর লেখা এক ঝটকায় মুছে বিছার উপর ধপ করে বসে পড়ে সিরাস।
চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসে ক্যাথেরীনা। খুব সন্তর্পণে সিরাসের পাশে বসে, আলতো করে কোলের উপর টেনে নেয় তার এলিয়ে দেওয়া মাথাটা। সিরাসের এমন আচরণের সাথে ভালো করেই পরিচিত সে। খুব যত্ন করে চুলের ভিতর আঙ্গুল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করে, "ইদানীং কি হয়েছে তোমার, এত অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছো যে?"
চুলে ক্যাথির হাত পড়তেই একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায় সিরাস, সব অবসাদ, ক্লান্তি আর ক্ষোভ মুহূর্তেই কোথায় উবে যায়! বিড়ালের মত আহ্লাদে গুটিসুটি মেরে যায় একেবারে, একটু লজ্জাও পায় নিজের ছেলেমানুষি আচরণের জন্য, হাত পা গুটিয়ে তার কোলে মাথাটা আর একটু এলিয়ে দিয়ে বলে, "হচ্ছে না কেন?"
- পারবে, তুমিই পারবে। একটু ধৈর্য ধর, তুমি পারবেই।
জানি পারবো; চোখ বন্ধ করলেই সম্পূর্ণ মডেলটা জলজ্যান্ত ভেসে উঠে, কিন্তু কোন ভাবেই ধারণ করতে পারছি না, আর ধারণ না করতে পারলে সমীকরণেও প্রকাশ করা যায় না, কষ্টটা এমন যে কাউকে বোঝাতেও পারছি না।
- তুমি সবসময় একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে চিন্তা কর তাই অনেক সহজ জিনিসও পেঁচিয়ে ফেল। এক কাজ কর; তুমি সহজ ভাষায় আমাকে বোঝানোর চেষ্টা কর, দেখবে বুঝানোর সময় চিন্তার অনেক জট খুলে যাবে, নতুন খোরাক পাবে ভাববার আর এতে আমি কিছু না বুঝলেও তোমার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সিরাসের চোখের তারা ধপ করে জ্বলে উঠে ক্যাথির এই প্রস্তাব শুনে; মনে মনে আসলে এটাই চেয়েছিল সে। লেকচার দেওয়ার সুযোগ পেয়ে এক লাফে বিছানার উপর উঠে বসে, অপার্থিব এক প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয় তার মাঝে মুহূর্তেই। বিছানার উপর টেনে নিয়ে আসে রাইটিং স্ক্রিন। আঙ্গুলকে কলমের মত ব্যবহার করে দ্রুত কিছু ছবি আঁকে স্ক্রিনের উপরে, তারপর বিপুল উৎসাহে শুরু হয় তার লেকচার।
“মনে কর এটা সিরাস কণিকা, এই সিরাস কণিকাই হলো স্ট্রিং-থিউরির স্ট্রিং এর একক। প্রথমদিকে বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিলো স্ট্রিংই হলো পরমাণুর ক্ষুদ্রতম একক আর, পরে দেখা যায় যে ৯ টি এক মাত্রার সিরাস কণিকা মিলে গঠন করে একটি দুই মাত্রার স্ট্রিং………”
আপাত গুরুত্বপূর্ণ লেকচারের ফাঁকে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায় ক্যাথেরীনা, কোন কথাই কানে যায় না তার, সিরাসের চোখে তাকিয়ে থেকে চলে যায় আঠার বছর অতীতের সেই ইউনিভার্সিটির জীবনে। ঈশ! সেই চোখ আর এই চোখ! একদম বদলায়নি এত বছরেও! প্রথম যেদিন ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় সিরাসের চোখে চোখ পড়েছিলো ক্যাথির, সেদিনই ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিলো কোন এক অপার্থিব সুখানুভূতিতে; মনে হয়েছিলো এই চোখে তাকিয়ে থাকা যায় হাজার বছর; নিষ্পলক। আচ্ছা, সিরাস কি এখনো আমাকে আগের মতই ভালোবাসে? কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে; আমি নাকি তার গবেষণা? ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সিরাস কি সব একক মাত্রার কণিকা আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ ফেলে দেয়; তারপর থেকে চারদিকে কণিকা পদার্থ বিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সে শুধু তারই নামডাক। সেই থেকে শুরু, তারপর শুধু সাফল্যের ইতিহাস; একের পর এক পুরস্কার, খেতাব, তার নামে সেই কণিকার নামকরণ; সবশেষে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিলের আজীবন সদস্য পদ, আরও কত কি! তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে যায় সে, সারাক্ষণ শুধু গবেষণা, ল্যাব, সেমিনার এইসব হাবিজাবি, ধ্যাত!
যদিও তাকে কোনদিন অবজ্ঞা অবহেলা করেনি সে, যেখানে যে সেমিনারে গিয়েছে তাকে নিয়ে গেছে, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে “ক্যাথেরীনা, মাই ওয়ান এন্ড ওনলি, ক্যাথি; দ্যা অনলি থিং ম্যাটার ইন মাই লাইফ ইজ সী, ক্যাথি নেই তো এই সিরাসও নেই”। যতবার ক্যাথেরীনাকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সিরাস, ততবার চোখ ভিজে ভিজে এসেছে তার। অনেক কষ্টে ছলছল চোখকে নিয়ন্ত্রণ করতো সে। কতদিন আড়ালে আবডালে চোখ মুছেছে আনন্দে!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় ক্যাথেরীনা তখন হঠাৎ সিরাস বলে, “তুমি কি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছো না?
