মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৬৭- প্রতিদান

লেখিকাঃ নুরে-ই-ইয়াসমিন ফাতেমা

কবিতার মতো রিমঝিম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে গত রাত থেকে। থামার কোন নাম নেই। গোঁধুলী কোথা থেকে শুরু হচ্ছে, কখন থেকে ভোর হচ্ছে কিছুই আপাতত বুঝার উপায় নাই। গলি গলিতে রাস্তায় পানি জমাট বেধেছে, ছোট ছোট বাচ্চারা সকাল থেকে ওই নোংরা পানিতে লাফালাফি করছে। বাজারে কেউ যেতে পারছে না বলেই প্রচুর ফেরিওয়ালা গলি গলিতে হাক ডাক শুরু করেছে। মাছ, শব্জি, মুরগী এমনকি মশলাপাতিসহ বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে বিক্রয় করছে, আর শাড়ি ভিজিয়ে খুব আনন্দ নিয়ে ঘরের বউরা কিনে নিচ্ছে।
খিলগায়ের গোরানের দুই বেডরুমের চারতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা বানু সব দেখছিলেন। ভালই লাগছিল তবে একটু ক্ষিদেও লেগেছিল। কিন্তু লজ্জায় ফ্রিজ খুলে দেখে নেয়নি কোন খাবার আছে কি না। কারণ বাসাটা তো আর তার না, পুত্র ও পুত্রবধুর। ঢাকায় এসেছে দুই দিন হলো একমাত্র ছেলে আলী উসমানের বাসায়, ডাক্তার দেখাবে আর দুই বছরের নাতিকে দেখবে বলে। নাতি জন্মের পর এই সুযোগ হলো ছেলে উসমানের মাকে ঢাকায় ডেকে পাঠানোর।
গ্রামের বাড়ির পাশের বাড়ির ভাই সম্পর্কের মতি মিঞার ছেলের সাথে এসেছে। সাথে হাঁস, মুরগীর ডিম, নানান জাতের হাতে বোনা সব্জি, সরিষার তেল নিয়ে এসেছে ছেলে নাতিকে দেয়ার জন্য। ছেলে ঢাকায় চাকুরি পাওয়ার তিন বছর পর্যন্ত মায়ের সাথে ভালভাবেই যোগাযেগ করতো। বছরে লম্বা তিন চার দিনের ছুটি পেলেই গ্রামে চলে আসতো আর মায়ের জন্য এটা সেটা নিয়ে আসতো। রাতে মায়ের বুকের কাছে মাথা রেখে ঘুমাতো আর শাড়ির আঁচল নিয়ে উসমান নিজের মাথা ঢেকে রাখতো। মাঝে মাঝে মায়ের গা শুকতো। তখন তারাবানু বলতো আহ্লাদি গলায়- এমন করিস কেন? শাড়িটাতো দুই দিন ধরে সাবান দিয়ে ধুইনা।
– কেন মা?
– বাবা! প্রতিদিন যদি সাবান দেই, আলাদা একটা খরচ আছে না?
– ছেলে বলতো, কেন, তোমারে টাকা দেই না?
– বাপরে তোর টেকা কি সাবান দিয়া ধুইলে হইবো? তোরে পড়াইতে গিয়া কতজন টাকা পায় ঐগুলি শোধ করতে হবে না? ছেলে কিছুই বলে না, শুধু যাবার সময় বলেছিল-
– মা তুমি কোন চিন্তা করবা না, আমি তোমারে একটা দুই তালা কোঠা বানাই দিবো। আর সাবান দিয়া গোসল করবা ডেইলি, দরকার হইলে তোমার জন্য সাবানের ফ্যাক্টরী কইরা দিবো। কথাগুলি বলে হাটাহাটি শুরু করেছিল। তারা বানু পিছন থেকে বলেছিল,
– বাপরে, আমার জন্য কিছুই করতে হবে না, তুই সুখে থাক- বলতে বলতে চোখে পানি এসেছিল।
হাত তোলে আসমানের দিকে চেয়ে থাকতো। একবার তো একটা মোবাইল ফোন নিয়ে এলো, এনে বলল-
– মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলার জন্য মনটা আগলা হয়ে যায়, এই লও ফোন, তুমি আমারে ফোন দিবা আমি তোমারে ফোন দিবো।
কি আদর, কি ভালবাসা রে, কি যতন, আহ!
