বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
[উস্তাদ নুমান আলী খানের লেকচার অবলম্বনে অনুবাদ]
শয়তান বলল (আল্লাহর উপর অভিযোগ করে), "যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন, একারণে আমি অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই তাদের (আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার) জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকব"।
এখানে শয়তান আরবি যে শব্দ ব্যবহার করেছে তা খুবই গভীর, যা কোন সাধারণ শব্দ নয়। এই একটি শব্দ ভালো করে উপলব্ধি করতে পারলে আমরা শয়তানের পথভ্রষ্টতার কৌশল ধরতে পারব এবং আমরা এ থেকে বেঁচে থাকব কি না সেটা আমাদের চেস্তা আর আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভর করবে।
আরবিতে "জুলুস" অর্থ বসে থাকা, কিন্তু "কুয়ুদ" অর্থ শুধু বসে থাকা নয়, বরং দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, চিন্তাশিলতা নিয়ে বসে থাকা (সূরা আলে ইমরানঃ ১৯১ দেখুন)। এখানে শয়তান শিকার ধরার জন্য বিস্তারিত ও বড়সড় পরিকল্পনা নিয়ে বসে থাকে। কীভাবে? আসুন তবে বসে থাকা (কুয়ুদ) এর একটি উদাহরণ দেখি।
একটি বক কিভাবে মাছ ধরার জন্য বসে থাকে (কুয়ুদ)?
সে চিন্তা করে এই খাবার এখন না পেলে সে অভূক্ত থাকবে, কষ্টে থাকবে...
সে দেখে কখন তীব্র রোদ উঠবে আর মাছ উপরে উঠে আসবে...
সে দেখে তার শিকারের সময় ছায়া পড়বে কি না যাতে মাছ টের না পায়...
সে চিন্তা করে কোন কৌণিক অবস্থানে গেলে মাছ তাকে দেখবে না...
সে চিন্তা করে মাছ কোন দিকে মাথা দিয়ে রাখবে এবং সেখানে থাবা দিবে যাতে মাছ ছুটতে না পারে...
এভাবে বহু চিন্তার পর সে মাছ শিকার করে। এটা কি শুধু বসে থাকলে হবে? না, কক্ষনই ন। বরং দীর্ঘক্ষণ বসে, চিন্তা করে, পরিকল্পনা করে, এরপরেই না তার কাজ সমাধা করতে হয়। তাহলে চিন্তা করুন কত দীর্ঘ সময় তাকে বসে থাকতে হয় একটি শিকার ধরার জন্য।
যারা ক্রিমিনলজি পড়েছেন তারা হয়ত জানেন একটি ক্রিমিনালকে ধরতে বা কোন অপারেশন চালাতে কত প্রস্তুতি নিতে হয়। কত দিন, কত মাস ধরে সময় নিয়ে অবস্থান ঠিক করে, লোকজন ঠিক করে, অপরাধীর অবস্থান ভালমত পর্যবেক্ষণ করে, কোথায়, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কত সময় ধরে, কোন অস্ত্র দিয়ে তাকে ঘায়েল করবে - সবই পূর্বপরিকল্পিত হয়। এটাই শিকার ধরার জন্য বসে থাকা, এটাই শয়তানের বসে থাকার উদাহরণ যা শয়তান নিজেই দুইবার কসম করেও আবার সৎবান্দাদের কথা উল্লেখ করেছে যে সে "সরল পথে বসে থাকবে, ওঁত পেতে থাকবে, কতশত সময় লাগুক, একমাস লাগুক, ছয়মাস লাগুক, সারা দিন-রাত লাগুক, যতই কষ্ট হোক বসে থাকতে, তাও সে থাকবে ঐভাবে, তবুও পথভ্রষ্ট করেই ছাড়ব আদম সন্তানদেরকে" - এটাই শয়তানের বসে থাকা - "কুয়ুদ"।
এখন উদাহরণটি ভালো করে বুঝুন ফেইসবুক বা অনলাইনের বাস্তব উদাহরণ দিয়ে।
আপনার বিপরীতধর্মী ছেলে বা মেয়েকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিলেন আর এক্সেপ্ট করলেন বা হল, ভাবলেন আর তেমন ক্ষতি কী? ফ্রেন্ডই তো শুধু, তাও আবার অনলাইনে, পরিচিত তো আর নাহহ। এরপর লাইক, একটা কমেন্ট। একটা কমেন্টই তো, তাই না? তেমন কিছু নাহহ। এরপর প্রশংসার ইচ্ছা হল, যদি ঐ ছেলে বা মেয়ের নজরে আসা যায় - প্রশংসা কে না চায়?