মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৮৯- কালাচাঁদবাড়ী

উপরের চিহ্নটা হলো [বাংলা লিপিতে] ‘অউম’ বা ‘ওম’, হিন্দু ত্রিত্ববাদীয় উচ্চারণ, ওঙ্কার। কিন্তু ‘কালাচাঁদবাড়ী’? …কোনো বাড়ির তো চিহ্ন পর্যন্ত নেই, তাহলে বাড়ি এলো কোত্থেকে? বুঝলাম না। হয়তো কোনো হিন্দু বাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি, তাই নিজের বাড়ির দখলদারিত্বের নিদর্শন রেখেছে এভাবে। এখন ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, তাহলে মোটামুটি ১৪ বছর আগে দেয়ালটা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে গাছটা আরো পুরোন আর বয়স্ক মনে হচ্ছে। টর্চের আলোতেই আমার কম রেযোল্যুশনের মোবাইল দিয়ে ছবি তুললাম লেখাটার; আমরা একবার করে বসে লেখাটার পাশে নিজেদের ছবি তুললাম।

গাছের বাঁধানো দেয়ালের লেখা। (ছবি: নিশাচর)
গাছের দিকে তাকালাম আমি। কোনো অশুভত্ব নেই, কোনো ডাল নুয়ে নেই, সবই স্বাভাবিক, অতি স্বাভাবিকও না; যথেচ্ছ স্বাভাবিক। এখানে আমাদের কাজ শেষ, তাই আমরা দ্বিতীয় গাছের দিকে যাবো এবারে। শেষবারের মতো আমরা দেয়ালের ফোকর দিয়ে ভিতরে টর্চের আলো ফেললাম, যাতে ভিতরে কিছু থাকলে দেখতে পারি। টর্চের আলো ফেলতেই আমার বুকটা ধক্‌ করে উঠলো … কিছু একটা দেখেছি … তাতেই আমার মনের গহীন থেকে ভয়টা বেরিয়ে এসে পুরো শরীরটা কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এক সেকেন্ড লাগলো সয়ে আসতে, পরক্ষণেই চিনতে পারলাম, ওটা একটা হাতে বানানো ছোট্ট হিন্দু মূর্তি। ভয়ের রেশটা কিছুক্ষণ থাকলো আমার ভিতরে। বাকিদের অবস্থা জানি না। ভয় পাইনা আমি এটা ঠিক, কিন্তু এইতো পেলাম, যদিও সেটা সাময়িক। কিন্তু অভিযাত্রী হিসেবে এই ভয় পাওয়াও চলবে না। আমি আবার নিজের সাহসটুকু চাঙ্গা করে নিতে চাইলাম। তবে ভায়ের আপাত রেশে মূর্তিটা কোন দেবতার, তা আর শনাক্ত করতে গেলাম না; তবে এতটুকু বলতে পারি, ওটা ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব) কোনো একজন। শুধু সমাধানে পৌঁছলাম, এই মূর্তিগুলো রেখে হিন্দুরা এসে গাছটির পূজা করে।
দেয়ালঘেরা গাছটিকে পেছনে রেখে এগিয়ে চললাম ঢিপি গাছটা লক্ষ করে। চাঁদের আলোয় পাতাশূণ্য গাছটা কেমন রূপময়ী লাগছে, গল্পের বইতে এই রূপকে বোধহয় ভয়ঙ্কর ভূতুড়ে রূপ বলা হয়। আমরা এগিয়ে চললাম গাছটাকে লক্ষ্য করে। গাছটার কাছাকাছি গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, আমার মোটেও ভয় করছে না। হয়তো দেয়ালঘেরা গাছটার নিচে ভয়টা পাওয়ায় প্রাথমিক ভীতিটা কেটে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়েই আকাশের চাঁদটার একটা ছবি নিলাম মোবাইল দিয়ে। মনে সামান্য ইচ্ছে, যদি ছবিতে ‘গাছে শুয়ে থাকা’ কোনো জ্বিনের ছবিও উঠে যেতো। কিন্তু নিরেট কালো গাছের ডাল, আর আকাশের জ্বলজ্বলে চাঁদটা ছাড়া ছবিটা ধুসর।