- একটু চমকে উঠে মুহূর্তেই সামলে নিয়ে বলে, “নাহঃ ! শুনছি তো ! তুমি বলে যাও”
ক্যাথির শুনা বা না শুনা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই সিরাসের, শুধু লেকচার দিয়ে যেতে পারলেই খুশি সে। আবার শুরু করে সে, “………ত্রিমাত্রিক সমীকরণের সাহায্যে ‘সিরাস-কণিকাগুলোর’ অবস্থান ত্রিমাত্রিক জগতে খুব সহজেই বের করতে পারার কথা কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তা কিছুতেই করা যাচ্ছে না। তবে সময়কে যদি মাত্রার চতুর্থ একক ধরে চতুর্মাত্রিক সমীকরণের মাধ্যমে এর অবস্থান বের করার চেষ্টা করি সেক্ষেত্রে মাঝে মাঝে বের করা যাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে যাচ্ছে না। কিন্তু যদি পঞ্চ-মাত্রিক সমীকরণের প্রয়োগ করি তাহলে নিখুঁতভাবে এর অবস্থান বের করা যাচ্ছে, আর এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা"
- তাহলে পঞ্চ-মাত্রিক সূত্র খাটিয়েই এর অবস্থান বের করে ফেল, সমস্যা কোথায়?
মুচকি একটু হাসে সিরাস, যেন সে এমন বোকার মত প্রশ্নই আশা করছিলো। তার মানে বুঝতে পারছো? তার মানে হলো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে, কারণ আমারা বাস করছি ত্রিমাত্রিক বিশ্বে, আর সময়কে একটা মাত্রা ধরলে দাঁড়ায় চৌ-মাত্রা, এটা কোনভাবেই পঞ্চমাত্রার হতে পারে না। আর যদি ধরেও নেই আমাদের ধারনার বাইরে আরও মাত্রা আছে তাহলে সেটা হবে সপ্তমাত্রা, কখনো পঞ্চমাত্রা নয়।
- কেন? শুধু সপ্তমাত্রাই হতে হবে কেন? পঞ্চমাত্রা কেন হতে পারবে না?
আমাদের তিনটি মাত্রা হচ্ছে, ‘দৈর্ঘ্য’, প্রস্থ আর ‘উচ্চতা’ আর একটি হচ্ছে ‘সময়’। সময় যেহেতু একদিকে প্রবহমান সেহেতু এটা কোন ভাবেই দ্বিমাত্রিক হতে পারে না। এখন যদি ধরে নেই দৈর্ঘ্যের নিজস্ব দুটি মাত্রা আছে তাহলে মোট মাত্রা হলো পাঁচটি, দুটি দৈর্ঘ্য, একটি প্রস্থ, একটি উচ্চতা আর একটি সময়। কিন্তু দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা মূলত একই জিনিস, শুধু বস্তুকে ঘুরিয়ে দিলেই দৈর্ঘ্য হয়ে যাবে প্রস্থ অথবা উচ্চতা। তাই দৈর্ঘ্য যদি দ্বিমাত্রিক হয় সাথে সাথে প্রস্থ ও উচ্চতাও দ্বিমাত্রিক হবে। সুতরাং দুটি দৈর্ঘ্য, দুটি প্রস্থ, দুটি উচ্চতা আর একটি সময় নিয়ে আমাদের বিশ্ব হবে সপ্ত-মাত্রিক (সেভেন্থ-ডাইমেনশনাল)। তাই আমরা হয় চৌ-মাত্রিক অথবা সপ্ত-মাত্রিক বিশ্বে বাস করছি, কিন্তু কোনভাবেই পঞ্চ-মাত্রিক বিশ্বে নয়।
- ঈশ! ভালো সমস্যা পাকিয়েছ তো! তবে ঈশ্বর সহায় হলে তুমি খুব তাড়াতাড়ি এর সমাধান পেয়ে যাবে, আমি তোমার জন্য মনে প্রাণে প্রার্থনা করবো।”, কণ্ঠে আন্তরিকতা ঝরে পড়ে ক্যাথির।
“উফ! এই মেয়েটি যে কেন এখনো সেই মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণা নিয়ে আছে। আজকালকার দিনে কেউ ঈশ্বর-টিশ্বর বিশ্বাস করে না কি?”, বিরক্ত ভাবটা যথাসম্ভব চেপে রেখে বলে, “তোমার ঈশ্বর কখনোই আমার সহায় হবেন না। অতীতে আমরা প্রকৃতির কাছে অসহায় ছিলাম বলে ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতাম আর উনি নানা কেরামতি দেখিয়ে আমাদের মন জয় করতেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতিকে প্রায় জয় করে এনেছে তাই ঈশ্বর মহাশয় আজ বেকার, তবে উনাকে সম্মান করে মুকুটহীন সম্রাট বলা যেতে পারে”, বলেই বামচোখটা একটু টিপ দিয়ে ঠোঁটে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ক্যাথির দিকে তাকায় সিরাস।
ছিঃ! সিরাস ছিঃ! এভাবে বলে না। ঈশ্বরের কাছে অতীত বর্তমান বলে কিছু নেই, উনি সময়ের ঊর্ধ্বে, উনাকে নিয়ে এভাবে কথা বলা তোমার একদম ঠিক না, একদম না! আমি তোমার কথায় অনেক বিরক্ত হয়েছি, অনেক বিরক্ত! বলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রান্না ঘরে চলে যায় ক্যাথেরীনা।
২.
“ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে”, “ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে” কিছুতেই চিন্তাটা মাথা থেকে বের করতে পারছে না সিরাস, এই কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে, যেন গ্রামোফোনের পিন আটকে যাবার মত আটকে গেছে মস্তিষ্কের কোন নিউরন । উফ! মাঝে মাঝে ক্যাথিটা এমন বোকার মত কথা বলে না! এখন আর কোন কাজই করা যাবে না। চরম বিরক্ত ভাব নিয়ে বিছানায় গেলো সিরাস, শরীর চরম ক্লান্ত, মনটাও বিক্ষিপ্ত, আর অবচেতন মনে আটকে আছে, “ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে”, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। ঘুমের মধ্যেই আবছা আবছা মনে হলো, কে যেন গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে গেলো আর কপালে হালকা চুমুও দিয়ে গেলো একটা।
“ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে”, “ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে” কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করছে, ভয়ানক চমকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে যায় সিরাসের, ঘেমে একাকার অবস্থা, পাশে তাকিয়ে দেখে গভীর ঘুমে অচেতন ক্যাথি, কিছুক্ষণ সময় নেয় সিরাস ধাতস্থ হতে; সন্তর্পণে বিছানায় উঠে বসে। ধীর ধীরে রাইটিং স্ক্রিনটার দিকে এগিয়ে যায়, কাঁপা কাঁপা হাতে পাওয়ার অন করে স্ক্রিনটার। খুব দ্রুতবেগে কি সব লিখে যায় আঙ্গুলের ছোঁয়ায় রাইটিং-স্ক্রিনে। আশেপাশে কোন খেয়াল নেই তার, একের পর এক সমীকরণ লিখে যাচ্ছে, একের পর এক চিত্র এঁকে যাচ্ছে, যেন চাবি দেওয়া কোন রোবট; অভিব্যক্তি হিসাবে মুখের কঠোর ভাবটা কঠোরতর হচ্ছে আর চোখের জ্বলজ্বল ভাবটা আরও উজ্বলতর হচ্ছে।
গতকাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তাই দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে ক্যাথির। উঠেই দেখে সিরাস রাইটিং-স্ক্রিনে ভাবলেশহীন ভাবে লিখে যাচ্ছে তো লিখেই যাচ্ছে। বিরক্ত না করে মুখ হাত ধুয়ে টেবিলে নাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে, তারপর একাই খেয়ে নেয়। রাইটিং-স্ক্রিনে তখনো লিখে যাচ্ছে সিরাস, ক্রমাগত। সিরাসের পাশে এসে বসে ক্যাথি, রাইটিং-স্ক্রিনে লেখা সমীকরণ, চিত্রগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই তার বুঝে আসে না, শুধু অবাক হয়ে সিরাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, “আমি তোমাকে এত ভালোবাসি কেন? আচ্ছা, তোমার ভালোবাসাও কি আমার মতই তীব্র? তোমার পাশে আমি এসে বসলাম আর তুমি একবারও তাকিয়ে দেখলে না?” হালকা ঈর্ষা অনুভব করতে থাকে সে রাইটিং-স্ক্রিনটার উপর, “ঈশ, যদি এই স্ক্রিনটা হতাম আমাকে দিনে কতবার ছুঁয়ে দেখতে তুমি?”
হঠাৎ লেখা থামিয়ে ক্যাথির দিকে তাকায় সিরাস, কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি! যেন ক্যাথির ভিতর দিয়ে অনেক দুরের কোথাও তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “আমি সমাধান পেয়ে গেছি, ক্যাথি; আমি সমাধান পেয়ে গেছি।”
৩.
মিঘুয়েল কোস্ত্রা, বিজ্ঞান কাউন্সিলের মহাপরিচালক, বয়স হলেও চোখে তীক্ষ্ণতা একচুল কমেনি, ভ্রু কুচকে মহা-বিরক্ত নিয়ে সিরাসের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। বিজ্ঞানী সিরাসকে তিনি অসম্ভব পছন্দ করলেও হাবভাবে কখনো তা প্রকাশ করেন না, পাছে তার দুর্বলতা সবার সামনে ধরা পড়ে যায়। দুই বছর আগে সিরাস নিজের মত করে কাজ করার অজুহাতে বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেও মহামান্য কোস্ত্রার নির্দেশে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রেখেছে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই বিজ্ঞানীকে কোনভাবেই চোখের আড়াল করতে নারাজ বিজ্ঞান কাউন্সিলের এই মহাপরিচালক। বলা নেই কওয়া নেই গতরাতে হঠাৎ সিরাস ফোন করে যখন বললও আজ সকালে যেন জরুরী ভিক্তিতে কাউন্সিল মিটিং ডাকা হয়, তখনই তিনি বুঝতে পেরেছেন এই পাগল কোন এলাহীকান্ড ঘটিয়েছে আবার।
- উত্তেজনা ঢাকতে না পেয়ে উনি প্রায় চিৎকার করেই বলে উঠলেন, “মহামতি সিরাস, আপনি বলতে চাচ্ছেন প্যারালাল বিশ্ব অস্তিত্বমান?”
স্যার, সাইন্স-ফিকশন মুভিগুলোতে যেভাবে প্যারালাল বিশ্ব দেখা যায় ঠিক সে রকম প্যারালাল বিশ্ব বললে ভুল হবে। বলতে পারেন সময়ের অন্য স্তরে অন্য বিশ্বগুলো বিদ্যমান।
- একটু সহজে ও সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করবেন কি, প্লিজ?
“আসলে আমরা এতদিন ধরে নিয়েছিলাম সময় একদিকে প্রবহমান, অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, এই ধারনা ভুল ছিলো। আমি প্রমাণ পেয়েছি, সময় নিজেই আসলে দ্বিমাত্রিক। একটা মাত্রা আমরা অনুভব করতে পারছি, যেটা অতীত থেকে ভবিষ্যতে ধাবিত হচ্ছে এটা অনুভূমিক, আর একটা মাত্রা এর লম্ব বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। যেমন ধরুন, আমি এই ভবন এর বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাই তাহলে যে গতিপথ হবে সেটাকে যদি অনুভূমিক ধরি তাহলে আমার ঠিক নিচের তলা দিয়ে যে লোকটি হেঁটে যাচ্ছে তার গতিপথও অনুভূমিক তবে সে আমার সাথে একটা নির্দিষ্ট লম্ব দূরত্ব রেখে হেঁটে যাচ্ছে। এভাবেই সময়ের লম্ব বরাবর অসীম সংখ্যক বিশ্ব পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে। আর সিরাস কণিকাগুলো পঞ্চমাত্রার এই বিশ্বে অসীম সংখ্যক চৌ-মাত্রিক জগতে প্রতিনিয়ত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে” এতটুকু বলেই থামলও সিরাস।
ঘরের মধ্যে সবাই রীতিমত ঘামছে, কারও মুখে কোন কথা নেই, নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের, কিন্তু কিছুই করার নেই, সমীকরণতো আর মিথ্যা বলবে না! তাদের সামনে সিরাস চিত্রসহ সব প্রমাণ পেশ করেছে। অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন মহামান্য কোস্ত্রা, “মহামতি সিরাস, এখন আপনার পরামর্শ কি, আপনি কি করতে চান?”