বারান্দা থেকে টিভি রুমে বসে এমন সময় ছেলে আসে মায়ের সামনে, বলে, মা তুমি এতো সকালে কেন উঠলে? ঘুমাই থাক, এটা গ্রাম না; শহর। আমি একটু পর অফিসে যাব, তুমি নাতি নিয়া থাইকো। সন্ধ্যায় ডাক্তারের নাম লিখাবো দেখি সময় পেলে, বলেই রান্নাঘরে ঢুকে। তারাবানু ছেলের পিছন পিছন যায়।
– বাবা তোর কি করতে হইবো আমারে ক’তো, আমি কইরা দেই। ছেলে বলে বিরক্ত হয়ে- মা তুমি ভীতরে গিয়ে বস, আমি চা বানাবো, চা খেয়ে গোসলে যাব।
– বাবা আমি বানাই দেই, তোর না হাত পুইড়া যাইবো।
– মা আমি এখন ছোট না, তুমি যাও। এমন ভাবে বলল, আর কিছুই বলতে পারল না। তারাবানু ভেবেছিল ছেলের সাথে নিজেও এক কাপ চা বানিয়ে নিবে, কিন্তু হলো না। মুড়ি টুরি পেলেও হতো, ক্ষিধেটা চাঙ্গা দিয়ে ওঠছে। গ্রামে তো উঠেই তারাবানু মুড়ি খায়, গুড় দিয়ে না হয় শুকনা নারিকেল দিয়ে।
এমন সময় বউ মা উঠে চোখ পিট পিট করে। ফর্সা মুখটা আরো ফর্সা লাগছে। এমনিতে উসমানের বউটা বেশ সুন্দরী, ছেলের পছন্দ ভাল। কিন্তু মেজাজ গরম, আদব কায়দা কম। গ্রামের বউরা তো শ্বাশুড়ির সামনে আসতেই ভয় পায়। আর তারা বানুমনে হয় বউমাকে একটু ভয় পায়। এমন সময় ছেলে দুই কাপ চা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসে, এক কাপ বউমাকে দেয় আর এক কাপ নিজে মুখে দেয়।
খুব মন খারাপ হলো তারাবানুর। ছেলে জানে সকালে উঠে মা এক কাপ চা খায়। কিন্তু মন খারাপটা তারাবানু গায়ে মাখলো না, বসেই রইল। ঐদিকে ছেলে বউ কথা বলে যাচ্ছে, কি বাজার করবে, কি রান্না করবে। কালকে বউমার বাপের বাড়ি রাতের খাবারের দাওয়াত। ঢাকার ডি.সি. নাকি আসবে ঐ দাওয়াতে, তাই ওরা যাবে।
দুপুরের ভাত খেয়ে বউমা গেল বাবুকে ঘুম পাড়াতে, তারাবানু বলেছিল, নাতিকে সে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। কিন্তু বউমা রাজি হলো না। দুপুরে ঘুমের অভ্যাস ছিল না তাই, তসবিহ নিয়ে বসল, ইয়া সালাম, ইয়া মুমিন পড়তে থাকলো।
তারা বানুর ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সতের বছরে পুত্রধন উসমান যুবতী মায়ের কোল জুড়িয়ে পৃথিবীতে আসে। উসমানের বয়স যখন পাঁচ কি ছয় উসমানের বাবা কলেরা হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মারা যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পরও তারা বানু নিজের ভিটে ছাড়েনি। নিজেই ক্ষেতে কাজ করে, সমিতি করে যে ভাবেই হোক ছেলেকে মেট্রিক পাশ করালো। খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল উসমান, সারা গ্রামের সব স্কুলের মধ্যে প্রথম।
এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে অনেক চেষ্টা করেও যখন ঢাকার হোস্টেলের আর অন্যান্য খরচ যোগাড় করতে পারেনি তখন বাবার বাড়ির ও নিজের স্বামীর দেয়া অল্প কিছু সোনা ছিল তা বিক্রয় করে দিল। তারপরও ঢাকায় মোটামুটি একটা ভাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। তারপরও কোচিং ক্লাশ করা, থাকা-খাওয়া যেন পুত্র ঠিকমতো করতে পারে, দিনের বেলায় কাজ করেও রাতের বেলা পাটি বানাতো যেন হাট বারে বিক্রয় করতে পারে।