প্রশংসা করতে লাগলেন, আপনাকেও ধন্যবাদ দিতে লাগল। এর কিছু দিন পর নাম উল্লেখ করে প্রশংসা বা কমেন্ট করতে লাগলেন। আরো এগুলেন দিন দিন, ধীরে ধীরে একটু অনলাইনে পরিচিত হলেন বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে। এত প্রশংসা করল আমার অথচ একটু পরিচয়ই তো জানতে চেয়েছে। না দিলে কী মনে করবে আবার, লজ্জার বিষয় আছে না? এরপর ধীরে ধীরে কিছু ব্যক্তিগত জিনিসও শেয়ার হয় ফেসবুকে। কিছুটা হাসিঠাট্টা হতে লাগল। আরে নাহহহহহ, হাসিঠাট্টা কি ইসলামে হারাম নাকি?! এরপর অনুভব করতে লাগলেন তাকে, চিন্তা করেন তাকে নিয়ে, ফেসবুকে বারবার তার ওয়াল ঘুরে আসেন কখন সে স্ট্যাটাস দিবে, লাইক দিয়ে প্রশংসা করব, সেও ধন্যবাদ দিবে - ভালো লাগার তীব্র অনুভূতি জেগে উঠতে লাগল। এভাবে হয়ত কোন দিন তাকে ভাল ফ্রেন্ড (ইসলামী!) বলে উল্লেখ করে স্ট্যাটাসাও দিতে পারেন, "এরা অনেককক ভালো লেখে"। চলতে থাকল, এভাবে চলতেই থাকল। শয়তান আপনার জ্ঞানহীন ইসলাম দিয়েই আপনাকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
এখন এই ধীর প্রক্রিয়ার সাথে শয়তানের বসে থাকার উদাহরণ দেখুন মিলিয়ে। কত দীর্ঘ সময় নিয়ে শয়তান কাজ করে, কীভাবে, কত পন্থায়, কোন সময়, কোন মনস্তত্ত্ব ব্যবহার করে আজ ফেসবুক বা অনলাইন বা অফলাইনে শয়তান সফল হচ্ছে্ - এভাবে ধীরে ধীরে আপনিও শয়তানের বসে থাকার শিকারে সাইকো হচ্ছেন। এখন যেই ইসলামের কথা ভেবে একজন ছেলে/মেয়েকে ফ্রেন্ড করেছিলেন "জাস্ট ফ্রেন্ডই তো" - এই কথা ভেবে, এই যৌক্তিকতা দেখিয়ে। শয়তানের বসার জায়গাতে ধীরে ধীরে শিকার আনিয়ে দিলেন। এখন আর ইসলামী স্ট্যাটাসে মন নেই, মন এখন শুধু প্রশংসা, মেনশন, হাসিঠাট্টা, বা দুংখ-সুখের কাহিনীতে। সালাতে এখন আর আল্লাহকে মনে হয় না। মনের কোণে সালাতেও আল্লাহর পরিবর্তে ফেসবুকে বা ক্লাসের সেই নির্দিষ্ট মানুষটির কথা মনে হতে থাকে, দুজনের নিয়ত কলুষিত হয়, রিয়ার প্রকাশ ঘটতে থাকে ইসলামী স্ট্যাটাসের আরালে, স্ট্যাটাসে ভিন্ন লিংগের লোকের সমাগম বাড়তে থাকে, তাদের ইসলামী স্ট্যাটাসও বাড়তে থাকে, অনেক সময় ট্যাগ করেই বাড়তে থাকে এ গতি, অনলাইনে ইসলামী স্কলারদের শত শত দলীলভিত্তিক সাইট থাকতেও আপনার কাছে মেসেজ করে ইসলামী সাজেশনের জন্য আর আপনিও ভাবেন বাহহহহ ছেলে/মেয়েটা তো ইসলাম নিয়ে দারুন পড়াশুনা করে। চলতে থাকল মেসেজে - এভাবে শয়তান তার বসে থাকাকেও সফল করে ফেলে, সফল করে ফেলে এতদিনের পরিকল্পনাকে। ফলে ইসলামী জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার ভিখারিরা আজ ধ্বংসের পথে, তাদের আল্লাহর সাথে সম্পর্কের পরিবর্তে রয়েছে শয়তানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তৎপরতা। অর্থাৎ তারা চলছেই এ পথে। এখানেই ইসলামী জ্ঞানের চরম ঘাটতি, আল্লাহর সাথে সম্পর্কেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে ইসলামী জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা না থাকার অভাবে, ইসলাম নিয়ে বেশি পড়াশুনার অভাবে।
শয়তান আমাদের কীভাবে পথভ্রষ্ট করবে তা নিয়ে তার তৎপরতা পেশাদার পর্যায়ের আর শয়তানের ধোঁকা থেকে আমরা কীভাবে বাঁচব তা নিয়ে আমাদের পড়াশুনা প্রাথমিক পর্যায়ের কিংবা তাও না। তো কীভাবে আমরা আশা করি আমরা শয়তানের সাথে পেরে উঠব? ইসলামী একটা স্ট্যাটাস বা নোট একটু বড় হলেই আমরা এড়িয়ে যাই, আর্টিকেল বড় বলে আর উঁকি দেই না, ইসলামী বইয়ের কথা আর নাই বলি।