আর কিছুই দেখার নেই। আমরা ফিরতি পথ ধরতে চাই। গাছটাকে পিছনে ফেলে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। কিছুই দেখতে না পাওয়ায় শাকিরের বোধহয় ভীতিটা সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে আবারো এ্যাডভেঞ্চারের মজায় চলে এলো, বললো, হাওড়ের মাঝখানে মাঝরাতে পানি খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা দারুণ হবে। গোল হয়ে হাঁটুর উপর বসে সে পানি পান করলো, সাথে আমরা দুজনও। তারপর সে গল্প বলতে থাকলো, সেবা প্রকাশনীর অনুবাদকৃত ‘শী’ আর ‘রিটার্ণ অফ শী’র কাহিনী। সেখানে এরকম জঙ্গুলে অভিযানের গল্প আছে। টর্চের আলো ফেলে মুহূর্তটা ভিডিও করলাম আমি, সাথে ঐ ঢিপি গাছটাও। তারপর ফিরতি পথ ধরলাম।
আবারও শাকির একই কথার পুণরাবৃত্তি করলো, ভাইয়া, আবারও ওটা হয়েছে; এটা অস্বাভাবিক। ও যদিও বলছে, কিন্তু আমি কোনো আলামতই পেলাম না। আমরা ফিরতি পথে হাঁটছি। দূর থেকে আধো অন্ধকারে আমরা বুঝতেই পারছি না, কোন পথে এসেছিলাম। আগেই বলেছি, হাওড়ের কোনো কিনারা পাওয়া যায় না এই জায়গায়। শাকির ইশারা করলো চাঁদের আলোয় দূরে দেখা যাওয়া ছোট্ট কাঁশ ঝোপটার, ওটার পাশ কাটিয়ে খাল পার হয়েছিলাম। ওদিকে চললাম। এক সময় আমরা খালটা পার হলাম। তারপর আবার গ্রামের মেঠো পথ ধরলাম। নীরব রয়েছি তিনজনে। ইতোমধ্যে শাকির পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। শিশির সিক্ত ঠাণ্ডা নরম মাটিতে পা ফেলতে নাকি ভালোই লাগছে। আমার হাতের হাতমোজা নোংরা হয়ে যাবে বলে জুতা আর হাতে নিলাম না।
ছোট্ট গ্রামটা পার হয়ে আবারও খোলা ধানী জমি। চাঁদের আলোয় অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে গাছগাছালি। আমি সেরকম একদিকে হাত উঁচিয়ে বললাম, ওটাই বোধহয় আমাদের বাড়িটা। শাকির আর আকবর বললো, না ওটা না, বরং ওদিকে- অন্যদিকে দেখালো ওরা। পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো আকবর। হাঁটতে হাঁটতে চলেছি বাড়ির পথে। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়। শাকির জানালো কী হয়েছিল ওখানে, দুইবার কি তিনবার ওর পায়ে আঘাত করেছে কিছু একটা, বাধা দিতে চেয়েছে। আমি যুক্তি দেখাতে চাইলাম, ওটা নাড়ার কাজ; পা যখন সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন উঁচু হয়ে থাকা নাড়ায় আটকেছে, তাই এমনটা মনে হয়েছে। কিন্তু যুক্তিবিদ শাকির বললো অন্যকথা, না, আঘাতগুলো সামনে থেকে আসেনি, এসেছে পেছন থেকে, ঠিক গোড়ালির উপরের অংশে। এর কী ব্যাখ্যা?