মাসে একবারও মাছের তৃপ্তি নেয়নি তারাবানু। প্রতিটি খরচ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে মাসের শেষে সব টাকা ছেলেকে পাঠিয়ে দিত। ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হলো উসমান তখন তেমন টাকা পাঠাতে হতো না, নিজেই টিউশনী করে খরচ চালিয়ে নিত। তবে অনেক কর্জ হয়ে গিয়েছিল তারাবানুর।
তারাবানুর ভাইয়া অনেকগুলি বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। ছেলেসহ নতুন স্বামীর ঘর করা তারাবানুর জন্য সম্ভব ছিল না। একজন তো বেশ কিছু জমি তারাবানুর নামে দিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তারাবানুর এক কথাই, ছেলেই তার সব, আর কিছুর প্রয়োজন নেই। কত স্বপ্ন, কত আশা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে প্রতীক্ষার বাঁশি বাজিয়ে বুকের ভিতর বুনে রেখেছিল।
রাত আটটায় উসমান আসে। এসেই মাকে বলে, তোমাকে আজ ডাক্তারের কাছে নেয়া যাবে না। দেরি করে ফেললাম, অফিসে প্রচুর কাজ ছিল। কথাগুলো এমনভাবে বলল যেন বলার জন্য বলা। আর মায়ের দিকে একবারও তাকালো না কেন? উসমানের কি মন খারাপ কোন কারণে? তারাবানু বলল, থাক বাবা, এতো তাড়া কিসের আস্তে ধীরে দেখালেই হবে। এখনো অনেক সময় আছে রে। মায়ের কথা শুনে কেন জানি উসমান নিজের স্ত্রী মুনার দিকে তাকায়। তারপর বলে, মা দেরি করবে কেন? তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি চলে যাবে না? বাড়ি তো খালি। আর এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে তোমার মনও টিকবে না।
উসমানের কথা শুনে তারাবানুর বুকের ভিতর ধক করে উঠে, কি বলছে উসমান? ও কি ঐ উসমান যাকে মাঝে মাঝে একটা মুরগীর ডিম ভেঁজে দিলে তার অর্ধেকটা জোর করে মায়ের ভাতের সাথে মেখে দিতো। স্কুল থেকে এসে শুধু মা মা মা গো বলে চিৎকার করে উঠান ফটিয়ে দিত। কিছুই বলতে পারে না তারাবানু। মাথা নিচু করে নিজের রুমে গিয়ে বসে।
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল তারাবানুর ছেলের বাড়িতে, ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। ডাক্তার হাড়ের ব্যথার ওষুধ দিয়েছে, দুই মাস খেতে বলেছে। এর মধ্যে নাতিটার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। সুন্দর করে থেকে যায় দাদীর কাছে। এখন মাঝে মাঝে বৌ-ছেলে নাতিটাকে দাদীর কাছে দিয়ে টুকটাক বাহিরে যায়। অল্প দিনে তারাবানুর ভীতরে ছোট নাতিটাকে আপন করে নিল, দেখতে যেন ছোট্ট উসমানের মতোই শান্ত ধীরস্থির। ইদানিং বাড়ির কথা আর মনে পড়ে না, ভালই লাগছে তার। তার একটাই দুঃখ, ছেলেটা আগের মতো কথা তো বলে না, যা করবে বৌকে জিজ্ঞাসা করে করে। বিশদিন পর ছেলে একদিন অফিস থেকে এসে বলে, মা তুমি কবে দেশে যাবে, টিকিট কাটতে হবে না?