আমার পরামর্শ হলো, এখন এই থিউরির যথার্থতা শুধু মাত্র এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমেই প্রমাণ করা সম্ভব, তাই এই আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাসম্ভব দ্রুত এক্সপেরিমেন্টের ব্যবস্হা করা দরকার।
মহামান্য কোস্ত্রা আবিষ্কারের গুরুত্ব ঠিকমতই অনুধাবন করতে পারছেন, বছর তিনেক পর তিনি অবসরে যাচ্ছেন, জীবনের শেষ সময়ে এসে এমন কোন এক কালজয়ী এক্সপেরিমেন্টের সাথে যুক্ত হতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু বিশাল ব্যয়বহুল এই এক্সপেরিমেন্টের জন্য বাজেট পাওয়া যাবে কি না সেটা ভেবে উনি একটু উদ্বিগ্ন। শেষে বললেন, “আমি আমার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো এই এক্সপেরিমেন্ট চালানোর জন্য”।
মহামান্য কোস্ত্রার অসাধ্য কিছুই নেই, উনার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টার আশ্বাস পাওয়া মানে শতভাগ নিশ্চয়তা। মৃদু হেসে সিরাস বললো, “মহামান্য কোস্ত্রা, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ”
৪.
জান, আমাদের এক্সপেরিমেন্টের সবকিছু প্রায় গুছিয়ে এনেছি, আশা করছি আগামী মাসের প্রথম দিকে চালু করতে পারবো। সে এক বিশাল ব্যাপার স্যাপার!
- হুমম!
কিভাবে দেখতে দেখতে দুইটা বছর চলে গেলো, তাই না?
- হুমম।
ভাবছি তোমাকে একদিন আমাদের ল্যাবে নিয়া যাব, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না! মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর ব্যয়বহুল এক্সপেরিমেন্ট এটা।
- আচ্ছা?
এই প্রথম আমরা কৃত্রিমভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উৎপন্ন করবো, প্রায় প্ল্যাঙ্ক টেম্পারেচারের অর্ধেক। স্টিফেনিয়ামকে এই তাপমাত্রায় উত্তেজিত করে অসীম সংখ্যক সিরাস কণিকা নির্গত করা হবে, তারপর এই সিরাস কণিকাগুলোকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রে টেনে এনে একটা টিউবের চারপাশে ছেড়ে দিয়ে তড়িৎ-চুম্বক বন্ধ করে দিলেই ঐ সিরাস কণিকাগুলো টিউবটিকে সহ সময়ের অন্য এক মাত্রায় চলে যাবে।
- ও, আচ্ছা।
টিউবের ভিতরে আমরা একজন মানুষকে পাঠাবো। চিন্তা করতে পারো পৃথিবীর প্রথম সেই মানুষ যে সময়ের ভিন্ন স্তরে ভিন্ন বিশ্বে পরিভ্রমণ করবে! কত ভাগ্যবান সেই ব্যক্তি! ও, আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি, এই ভ্রমণের নাম রাখা হয়েছে আমার নামে “সিরাস ভ্রমণ”। ইতিহাসের এই প্রথম কোন ভ্রমণের নামকরণ করা হয়েছে কোন বিজ্ঞানীর নামে।
- ভালো।
তুমি কি কোন কারণে আমার উপর বিরক্ত?
- না বিরক্ত না, তুমি কথা পেঁচাচ্ছ কেন? যে কথা বলার জন্য এতক্ষণ ঘুরঘুর করছ সেটা বলে দিলেই তো হয়, ভয় পাচ্ছ কেন?
একটু থতমত খেয়ে যায় সিরাস, সামলে নিয়ে বলে, আসলে এই ভ্রমণে আমি নিজেই যাচ্ছি। বলেই চুপ মেরে যায় সে, ক্যাথিও চুপ; কোন কথা নেই কারো মুখে। শেষে সিরাসই নীরবতা ভেঙে বলে, “অনেক ভেবে দেখলাম, ভ্রমণের সময় বা অন্য জগতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে, তাই এই এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে যার জ্ঞান তাত্ত্বিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে সবচেয়ে বেশি তার যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত, এত গুরুত্বপূর্ণ আর ব্যয়বহুল কোন এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে কোন রকমের রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।”
- আমি অনেক আগেই জানি তোমার এই পরিকল্পনার কথা, তোমার কম্পিউটার ঘেঁটে আমি জেনেছি। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম তুমি নিজের মুখে কবে আমাকে জানাবে। মুখ তুলে সরাসরি সিরাসের চোখে চোখ রেখে তাকায় ক্যাথি।
সিরাসের বুকটা কেঁপে উঠে মৃদু! কি দেখেছে সে ক্যাথির চোখে? ভালোবাসা? আকুতি? ঘৃণা? না কি শুধুই জল?
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাথি সিরাসের বুকে, সার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ!
কিন্তু তারতো আর ফিরে আসার উপায় নেই! তাদের দুজন মানুষের জীবনের চেয়ে এই এক্সপেরিমেন্ট মানব জাতির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সে তো চিরদিনের জন্য যাচ্ছে না, পরীক্ষা সফল হলেই সে দুইদিনের মধ্যে ফেরত আসবে। কিন্তু এই বলে কি আর ক্যাথির কান্না থামানো যাবে? কাঁদুক বেচারা, কেঁদে বুকটা একটু হালকা করুক।
৫.
আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! রক্তের মধ্যে উত্তেজনা টের পাচ্ছে সিরাস। যদিও একটু ভয় ভয় লাগছে, বেশি খারাপ লাগছে ক্যাথির জন্য, বেচারিকে অনেক জোরজবরদস্তি করেও এখানে আনতে পারেনি সে। বারবার চোখ মুছছিলো আর বলছিলো, “মনে হচ্ছে শেষ সময়ে কোন একটা ঝামেলা হবে আর তোমার মারাত্মক কোন ক্ষতি হয়ে যাবে আর চোখে সামনে আমি তা দেখতে পারবো না। তারচেয়ে আমি সারাদিন প্রার্থনা করেই কাটাই”।
আপন মনে একটু হেসে উঠলো সিরাস, “ভালোবাসার মানুষের জন্য মানুষের কতই না অযৌক্তিক উৎকণ্ঠা!”
হঠাৎ কি মনে হলো ফোনটা নিয়ে ক্যাথির নাম্বারটা ডায়েল করা শুরু করলো সে, হয়ত শেষবারের মত কথা বলে নেওয়ার জন্য, কিন্তু একজন ল্যাব ইঞ্জিনিয়ারকে তার দিকে দৌড়িয়ে আসতে দেখে ফোনটা কেটে দিলো।
- স্যার, আপনাকে মহামান্য কোস্ত্রা স্যার এক্ষণই যেতে বলেছেন।
এক্ষণই? আচ্ছা আসছি; বলেই পা বাড়ালো সিরাস, শেষবারের মত আর কথা বলা হলো না ক্যাথির সাথে।
রুমে ঢুকেই একটু থমকে দাঁড়ালো সিরাস। বিশ পঁচিশ জনের মত বিজ্ঞানী আর ডাক্তার ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে ঘরের মধ্যে, এদের প্রায় কাউকেই সে চিনে না। প্রজেক্টের নিরাপত্তার স্বার্থে উপরের পর্যায়ের চার পাঁচজন বিজ্ঞনীবাদে সবাইকে প্রতি মাসে অন্যত্র বদলি করা হয়, এরা মনে হয় নতুন ব্যাচের হবে সবাই, মনে মনে ভাবে সিরাস। মহামতি কোস্ত্রা কণ্ঠে জরুরী ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন, “কোথায় ছিলে আপনি? আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি! আমাদের সিস্টেম লঞ্চ করার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে কিছুক্ষণের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করতে হবে”
চারদিকে একবার তাকিয়ে, চেপে থাকা নিঃশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছেড়ে সিরাস বললো, “আমি প্রস্তুত, স্যার”।
মুহূর্তেই তাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে হুলস্থূল পড়ে গেলো, হাজার রকমের যন্ত্রপাতি, রিডার, স্ক্যানারে চারদিক ঘিরে ধরে তাকে, জ্ঞান হারাবার আগে শুধু মনে আছে কে যেন বলছে, “কোয়ান্টাম ঘড়িটা চালু কর ……. রেডি ওয়ান টু থ্রি স্টার্ট”। পিঁপ পিঁপ পিঁপ করে তিনটি শব্দ হয়ে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায় সিরাসের কাছে শুধু শেষ এই তিনটি শব্দ গেঁথে যায় তার মস্তিষ্কে, অবচেতন মনে শুনতে থাকে, “পিঁপ পিঁপ পিঁপ”
ল্যাবের শত শত বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা চরম উৎকণ্ঠায় পার করছে শেষের প্রতিটা মুহূর্ত! সবার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা, কয়েক মিনিট মাত্র বাকি, সবাই যার যার স্ক্রিনের সামনে মূর্তির মত বসে আছে, শুধু চোখগুলো বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে যাচ্ছে নানান রিডিং, গ্রাফ আর ডাটার উপর। মহামান্য সিরাসকে প্রায় পরম তাপমাত্রার কাছাকাছি তাপমাত্রায় শীতল করে ইন্টেনিয়ামের টিউবে রেখে তা একশ মিটার ব্যাসের একটি বৃত্তের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে আর এই বৃত্তের পরিধি বরাবর বসে আছেন সব টেকনিশিয়ানরা। ইন্টেনিয়ামের টিউবে ঠিক নিচেই ভূপৃষ্ঠের গভীরে বসানো হয়েছে অসীম সংখ্যক সিরাস কণিকা উৎপন্ন করার যন্ত্র।
সবকিছু ঠিক হতেই চিফ সাইন্টিস্ট মহামতি কোস্ত্রার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,“স্যার?”
মহামতি কোস্ত্রা আলতো করে মাথাটা উপর নিচে নেড়ে অনুমতি দিলেন। সাথে সাথে কম্পিউটারে নারী কণ্ঠে বলে উঠলো “এক্সপেরিমেন্ট ‘ট্রাভেল সিরাস’ ইজ এবাউট টু স্টার্ট, নাইন, এইট, সেভেন, ……… ওয়ান”
কোন পরিবর্তন কারও চোখে ধরা পড়লো না! ইন্টেনিয়ামের টিউবটা শুধু একটু কেঁপে উঠলো বলে মনে হলো, তাও এক সেকেন্ডের লক্ষ ভাগের একভাগ সময়ের জন্য! আল্ট্রাসনিক সেন্সর ছাড়া এই পরিবর্তন কিছুতেই বুঝা যেত না। বিজ্ঞানীরা একেবারে থ মেরে গেছেন সবাই! এমন তো হবার কথা নয়! ইন্টেনিয়ামের টিউবটা তো এখন সময়ের অন্য স্তরে চলে যাবার কথা! কোথায় গড়মিল হলো? বড় ধরনের কোন ভুল হয়ে গেছে কোথাও নিশ্চয়! কিন্তু সব ডাটা, রিডিং সবকিছু একেবারে ঠিক দেখাচ্ছে! কোথাও কোন বিচ্যুতি, ভুল দেখা যাচ্ছে না! সবাই যতক্ষণে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তখন গমগম কণ্ঠে মহামতি কোস্ত্রা আদেশ দিলেন, “এক্ষণই ইন্টেনিয়ামের টিউবটা খুলে সিরাসকে বের কর, জলদি, রাইট নাও”
৬.