আমরা কোনো কথা না বলে বাড়িতে গিয়ে পুকুরে পা ধুয়ে, বাইরে বাঁশগুলো ফেলে, কৌশলে দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকলাম। রাত তখন পৌনে ২টা। পুরো এক ঘণ্টার অভিযান শেষে ফিরেছি আমরা। ওরা মনে করেছিল, সাজু চাচা ঘুমিয়ে পড়েছেন; কিন্তু আমি জানতাম, তিনি ঘুমাতে পারবেন না। কারণ আপাতদৃষ্টে তিনি আমাদেরকে বিপদে ঠেলে দিয়েছেন। সত্যিই তিনি ঘুমাননি; ভিতরে ঢুকতেই কথা বলে উঠলেন। …সবকিছু ঠিকঠাকমতো রেখে রাতের মতো অভিযান রোমন্থন করতে করতে ঘুমাতে গেলাম। তবে কিছুই না দেখতে পাবার হতাশাটা কাটাতে চাইলাম স্বপ্নে। মনে মনে প্রত্যাশা করলাম, ঘুমে যেন জ্বিনেরা দেখা করে আমাদের সাবধান করে দেয়, ‘ওখানে গিয়ে ভালো করোনি’। কিন্তু স্বপ্নে কিছুই দেখলাম না।
সকালে অন্যান্য দিনের তুলনায় ঠান্ডাও পড়লো খানিকটা। নাস্তার টেবিলে বুক উঁচিয়ে সবাইকে বলে বেড়ালাম আমাদের কীর্তিগাঁথা যে, সবার মানা করাসত্ত্বেয় আমরা ঠিকই গিয়েছিলাম রাতের অন্ধকারে জ্বিনের খোঁজে। জানলাম, যে আউয়ালকে পিছনে রেখে গিয়েছিলাম আমাদের উদ্ধারের জন্য, সে সারারাত ঘুমিয়েই কাটিয়েছে; মনে করেছিল, আমরা ভয় পেয়ে শেষ পর্যন্ত যাবোই না। আর আশ্চর্য হলাম, পরিস্থিতির কারণে করা কোনো কোনো বিষয় তখন আমাদের কাছে হাস্যস্পদ হয়ে উঠছে। আমরা হাসছি প্রাণ খুলে- ‘ঐ গাছ দুটোতে কিছুই নেই’।
ঘটনা # ৫
সেদিন দুপুর থেকেই সাজু চাচার মাথাব্যথা শুরু হলো- প্রচণ্ড মাথাব্যথা যাকে বলে। আমরা বাড়িতে আসার পর থেকেই তিনি আমাদেরকে সবসময় সঙ্গ দিচ্ছিলেন, কখনও ক্রিকেটে, কখনও ক্যারাম খেলায়, কখনও মনোপলি খেলায়। কিন্তু মাথার ব্যথা এতো তীব্র হয়ে গেলো যে, তিনি নিশ্চুপে তাঁর ঘরে বিছানায় পড়ে রইলেন। এমনকি আমরা যে ক্রিকেট খেলছি, বল এসে টিনের চালে পড়ছে, তাতেও তিনি আপত্তি করছেন, কারণ আওয়াজে তারা মাথার ব্যথা আরো প্রচণ্ড হচ্ছে। দুপুরে আমরা যখন খেলা থামিয়ে চা খাচ্ছি, তখনও চায়ে আসক্ত সাজু চাচা চা ফিরিয়ে দিলেন। কম্বল গায়ে দিয়ে মাথায় ভিক্স লাগিয়ে পড়ে থাকলেন বিছানায় গা লেপ্টে নিয়ে। আমরা এসে দেখে যাচ্ছি তাকে, কিন্তু মাথাব্যথা সারিয়ে তোলার জন্য মাথা টিপে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হচ্ছেন না।
আমার মাথায় অনভিপ্রেত একটা সম্ভাবনা উঁকি দিলো, গতরাতে জ্বিনেরা আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি ঠিকই, কিন্তু তাদের কেউ নীরবে হয়তো এসে পড়েছিল আমাদের তিনজনের কারো সাথে করে। গ্রাম্য লোককথায় শোনা যায়, বাজারের ব্যাগে করে ভূতেরা বাড়িতে চলে আসে। এখানে হয়তো তারা শাকিরের ব্যাগে করে, কিংবা নিস্পৃহ হয়ে আমাদের কারো ঘাঢ়ে করেই হয়তো চলে এসেছে। আর এসে আশ্রয় নিয়েছে সাজু চাচার মধ্যে। ঠিক একই অবস্থা তাঁরও, যেমনটা আউয়ালের মধ্যে দেখেছিলাম ক’দিন আগে।
