প্রিয়,
এটাই আমার জীবনের শেষ চিঠি। আমি আর থাকবো না, থাকতে চাইলেও থাকতে পারবো না। নিষ্ঠুর নিয়তি আমাকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তোমরা যারা এতো দিন আমাকে ভালবেসেছ, সুখে দুঃখে পাশে থেকেছ তারা হয়তো প্রথম প্রথম কিছুদিন আমার কথা মনে করবে, পরে এক সময় তোমরাও অন্যদের মত আমাকে ভুলে যাবে। আমার জায়গায় নতুন একজন আসবে, তাকে নিয়েই শুরু করবে তোমাদের নতুন পথ চলা।
শেষ চিঠি লিখতে বসে একটু আবেগি হয়ে পড়ছি। এই ছোট্ট জীবনে কত কথা, কত স্মৃতি, কত হাসি আনন্দ জড়িয়ে আছে সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। আমি কালের সাক্ষী। গ্রামের সবচেয়ে পুরনো বটগাছটার মতই আমিও অনেকের হাসি আনন্দ, দুঃখ, হতাশা’র সাক্ষী। কত মানুষ আনন্দে উল্লাস করেছে, দুঃখে কেঁদেছে, কত বালিকা ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে অভিমান করেছে সব আমার জানা। কিন্তু আমার সাধ্য খুব কম। আমি শুধু দেখে যেতে পারি, ডায়েরির পাতায় ঘটনাগুলো লিখে যেতে পারি, এগিয়ে গিয়ে কাউকে সাহস দিতে পারি না, কারো দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারি না, কারো আনন্দের অংশীদার হতে পারি না। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো। যখন মনে হত আমি অন্য সবার মত নই, আমি কেবল দেখে যেতে পারি, কেবল দর্শক হয়ে দেখে যাওয়ার জন্যই আমার জন্ম তখন কিছুই ভালো লাগতো না। তবে এতো কিছুর পরেও সুখে ছিলাম, আনন্দে ছিলাম। ভালো মন্দ মিলিয়েই তো জীবন, এই জীবনে সবার সব চাওয়া পূরণ হবে না- এটা মেনেই নিয়েছিলাম, তারপরেও কেন যে চলে যেতে হচ্ছে। আহা, যদি অনন্তকাল থেকে যেতে পারতাম তোমার সঙ্গে, তোমাদের সঙ্গে!
বেশ কিছু দিন ধরেই স্বাস্থ্যটা ভালো লাগছিলো না। দুষ্ট লোকেরা বলাবলি করছিল- আমার নাকি হাঁপানির টান উঠেছে, আমার নাকি প্রেসার বেড়ে গেছে, আমার নাকি গ্লুকোজে সমস্যা দেখা দিয়েছে, আমার নাকি ডায়াবেটিস ঠিক নেই, আমার সব কিছুতেই নাকি সমস্যা। দুষ্ট লোকের কথায় কান দেয়ার কিছু নেই। তারপরেও ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি শরীর টিপেটুপে দেখে হাতে অনেকগুলো টেস্ট ধরিয়ে দিলেন। এখনকার ডাক্তারদের এই এক সমস্যা, কিছু হোক বা না হোক, হাতে এক গাদা টেস্ট ধরিয়ে দেবে। মনে করুন আপনার জ্বর হয়েছে কিন্তু ডাক্তার সেটা মানবে না। কমপক্ষে দশ টা টেস্ট করতে বলবে। সব টাকা কামানোর ধান্দা। কিন্তু কি আর করা যাবে? ডাক্তারের উপর যেহেতু আর কেউ নেই, তাই টেস্ট গুলো করিয়ে আনলাম। টেস্ট রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন-‘ভয় পাওয়ার মত কিছু হয় নি। দুষ্ট লোকেরা যা বলেছে সেসব সত্য নয়। আমার কোন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় নি।’ ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু শেষে উনি বললেন-‘তবে একটা কথা, আজ হোক, কাল হোক সবাইকে এক সময় চলে যেতে হয়। এই নিয়মের বাইরে আমরা কেউ নই। আপনারও শেষ সময় উপস্থিত। এটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। শেষ কয়টা দিন মনে কষ্ট রাখবেন না। ভালো থাকুন।’ ডাক্তারের শেষ কথা গুলো শুনে মনটা ভেঙ্গে গেলো। কোন ব্লাড ক্যান্সার নেই, নেই কোন ভাইরাসঘটিত রোগ, অথচ তারপরেও চলে যেতে হবে, চির বিদায় নিতে হবে- কোন মানে হয়!
পাড়ায় পাড়ায়, প্রতিটা মহল্লায়, প্রতিটা দেশে দেশে খবর রটে গেছে যে আমি আর বাঁচবো না, আমার শেষ সময় উপস্থিত। ডাক্তার আমার সময় বেঁধে দিয়েছে, আমি আর চার দিন থাকবো সবার মাঝে, তারপর টুক করে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবো। রঙিন আলোয় তোমাদের পৃথিবী আলোকিত হবে, উৎসবের রঙে সেজে যাবে তোমাদের নগরী, সব কিছুই তাঁর নিয়মে চলবে কেবল আমি থাকবো না। আমার না থাকায় কারো কিছু যাবে আসবে না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি মানুষ এতো নিষ্ঠুর কেন?
অবশ্য সব মানুষই নিষ্ঠুর নয়। আমার সঙ্গে যাদের সুখ দুঃখ জড়িয়ে আছে তারা ঠিকই আমাকে মনে রাখবে। যে ছেলেটার প্রথম প্রেমে পড়ার সাক্ষী আমি, সে আমাকে কোন দিন ভুলবে না। প্রতি বছর একটা বিশেষ দিনে আমাকে তার মনে পড়বে। ওদের যখন বাচ্চা কাচ্চা হবে তখন সেই বাচ্চার কাছে আমার গল্প করবে তারা। যে মানুষটার প্রিয়জনের বিদায়ের সাথে আমি জড়িয়ে আছি সেও আমাকে কখনো ভুলবে না। প্রতি বছর তাঁর প্রিয় মানুষের বিদায়ের দিনে আমাকে তাঁর মনে পড়বে। এরকম আরও হাজার হাজার গল্প আছে ইচ্ছে থাকলেও সব বলা সম্ভব নয়। হাতে সময় অনেক কম। এ কয়টা দিন প্রস্তুতি নিতে হবে, চির বিদায়ের প্রস্তুতি। এই আলো ঝলমলে রঙিন পৃথিবী ছেড়ে, স্বার্থপর মানুষগুলো ছেড়ে কিভাবে থাকবো সেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
হে আমার বন্ধুরা, তোমরা সবাই ভালো থেকো, অনেক অনেক ভালো। তোমাদের সামনের দিনগুলো সাফল্যে ভরে উঠুক। হানাহানি, কাটাকাটি, ঝগড়া বিবাদ ভুলে তোমরা মানুষের মত মানুষ হও এই কামনা করি সব সময়। আমি চলে গেলাম ঠিকই, তবে আমার জায়গায় আরেকজন আসবে। তাকে ঘিরে তোমরা ভালো থাকো। বিদায়...
ইতি-
হতভাগ্য
২০১৪ ইং