সরি!
- কি হয়েছে সিরাসের? কি হয়েছে ওর? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে ক্যাথির, চিৎকার করে যাচ্ছে অনবরত। কোথায় সে এখন?
মিসেস. নিহেতা, আপনি শান্ত হোন। মহামান্য সিরাসের ভালোর জন্যই আপনাকে এখন শক্ত হতে হবে।
- আপনারা কিছু বলছেন না কেন? কি হয়েছে ওর? মনের মধ্যে নানান আশংকা উকি ঝুঁকি মারছে, খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
আসলে কি হয়েছে আমরা এখনো ঠিক ধরতে পারিনি, তবে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে, আর কোন এক বিচিত্র কারণে মহামান্য সিরাসের বয়স বেড়ে গেছে অনেক বছর, প্রায় নব্বই এর কাছাকাছি।
- নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না ক্যাথি, পাগলের মত কি বলছে এই লোক! ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে কেবিনে ঢুকে যায় সে। থ! এই অতিশয়র বৃদ্ধ লোকটা সিরাস! নাকে অক্সিজেনের পাইপ, কুঁচকানো হাতের চামড়া, মুখের চামড়া কুচকে কালো হয়ে গেছে, মাথায় চুল নেই বললেই চলে যাও আছে, সব ধবধবে সাদা! এটা কি আসলেই সিরাস? ঠিক, সিরাসই তো! তাকে কি আর চিনতে ভুল হবে?
- ওহ! সিরাস! একি হয়েছে তোমার? বুকের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। সিরাসের দুর্বল হাতটা তুলে নিয়ে চুমু খায়, চোখের পানি মুছে তার হাত দিয়ে, তারপর মাথা নিচু করে বিছানায় মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে ক্যাথি।
কে ক্যাথি? এসেছো? আমার এক্সপেরিমেন্ট ‘সিরাস-ভ্রমণ’ ফেইল করেছে! আমার এক্সপেরিমেন্ট ফেইল করেছে! আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে প্রায় দ্বিগুণ! এটা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই, কিন্তু আমি এত দুর্বল হয়ে গেছি যে আর গবেষণা আর মনে হয় চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। বের ও করতে পারবো না কোথায় ভুল হয়েছে আমার, এ আক্ষেপ নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে যে কদিন আছি!
কোন মানুষ এই রকম পরিস্থিতিতে এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে আক্ষেপ করতে পারে! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না ক্যাথি। অতঃপর তার কথায় সায় দিয়ে বলে, “দুঃখ করো না, ঈশ্বর চাইলে সব ঠিক করে দিবেন। আসলে কি হয়েছিলো? তোমার কিছু মনে আছে?”
এক্সপেরিমেন্টের শুরুর দিকে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো, আর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি আমি এখানে। মাঝখানে আর কিছু মনে নেই আমার।
- বিছানা থেকে মাথা তুলে তাকায় ক্যাথি, চোখ পড়ে সিরাসের চোখে, থমকে যায় সে মুহূর্তের জন্য, সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে তার, হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক খেয়েছে যেন! চিৎকার করে উঠে, “কে তুমি, কে? তুমি তো সিরাস নও, না, না! তুমি সিরাস না! কোথায় আমার সিরাস?”
চিৎকার শুনে ডাক্তার নার্স ছুটে এসে ধরে ক্যাথিকে, আর সে অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে “এ আমার সিরাস নয়, এ আমার সিরাস নয়, এ আমার সিরাস নয়”
অনেক দুর্বল লাগছে সিরাসে, ঘুম পাচ্ছে তার। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে সে শুনতে থাকে ডাক্তাররা পাশের রুমে ক্যাথিকে বুঝাচ্ছে আর বলছে, “আমরা ব্লাড টেস্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট, চোখের আইরিশ চেক করে দেখেছি, এমন কি ডি.এন.এ টেস্ট পর্যন্ত করেছি, আমরা শতভাগ নিশ্চিত উনিই সিরাস”
ঘুমানোর ঠিক আগে কোন এক বিচিত্র কারণে তার কানে অদ্ভুত একটা শব্দ আসতে থাকে, “পিঁপ, পিঁপ, পিঁপ”। এটা কি সে ঠিক ঠিক শুনতে পাচ্ছে, না কি তার অবচেতন মন থেকে আসছে এই শব্দ? ভাবার আর অবকাশ পেল না সিরাস, ঘুমিয়ে পড়লো।
৭.
ধীরে ধীরে চোখ খুলে সিরাস। সে এখানে কেন? সে এখানে শুয়ে আছে কেন? আর সাদা এপ্রোণ পড়ে এত মানুষ তার চারপাশে দাঁড়িয়ে কি দেখছে? কোথায় সে এখন? এরা কারা? একটু ভয় পায় সিরাস।
মহামতি কোস্ত্রার কপালে ভাঁজ পড়লো বেশ কয়েকটা। উনি কিছুই বুঝতে পারছেন না কি হলো। ইন্টেনিয়ামের টিউব সময়ের অন্য ডাইমেনশনে চলে যাবার কথা, সেটা ঠায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে, আবার বিজ্ঞানী সিরাসের বয়স কমে বাইশ হয়ে গেলো! কোথাও মারাত্মক কোন ভুল হয়ে গেছে, মারাত্মক ভুল!
৮.
ঘুম ভেঙ্গে গেলে বেল টিপে নার্সকে ঢাকেন মহামান্য সিরাস। দিনের বেশিভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটান, বড় দুর্বল লাগে নিজেকে, আয়ু ফুরিয়ে এসেছে তার। একটাই কষ্ট, এক্সপেরিমেন্টটা সফল করে যেতে পারেন নি।
নার্স, আজ কয় তারিখ?
- বিশে জুন দুই হাজার একশ চার।
আমি এখানে কতদিন ধরে আছি? ক্যাথি কি এসেছিলো আর আমাকে দেখতে?