একেবারে অযৌক্তিক না হলেও, অবৈজ্ঞানিক এই সম্ভাবনার কথা শাকির আর আকবরকে বললে, দুজনেরই চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল। শাকির বললো, কাল রাতে আমরা ঘরে ঢোকার আগ মুহূর্তে আমার একবার মনে হয়েছিল যে, আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাতে হাত ছুঁইয়ে ঘরে ঢোকা উচিত। কিন্তু তোমাদেরকে আর বলিনি, পরে ভুলে গেছি। ওটা করা উচিত ছিল। মানে, আমার যুক্তিকে শাকির সমর্থন করলো।
বিকেলের দিকে আমি মশারি টাঙ্গিয়ে দিলাম সাজু চাচাকে। তাঁর মাথাব্যথার কোনো উন্নতি হচ্ছে না তখনও। আমি মনে মনে [হুজুর] সুফিয়ান সাহেবকে ডেকে আনার চিন্তা করলাম। এও ঠিক করে নিলাম, তাঁকে কিছুই জানানো যাবে না, শুধু সাজু চাচাকে মাথাব্যথা সারাতে ফু দিতে বলবো। তখন তিনি যদি জ্বিনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলেন, তাহলে সেটা বিজ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করা যাবে। মশারির ভিতরে অর্ধ্বেক গা ঢুকিয়ে ভিক্সলাগিয়ে মাথাটা ভালো করে টিপে দিতে থাকলাম। মনে মনে সাজু চাচার অসুস্থতার জন্য নিজেকে দোষারোপ করছি, আর তাঁর আরোগ্য কামনা করছি।
পরিশেষ
এতো কিছুর পর যারা ঘটনাগুলোর মধ্যে পরম ভৌতিক ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, তাদেরকে এবারে চরম হতাশ করতে হচ্ছে। কারণ এপর্যন্ত ঘটা প্রতিটা ঘটনার বৈজ্ঞানিক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে। একে একে বলছি:
প্রথমত, হাই স্কুল সম্পর্কে আমাদের কারো মধ্যে অতোটা ভীতি কাজ না করলেও আউয়াল এই স্কুল সম্পর্কে ভুক্তভোগী। তাই সে যে বেশ বড় ধরণের ভীতি নিয়ে ওখানে গিয়েছিল, সেটা নিশ্চিত। আর যে ভয়কে সাথে নিয়ে গেছে, সে-যে ভয়ের কারণে রাতে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। কারণ আমি মনে করি:
মানুষ ভয় পায় বলেই ‘ভয়’ পায়।
তাছাড়া সেদিনই বিকেলে সে সিলেট শহর থেকে ট্রেনে চড়ে এসেছে। বাড়িতে এসে সন্ধ্যা থেকেই সে মাথাব্যথা করছিল বলেছে, তাছাড়া অর্ধ্বেক পথই নাকি ট্রেনে কোনো এক মহিলাকে সীট দিয়ে দাঁড়িয়ে এসেছে। আর আসার পথে ঠাণ্ডা বাতাসকে খাটো করে দেখলে চলবে না। সব রকমের শারীরিক দুর্বলতা গিয়ে মিশেছে ঐ জ্বর আর মাথাব্যথায়। …সুফিয়ান সাহেব সম্পর্কে আমি এতটুকু বলতে পারি, তিনি মিথ্যে বলবেন না। তাছাড়া তিনি ইসলাম ধর্মের খুব বিজ্ঞ একজন আলেম। এখানে হয়তো তিনি একটা সহজ সূত্র কাজে লাগিয়েছেন, রোগীকে তার রোগ বাতলে দিয়েছেন। কোনো রোগী যখন দেখে, ডাক্তার তার রোগ বাতলে দিয়েছেন, তখনই সে অর্ধ্বেক সুস্থ হয়ে যায়; রোগী অসুস্থ থাকে, যখন ডাক্তার কী রোগ হয়েছে, তা-ই চিনতে পারেন না। তাই হয়তো সুফিয়ান সাহেব মাথাব্যথার প্রতি আউয়ালের মনোযোগ হটাতে সহজ সূত্রে বলেছেন ‘জ্বিনে ধরেছে’; রোগী সুস্থ করতে স্বাভাবিক একটা নিষ্পাপ মিথ্যে কথা বলেছেন। তাছাড়া আউয়াল যে গিয়ে তাঁকে গতরাতে হাই স্কুলে যাবার ঘটনা আগবাড়িয়ে বলেনি, তা-ইবা কী করে বলি?