আমাদের ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করাটা চড়ম ঘাটতির মধ্যেই রয়েছে। আমি যখন দেখি একজন ইসলামী ভাই বা বোন পথভ্রষ্ট হচ্ছে তখন আর অবাক হই না। আমাদের অনার্স পর্যন্ত হয়ত ১৫০ টা বড় বড় বই পড়ি অথচ আখিরাতের জীবনের জন্য, অনন্তকালের সুখের জন্য বই পড়তে অনীহা লাগে। তো শয়তানের পথভ্রষ্টতার পেশাদার পর্যায়ের জ্ঞানের সাথে ইসলাম নিয়ে আপনার সর্বনিম্ন পড়াশুনা দিয়ে কীভাবে ইসলামে টিকে থাকতে চান? ঝড়ের সাথে বালির ঘর দিয়ে কীভাবে টিকে থাকতে চান? বড় নোট দেখলেই পলায়ন করেন, তো কীভাবে শয়তানের মোকাবেলা করবেন? ৩-৪ ঘন্টার লেকচার দেখতে বললে বড় করে ‘হা’ করে বলেন, "কয়য়য় ঘন্টার লেকচার? ...আমার অত ধৈর্য নেই।" আপনার ধৈর্য না থাকলেও শয়তানের ঠিকই ধৈর্য আছে আপনাকে পথভ্রষ্ট করে জাহান্নামের গভীরের প্রবেশ করাতে। ধৈর্যের ফল আপনি নিতে না চাইলেও শয়তান ঠিকই আপনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে এর ফল নিবে।
আপনি হিজাবের আধুনিক ডাইমেনশন জানেন না (ফেসবুক ও ক্লাসে), রিয়া (লোক দেখানো ইবাদাহ) কীভাবে হয় জানেন না, ইসলামী স্কলাদের হাজার হাজার রিসোর্স থাকতেও যখন আপনি বিপরীতধর্মী একজন ছেলে/মেয়ের কাছে ইসলামের সাজেশন চান এবং আপনি প্রটেকটিভ পদ্ধতি না নিয়ে বরং মেসেজ চালিয়েও যান, কীভাবে ও কতভাবে শয়তান পথভ্রষ্ট করে তা জানেন না, তা নিয়ে স্কলারদের লেখা বই পড়েন না, অথচ শয়তান থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছা করেন যেন পা ভেংগে গেলেও ডাক্তারের কাছে না গিয়েও সুস্থ হওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন!!!
শয়তান ভালো করেই জানে আপনাকে একবারে জালে ফাঁদতে পারবে না। তাই সে ধীরে ধীরে ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথেই আপনাকে এমনভাবে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে যে তখন আপনি শয়তানকেই সহায়তা দিতে থাকবেন। আপনি তখন বাহানা দিতে থাকবেন আরেহহহ মেয়েটা তো ইসলামিক মাইন্ডের, অনেক ভালো লেখে। ঐ ছেলেটা তো ইসলাম নিয়ে অনেক ভালো লেখে। শয়তান আপনার জন্য এই টোপই কাজে লাগাবে। আপনার বুদ্ধিহীন ইসলামী জ্ঞান দিয়েই আপনার ইসলামকে ধংস করে দিবে শয়তান। কারণ আপনার ইসলাম নিয়ে জ্ঞান আছে কম কিন্তু শয়তানের রয়েছে অনেক বেশি। তাই শয়তান জানে কোন পদ্ধতিতে গেলে আপনাকে পথভ্রষ্ট করা যাবে।
শয়তান খুঁজে আপনার ইসলামী জ্ঞানের নগণ্যতা, আপনার জ্ঞানহীন ইসলামের সুযোগ সে নেয় এবং এই জ্ঞানহীন দিক দিয়েই আপনাকে এমনভাবে আক্রমণ করে যে আপনি ধরতেও পারেন না এটা অনৈসলামিক। শয়তান আপনাকে পথভ্রষ্ট করছে কারণ আপনার জ্ঞান কম ইসলাম নিয়ে এবং এটা সে এমন ধীরে ধীরে করেছে (কুয়ুদ) যে আপনি টেরই পাননি (ইসলাম নিয়ে আপনার জ্ঞানের ঘাটতির কারণে)।
আমাদের ইসলামী জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে অনেক বেশি, আমালেরও ঘাটতি রয়েছে। অনেকের আবার ইসলামী জ্ঞান প্রচুর কিন্তু আমল নেই। অনেকের আবার উল্টো, ইসলামী জ্ঞান কম কিন্তু আমল ভাল। অনেকের আধ্যাতিক জ্ঞান বেশি অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান কম বা উল্টোটাও হয়। এসব ধরণের লোকেরাই শয়তানের বসে থাকার রাস্তায় চলছে। আমাদের আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের সমন্বয় করতে হবে, জ্ঞান ও আমল সমভাবে চালাতে হবে, তবেই শয়তানকে পরাজিত করতে পারব। তার পথভ্রষ্ট করার পরিকল্পনা ধরতে পারব জ্ঞানের মাধ্যমে এবং আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে। তাকে ছাড়িয়ে আল্লাহর অধিক নিকটে যেতে পারব। শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে পারব, আমাদের আদি-নিবাস সেই জান্নাত-ই হবে আমাদের বাসস্থান।