সময়টা ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাস, জমিয়ে ঠান্ডা । আমি তখন ১৪ বৎসরের কিশোর এক । নদিয়া জেলার চাকদহে আমার মাসির বাড়ি । আজকের চাকদহের সঙ্গে ঐ ৩৫ বছর আগেকার চাকদহের আকাশ পাতাল পার্থক্য। তখন চাকদহে মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম । আর আমার মাসির বাড়িও অনেকটা জায়গা জুড়ে । প্রায় ৩ বিঘে জমির উপর, আরবি ঢালাইয়ের পাঁকা বাড়িটি জমির ঠিক মাঝখানে । আর বাড়ির চারিদিকে বড়বড় মহীরুহ তুল্য গাছ । দিনের বেলাতেই কেমন যেন গাঁ ছমছম করে, আর রাত্রি হলে, ভয়ে প্রকৃতির ডাককে পর্যন্ত উপেক্ষা করে কোনরকমে দিনের আলো ফোঁটার অপেক্ষায় থাকতাম । একবার, কি হলো বলি, শোনো তবে ।
এখানে মার্চ মাসে শেষবারের মতো এসেছিলাম, আমার মেসোমশাইয়ের আদ্য-শ্রাদ্ধে । তারপর এই আসা । দ্বিতীয়দিন সন্ধ্যেবেলাতেই ঘরে ভাইবোনেরা আড্ডা মারতে মারতেই কেমন করে যেন ভূতের প্রসঙ্গে গল্প শুরু হতেই সবার মুখেরই চেহারাটা গেলো বদলে । সবাই এ ওকে চেপেচুপে ধরে বসলো, আর ভূত বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাইলো । অগত্যা । রাত্রের খাওয়া শেষে বিছানা । শীত আর ভূতের ভয়ে ঘুম আসতে সময় নিলো না । মাঝরাত্রে আমার মুত্রের বেগ এতোটাই হলো, অন্ধকারে ভাইকে ডাকলাম, সে ঘুমে অসার, মাসি আমার গলা শুনে বললো যা আমি জাগা আছি, হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে পেছনের দরজা খুলে যা । আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, যাক একজন অন্তত জাগা আছে । আমি উঠে হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে বোধহয় ভুল করেই ঘুমচোখে সামনের দরজাটা খুলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দাঁড়ালাম । হঠাৎ দেখি, আমার মেসোমশাই বড়ো বেলগাছের নিচে মাদুরের উপর বসে হুঁকো টানছেন, পাশে একটা ফাঁকা স্টীলের থালায় কিছু পোড়া তামাকের ছাই, আর হাত দিয়ে আমাকে ডাকছেন । আমি কিছুটা অবাক হলাম বটে, কিন্তু জলজ্যান্ত মেসোমশাইকে দেখে খুব আনন্দও হলো । আমি এগিয়ে গেলাম, মেসোমশাইয়ের পাশে মাদুরে গিয়ে বসলাম । মেসোমশাই আমার চাদরের নীচ দিয়ে আমার পিঠে হাত রাখলেন । আমার সারা শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা শিহরণ খেলে গেলো, আর অনুভব করলাম শক্ত বরফ ঠান্ডা হাত যেন আমার পিঠের চামড়ায় আঁচড় কেটে দিচ্ছে । মেসোমশাই বললেন, কিরে খুব রোগা হয়ে গেছিস দেখছি, খুব পড়ার চাপ তাই না । আমি বললাম, কই নাতো, আমি তো একই আছি । কিন্তু মেসো, তোমাকে যেন কেমন লাগছে । তোমার কি হয়েছে গো ? তোমার হুকোয় তো আগুন নেই, তাও তুমি কি টানছো? জান, মেসো, তোমাকে না কতদিন পরে দেখলাম । তুমি সেই যে অঙ্ক করিয়ে দিতে, তখন কতো অঙ্ক পারতাম, এখন আর তুমি আস না আমাদের বাড়িতে, আমার অঙ্কের জোরটাও কমে যাচ্ছে । মেসো বলে উঠলেন, আরে আমি কি আর যেতে পারি এখন, বয়স হয়েছে, আর এই দেখ না, একটা হুঁকো আমাকে ধরিয়ে এই বেলগাছটাতে গন্ডি এঁকে দিয়েছে । তাই আমি আর এই চত্বর ছেড়ে বেড়োতেও পারছি না, আটকে পড়েছি এইটুকু জায়গাতেই । রোজ বসে থাকি এই মাঝরাত্তিরে, যদি কাউকে পাই একটু কথা বলার জন্য । কথা বলতে না পেরে আমার জিভটা আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে রে । প্রায় ৮ মাস বাদে তোর সঙ্গে আজ একটু কথা বলছি । ঐ একদিন আমার মেজো ছেলেটা বেড়িয়েছিলো, আমি ডাকতেই যা ত্রাহি চিৎকার জুড়লো, তারপর দেখেছি ও খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিলো । পরে ডাক্তার এসে সুস্থ করেছে । আমি কিছুই করতে পারলাম না । আমি আটকা যে এই বেলগাছে । জানিস ওরা আমাকে ভুলতে চায়, ওরা বলে আমি নাকি ভূত হয়ে গেছি । হ্যাঁরে, মা-বাবা কখনও ভূত হয়? আর হলেও ছেলেপুলের মঙ্গলই চায় সবসময় । কি আর করবো একা একা বসে পাহাড়া দিই এই সদর, ঘরে যে আমার বৌ-বাচ্চারা থাকে, কি আর করার বল । মেসোমশাইয়ের হাত পড়লো আমার মাথায় । আমার মনে হলো ঠান্ডা শক্ত কাঠের টুকরো যেন আমার মাথার চামড়ায় আঁচড় কাটছে । আমি বললাম, মেসো ওসব বাদ দাও, দাঁড়াও আমি ওদের ডাকি, বেশ জমিয়ে গল্প করা যাবে । মেসো আমার হাত টেনে বসিয়ে দিলো । আমি ওরে বাবারে বলে বসে পড়লাম । মেসো বলে উঠলো, কি হলো রে । আমি বললাম, তোমার ওই নরম হাতটা এতো শক্ত হলো কি করে গো, আমার হাতটা যেন ছুড়িতে কেটে গেলো, আর কি ঠান্ডারে রে বাবা তোমার হাতের ছোঁয়াটা, তোমার গায়ের রক্ত কি সব বরফ হয়ে গেছে গো ? মেসো কিছু বলার আগেই আমার সম্বিত্ ফিরলো, আমার গালে পড়লো এক দশাসই চড়, গালে হাত দিয়ে চেয়ে দেখি, মাসি আমার হাত ধরে টানছে, আর বলছে, তোকে যে বললাম পেছনের দরজা দিয়ে বেড়োতে, কেন তুই সামনের দরজা খুললি ? চল ঘরে চল, কি করছিস এতো রাত্তিরে এখানে? হ্যারিকেন নিভলো কি করে? তুই কি কিছু দেখেছিস ? চল, উনি কারোর ক্ষতি করেন না । আমি সব শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু মুখে আমার কথা বেরোচ্ছে না । মাসির হাতের কূপির আলো নিকষ কালোকে দূর করেছে, আমি অবাক হচ্ছি মেসোমশাই কোথায় গেলো, তবে কি আমি এতক্ষন …..? মাসির হাত ধরে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম । দেখি আমার ভাই বোনেরা সব এক খাটে এ ওকে জড়িয়ে ধরে শুকনো মুখ করে আমাকেই বোধহয় ভুত ঠাঊরেছে । মাসি এসে একটা গোটা কলা আমাকে খাইয়ে দিলো । কলা খেয়ে আমার অবশ দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিলাম । পরদিন ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরি হলো । আমাকে সুস্থ দেখে আমার ভাইবোনেরা খুশি হলো । ওদের কাছেই শুনলাম আমার মাসি নাকি মেসোমশাই মারা যওয়ার পর রোজ দুপুরে ঐ স্টীলের থালাতে ঘরে যা ই রান্না হোক না কেন দিয়ে আসে বেলগাছতলায়, সারাদিন, কুকুর,বেড়াল,বা যে কোন পশু-পক্ষী ঐ খাবারে মুখ দিতে আসলেই কে যেন ওদের তাড়িয়ে দেয়, আর পরদিন সকালে ঐ থালা পাওয়া যায়, এইরকম পোড়া তামাকের ছাইয়ের সাথে ।
দুপুরে স্নান খাওয়া শেষে আমি বিকালে আমার কলকাতার বাড়ি ফিরে আসি ।