এব্যাপারে আমি পরে আউয়ালের কাছে কী হয়েছিল জানতে চাইলে, আউয়াল জানায়, সে প্রথমে কিছুই তাঁকে বলেনি। শুধু মাথাব্যথার জন্য ফু দেয়াতে গিয়েছে। সুফিয়ান সাহেবই জানতে চেয়েছেন, কোথাও গিয়েছিলে নাকি? সে যখন বলেছে হাই স্কুলের কথা, তখন তিনি বলেছেন, ওখান থেকেই বাতাস লেগেছে। তথৈবচ!
দ্বিতীয়ত, দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে আউয়াল গিয়েছিল হাওরে। তাছাড়া সে কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল না। প্রচণ্ড রোদ, প্রচণ্ড আলো মাথাব্যথার অন্যতম কারণ, অস্বীকার করার কিছুই নেই। তাছাড়া আমার পানির তৃষ্ণা পাচ্ছিলো। যদিও আউয়াল বলছিল, ঐ একগ্লাস পানিই তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- হয়তো ভিতরে ঠান্ডা, বাইরে উত্তপ্ত রোদ- বিপরীত পরিবেশে শরীর খাপ খাওয়াতে পারছিল না। খারাপ লাগা স্বাভাবিক। …আর ‘ছোট মাছের ব্যাগে ওজন লাগবে কেন?’ প্রশ্নটার উত্তর দেয়া যায় একটা ধাঁধাঁ দিয়ে: এক কেজি তুলা, আর এক কেজি লোহার মধ্যে কোনটা বেশি ভারি? উত্তর হলো, দুটোই সমান। এখানেও তেমনি সমস্যা থাকছে তখনই যখনই ‘ছোট মাছকে আকৃতি বা প্রকৃতিগতভাবে ওজনহীন মনে করা হচ্ছে’। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্যাগ ভর্তি ছোট মাছেরও বেশ ভালো ওজন হতে পারে। পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসম্মত।
তৃতীয়ত, ঈদের দিন পেট খারাপ থেকেই ওর শারীরিক দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া আগের রাতে ঈদ উপলক্ষে বানানো তেলে ভাজা পপ, সিঙ্গাড়া খেয়েছে সে। ওগুলো যে ওর পেট খুব সানন্দে মেনে নিয়েছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। বদহজম হতেই পারে।
চতুর্থত, (এই যুক্তিটা শাকিরের দেয়া) মানুষকে ‘আউরি লাগিয়ে দেয়া’ খুব সহজ, কারণ ব্যাপারটা হয় রাতে। রাতে চাঁদের আলো থাকাসত্ত্বেয় আমি দুবার ভুল পথ ধরতে যাচ্ছিলাম, পথ চিনতে ভুল করছিলাম; সেখানে অন্ধকার রাতে কোনো বাতি সাথে না থাকলে, কিংবা দূরে আলো ফেলার উপযোগী ভালো টর্চ সাথে না থাকলে একজন লোক খুব স্বাভাবিকভাবেই কম্পাসহীন হাঁটাপথে পথ ভুল করে বসবে। তাছাড়া গ্রাম্য ‘আউরি লাগা’র ঘটনাগুলো বড়জোর আধাঘণ্টা কি একঘণ্টার, কামরূপ-কামাক্ষা’র গল্পের [কিংবা কাহিনীর] মতো সারারাতের নয়। …পথ ভুল করবে মানুষই, দোষ গিয়ে পড়বে জ্বিন-ভূতের উপর- যুক্তিটা যথেষ্ট।