-পাঁচ দিন হলো। আর মিসেস. মিহেতা এখনো মনে করেন আপনি মহামান্য সিরাস নন। উনি কিছুতেই মানতে চাচ্ছেন না।
হুমম। কি একটা যেন খুচাচ্ছে মনে মনে সিরাসকে, কিন্তু ধরতে পারছেন না। হঠাৎ বা হাতের কব্জিতে কিসে উপস্থিতি টের পেলেন। হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরতেই কোয়ান্টাম ঘড়িটা চোখে পড়ল তার, জ্বলজ্বল করছে “নয় দিন বিশ ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট ……সেকেন্ড”। একসাথে অনেক কিছু খেলে গেলো তার মাথায়! সে হসপিটালে আছে পাঁচ দিন, তাই এক্সপেরিমেন্টও হয়েছে পাঁচ দিন আগে, কোয়ান্টাম ঘড়ি দেখাচ্ছে প্রায় দশ দিন! চোখ জ্বলে ওঠলো সিরাসের। মনে অনেক কিছু চিন্তা খেলে গেল, অনেক সম্ভাবনার উকি দিয়ে যাচ্ছে তার মনে। কম্পিত হাতে ফোন করলেন ক্যাথির নাম্বারে।
- “আপনি কেন ফোন দিয়েছেন? আমি বলিনি যে আমি আপনার ক্যাথি নই, আর আপনিও সিরাস নন! কী বলিনি?” উত্তেজিত হয়ে যায় ক্যাথি।
“আমি জানি আমি সিরাস নই”, দেখ ক্যাথি “কোথায় গণ্ডগোল হয়েছে আমি আন্দাজ করতে পারছি। যে রাইটিং-স্ক্রিনে আমি সব কিছু লিখে রাখতাম সেটা কি তুমি কি আমার বাসা থেকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে?”
- আমি সিরাসের ব্যক্তিগত গবেষণার রেকর্ড কেন আপনাকে দিব?
কারণ আমি সিরাসকে, তোমাকে এবং আমাকে সাহায্য করতে চাই, আমার এক্সপেরিমেন্ট ফেইল হয়নি। তুমি প্লিজ আমাকে একটু সহযোগিতা কর, আমার মনে হয় আমি আবার সব আগের মত করে দিতে পারবো। আর আমি ছাড়া আর কেউই পারবে না।
পরবর্তী দুই দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে সিরাস। ক্লান্তির চরমে চলে গিয়েছিল একেবারে এ দুই দিনে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাইটিং স্ক্রিনে একের পর এক সমীকরণ মিলিয়েছে, নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে, আগের সব কাজের রেকর্ড প্রথম থেকে শেষে পর্যন্ত চেক করেছে, খুঁটিনাটি অনেক কিছু আবার ভেরিফাই করে দেখেছে, এখন সবকিছু তার সামনে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে। আশ্চর্য! এত বড় একটা বিষয় কিভাবে তার চোখ এড়িয়ে গেলো? কাঁপা হাতে, কিন্তু অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফোন করে সে মহামতি কোস্ত্রার ইমার্জেন্সি নাম্বারে।
৯.
- আপনি বলতে চাচ্ছেন এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে?
আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি এক্সপেরিমেন্ট ‘সিরাস ভ্রমণ’ সফল হয়েছে।
- হুমম।
আমার ভুল হয়েছিলো আমি সময়ের অন্য স্তরগুলোকে সরলরৈখিক-সমান্তরাল ভেবেছিলাম, আসলে সময়ের ডাইমেনশনগুলো সমান্তরাল ঠিকই আছে, তবে তা সরলরৈখিক নয়, বরং এগুলো এক কেন্দ্র বিশিষ্ট বিভিন্ন বৃত্তের পরিধি বরাবর অবস্থিত।
- একটু সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করবেন, প্লিজ?
মনে করুন, একটা ফুটবলের ভিতর আরেকটা ফুটবল, তার ভিতর আরেকটা ফুটবল, তার ভিতর আরেকটা, এভাবে চলতেই থাকলো, স্বাভাবিক ভাবেই ভিতরের দিকের ফুটবলের পরিধি কম। এখন দ্বিমাত্রিক সময়ের একটা মাত্রা এই ফুটবলের পরিধি বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে যেটা আমরা অতীত থেকে ভবিষ্যতে প্রবহমান দেখি, আরেকটা মাত্রা এই ফুটবলের কেন্দ্র বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। এখন বাহিরের বিশ্বের পরিধি যেহেতু বেশি তাই এই বিশ্বে যখন একদিন সময় অতিবাহিত হচ্ছে, তখন ভিতরের কোন বিশ্ব যার পরিধি বাহিরের বিশ্বের পরিধির অর্ধেক সেখানে দুই দিন অতিবাহিত হচ্ছে। আসলে ঠিক করে বলতে গেলে, বাহিরের বিশ্বে যখন চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন প্রবাহিত হয়, তখন ভিতরের বিশ্বে বার ঘণ্টায় একদিন অতিবাহিত হয়, তবে কেন্দ্রের সাপেক্ষে সব বিশ্বের সময় এক।
অসীম সংখ্যক হুবহু একই রকমের বিশ্ব বৃত্তাকারে ‘একের ভিতর এক’ এভাবে অবস্থান করছে, কোথাও সময় দ্রুত কোথাও সময় ধীর। এই বিশ্বের সিরাস যখন ইন্টেনিয়ামের টিউবে ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তখন অপর বিশ্বের সিরাস মানে আমিও ইন্টেনিয়ামের টিউবে ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আসলে এই অসীম সংখ্যক বিশ্বের সবকিছু একই রকম চলছে। আমি এখানে এসেছি বলেই সিরাস ওখানে যেতে পেরেছে, আবার সিরার ওখানে গিয়েছে বলেই আমি এখানে আসতে পেরেছি। দুইটা ঘটনা যুগপৎ ঘটেছে বলে পরিবর্তনটা বুঝা যায় নি।
যখন এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয় তখন এই বিশ্বের সিরাসকে নিয়ে টিউবটি আমার বিশ্বে চলে যায়, আর আমাকে এই বিশ্বে নিয়ে আসে। যেহেতু সময়ের দুইটি ভিন্ন মাত্রার বিশ্বের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয় তাই স্বাভাবিক ভাবেই একে ব্যালেন্স করার জন্য আমার বয়স বেড়ে গিয়েছে, আর নিশ্চয় এই বিশ্বের সিরাসের বয়স ঐ বিশ্বে গিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।, এবং তার সব স্মৃতিও স+হিত হয়ে আছে তার সেই বয়সে। যেহেতু সবগুলো বিশ্বই হুবহু একই রকম তাই সবাই ভাবছে যে সে নিজের বিশ্বেই আছে
- এখন আপনি কি করতে বলেন?
সমাধান একদম সহজ। যে এক্সপেরিমেন্ট আমরা করেছি, সেটা আবার করলেই আমি আমার বিশ্বের আর এই বিশ্বের সিরাস এই বিশ্বে চলে আসবে।
- মুহূর্তেই করনীয় ঠিক করে ফেললেন মহামতি কোস্ত্রা। হাতে সময় খুব কম, সিরাসের শারীরিক অবস্থা ভালো না, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছে ভেবে ল্যাব বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, ঠিক আছে আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আবার এক্সপেরিমেন্ট চালানোর ব্যবস্হা করছি।
“অনেক ধন্যবাদ, স্যার” বলেই মহামতি কোস্ত্রা দিকে একটি ডিস্ক বাড়িয়ে দিয়ে সিরাস বললো, আমার একটা রিকোয়েস্ট স্যার, “এই ডিস্কটা আমি যাওয়ার পর ক্যাথিকে দিবেন। আর বলবেন যেন এই বিশ্বের সিরাস ফিরে আসলে এটা তাকে দেয়”
১০.
“প্রিয় সিরাস, কি অদ্ভুত! তাই না? নিজেকে নিজেই “প্রিয় সিরাস” বলছি! যেহেতু আমিই তুমি, তাই আমি আসলে যা বলতে চাই তা তোমার জানার কথা। কিন্তু আমার ধারনা তুমি তা জান না, কারণ তুমি যখন আমার বিশ্বের গিয়েছিলে তখন তোমার বয়স অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলো তাই তুমি অনেক কিছুই বুঝতে পারনি। আসলে এই বিশ্ব আমাদের ধারনার চেয়েও অনেক অনেক বেশি রহস্যময় ও জটিল। এখনে অসীম সংখ্যক বিশ্ব গোলক আকারে একের ভিতর এক অবস্থান করছে এক কেন্দ্রিক বৃত্তের পরিধি বরাবর; এই সূত্র মতে যতই কেন্দ্রের দিকে যাবে ততই সময়ের গতি বাড়তে থাকবে, তাহলে একেবারে কেন্দ্রে কি আছে? কেন্দ্রের সময়ের গতি তাহলে অসীম! আবার সর্ব বাহিরের বিশ্বের সময় কেমন? সেখানে তো সময় চির স্থির হয়ে আছে! তাহলে কি বিশ্বের কেন্দ্রের অসীম গতির সময় আর সর্ব বাহির বিশ্বের চির স্থির সময়কে ঘিরেই আছেন স্বয়ং ঈশ্বর? এ কারণেই কি ধার্মিকরা বলে ঈশ্বর সময়ের ঊর্ধ্বে? জানি না এ প্রশ্নের উত্তর পদার্থ বিজ্ঞান কোন দিন দিতে পারে কি না!”
“কোন দিন যদি পারেও, যে জিনিসগুলোকে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে না, ভালোবাসা হলো তার অন্যতম। যেখানে সর্বাধুনিক যন্ত্র দিয়েও সম্ভব হয়নি অন্য সিরাসকে শনাক্ত করা, সেখানে ক্যাথি শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিয়েছে আমি তার সিরাস নই! ভালোবাসায় অনুভূত কত গভীর হলে এটা সম্ভব? কতটুকু ভালোবাসা জমানো আছে তার বুকে, কখনো কি তা ভেবে দেখেছ বা আমি দেখেছি? ভালো থেক আমি, আমার ক্যাথিকে নিয়ে। শুভেচ্ছা”
------------------------------------ সমাপ্ত --------------------------------
টীকা টিপ্পনী:
১) সিরাস কণিকাঃ (কাল্পনিক) – স্ট্রীং থিউরির স্টীং এর একক।
২)স্টিফেনিয়ামঃ (কাল্পনিক) - এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
৩)রাইটিং স্ক্রিনঃ ব্ল্যাকবোর্ডের মত, ইলেক্ট্রনিক বোর্ড। আঙ্গুলের মাধ্যমে লেখা যায়, হাত দিয়ে মুছে ফেলা যায়। আবার সব কিছু সেভ হয়ে থাকে।
৪) প্ল্যাঙ্ক টেমপারেচারঃ এটাকে মনে করা হয় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। বিগ-ব্যাং এর পর মুহূর্তে এই তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়েছিলো বলে ধারনা করা হয়। এর মান, 1.41679 x 10^32 Kelvin বা 2.538 x 10^32 degrees Fahrenheit.
৫) কোয়ান্টাম ঘড়িঃ (কাল্পনিক) - বিশেষ এক প্রকারের ঘড়ি, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের প্রযুক্তি দিয়ে এটা বানানো হয়েছে। এটার বৈশিষ্ট্য হলো, সময়ের যে কোন ডাইমেনশনেই এটা ভ্রমণ করুক না কেন, যে ডাইমেনশনে এটাকে চালু করা হয়েছে এটা সবসময় সে সময়ই দেখাবে।
৬) ইন্টেনিয়ামঃ (কাল্পনিক) - এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কঠিনতম ধাতু।