পঞ্চমত, বিজ্ঞানমনষ্ক শাকির পিছন থেকে পা আঁকড়ে ধরাকে অবৈজ্ঞানিক ভূতুড়ে মনে করছে, কারণ সে নাড়ার প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না। আসলে ঘটনা ঘটছে ঠিক একটা রিঙের মতো: একটা রিঙের মধ্যে পা ঢুকিয়ে পা সামনের দিকে বাড়ালে রিঙটাও সামনের দিকে যাবে, আর যখনই পা থেমে যাবে, তখনই পায়ের সাথে চলা রিঙটার পিছনের দিকটা এসে পায়ে আঘাত করবে। এই আঘাতের মাত্রাটা লোহার রিঙে এক রকম (সমানুপাতিক) হবে, প্লাস্টিকের রিঙে এক রকম (প্রায় সমানুপাতিক) হবে, কিন্তু নাড়ার ক্ষেত্রে যে আঘাতটা হবে, তার নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। কারণ নরম নাড়ার সামনের টানটা সামান্য হলেও মাটির সাথে লেগে থাকার কারণে পিছনের টানটা একটু জোরে হওয়া স্বাভাবিক, একইভাবে পেছনের তুলনায় সামনের টানও জোরে হতে পারে। যদিও শাকির এই ব্যাখ্যা পছন্দ করছে না, সে এই আঘাতকে ‘কোনো কিছুর’ লেজ বলতেই বেশি আগ্রহী। ওটা যে জমিতে বাস করা ইঁদুরের লেজ নয়, তারও কোনো প্রমাণ সে দিতে পারছে না।
ষষ্ঠত, সাজু চাচা সুফিয়ান সাহেবের ফু ছাড়াই একটা মাথাব্যথার বড়ি খেয়ে, আর বিকেলে আমি মালিশ করে দেবার পর এক কাপ চা খেয়ে সম্পূর্ণ চাঙ্গা হয়ে উঠে বসেছেন। মাথাব্যথা সম্পূর্ণ বিদায়। তাছাড়া গ্রামের বাড়ির সবার মধ্যে আউয়াল আর সাজু চাচার মাথাব্যথার কথা প্রায়ই শোনা যায়- বাড়িতে মারাত্মক মাথাব্যথা হিসেবে তাদের দুজনেরই কিছুটা বদনাম আছে। সাজু চাচার এরকম মারাত্মক মাথাব্যথা আমার আরেকবার দেখার সুযোগ হয়েছিল, সেবার কোনো জ্বিন-সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
কিন্তু কথা সেখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানের কাছে কোনো কিছু ‘আছে’ বলতে হলে যেমন দরকার প্রমাণ, তেমনি কোনো কিছু ‘নেই’ বলতেও দরকার প্রমাণ। আমরা সেরাতে শুধু ‘আছে’র পক্ষে কোনো প্রমাণ পাইনি। কিন্তু ‘নেই’ যে, তাও প্রমাণ করে দিতে পারছি না। জ্বিনদের পাওয়া যাবে হিন্দু ধর্মে ‘ভূত’ (আত্মা, প্রেতাত্মা) শব্দটি দিয়ে। তাই জ্বিন বলুন আর ভূতই বলুন, তাদেরকে অস্বীকার করতে পারছি না, তবে তারা যে আছেই, তাও বলতে পারছি না।
তাছাড়া বিজ্ঞান কোনো পরম জ্ঞান নয়, বিজ্ঞান অসমাপ্ত। অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কাছে নেই। আর বিজ্ঞানের শেষ থেকে উৎপত্তি ধর্মের। তাই অব্যাখ্যাত বিষয়গুলোর পরিচিতি পাওয়া যায় ধর্মের দ্বারস্ত হয়ে। প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞান যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না, তখন প্রমাণ ছাড়াই ধর্ম যুক্তি দেখায়। অদৃশ্যে বিশ্বাস করা না করা যদিও মানুষের এখতিয়ার, তবুও অদৃশ্যে বিশ্বাস করতেই বলেছে ইসলাম। …বিশ্বাস কি করবো? সে নাহয় ব্যক্তির উপরই ছেড়ে দেয়া যাক?