তারাবানু বলে, মাত্র নাতিটা দাদী চিনতে শুরু করেছে, আর দুই দিন পর যাই রে। ইদানিং দুপুরে বৌমা খাওয়ার সময় ডাকে না। শুধু বলবে, আপনার যখন ইচ্ছা খেয়ে নিবেন, আমার আশায় বসে থাকবেন না।
বিকেল হলেই নিজের রুমে বসে থাকে, না হয় পাশের বাড়ি চলে যায়। উসমান আসলে সেজেগুজে বসে থাকে পাশে। কোন কথাই বলতে পারছে না তারাবানু।
গ্রামের নিজের ভিটায় পুকুরটা কাটাতে হবে, একটু তার জন্য কিছু টাকা দরকার। ছেলে বলেছিল একদিন দুই তালা কোঠা করে দিবে, এখন তো মনে হয় তা আর সম্ভব না। কিন্তু বর্তমান যে টিনশেড বাড়িটা আছে তারাবানুর, সেটার টয়লেটটা তার রুম থেকে একটু দূরে, রাতে বাথরূমের প্রয়োজন হলে বড় ফটক খুলেই টয়লেটে যেতে হয়। তাই ছেলেকে বলে তার নিজের রুমের সাথে লাগোয়া বাথরূম কাম টয়লেট বানাতে হবে।
সামনে শীত পড়ে যায়। তাই ঘরের মধ্যে মেহমানসহ টুকিটাকি কাজ লেগেই থাকবে।
সন্ধ্যায় ছেলে উসমান আসে বাসায়, চেহারাটা একটু মলিন। তারাবানু ভাবে দুপুরে মনে হয় ছেলেটা ভাত খেতে পারেনি। ছোট বেলায় দুপুরের ভাত দেরি করে খেলেই উসমানের মুখটা এমনই মলিন হয়ে যেত। উসমান ঘরে ঢুকে নিজের ছেলেকে কোলে তোলে নিত, বুকের কাছে টেনে নিত। ছেলে খিল খিল করে হাসতো, একটু পর বৌমা এসে স্বামীকে বলে সে কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চায়। তখন উসমান বলে, তুমি এখন যাবে কিভাবে, মা আছে না? খালি বাড়িতে উনি কিভাবে থাকবেন?
মুনা মুখের রেখা পরিবর্তন করে বলে, আমি কি করবো তাহলে? তোমার মা যতদিন থাকবেন তার জন্য কি আমি বাপের বাড়িতে যাব না? সারাদিন বাসায় একা হাতে সব সামাল দিতে হয়, ঘরে থেকে থেকে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে বাধা দিও না, আমি যাবই। উসমান শুধু একবার মায়ের দিকে তাকায়, তারপর রুমে ঢুকে যায়।
তারাবানু বলে বৌমাকে,
– মা তুমি যাও বাপের বাড়ি আমার কোন অসুবিধা হবে না। উসমানের আর আমার রান্না আমি একাই খুব করতে পারবো। কতদিন নিজের হাতের রান্না ছেলেকে খাওয়াতে পারি না।
তারা বানুর কথা শুনে মুনা চমকে উঠে-
– মা আমি বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও গেলেও আপনার ছেলেকে সাথে নিয়ে যাই। পুরুষ মানুষ একটু খেয়াল রেখে চলতে হয়।
তারাবানু মুনার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়, বলে-
– মা তুমি এসব কি বলছ? স্বামীকে বিশ্বাস করতে হয়, না হয় সংসারে সুখ আনা কঠিন। আর ছেলে থাকবে আমার সাথে, তোমার কোন চিন্তার বিষয় নাই। শ্বাশুড়ির কথা শুনে মুনা কিছু বলে না, রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এমন সময় খুব জোরে জোরে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায় তারাবানু ছেলে আর ছেলের বৌয়ের। একটু পর ছেলে রুমের বাহিরে এসে বলে-
– মা তুমি কি কথা বলেছ মুনাকে?
তারাবানু বলে-
– আমি তো বলেছি তাকে বাপের বাড়ি যেতে, আমি থাকতে পারবো একা। ও বলল তোকেও নিয়ে যেতে, তাই বললাম কোন অসুবিধা হবে না, আমি দেখে রাখবো এই তো।
– মা তুমি কেন বলতে গেলে এসব? মুনা এই ধরনের কথাবার্তা পছন্দ করে না। খামাকা গন্ডগোল বাড়ায় দিলা। বলেই বারান্দায় চলে যায়।
সারারাত তারাবানু আর ঘুমাতে পারে না। বুকের মধ্যে চাপা একটা কষ্টে জর্জরিত হতে থাকে। এই ছেলের জন্য তারাবানু পুরা জীবনটাই দিয়ে দিল, কত ছোট ছোট কাজ করে কমবেশি খেয়ে টাকা বাঁচিয়ে রাখতো তারাবানু। ছেলে সবই জানে, তারপরও এমন কেন করল উসমান? আজ বউ-ই সব হয়ে গেল তার, মা পর হয়ে গেল। এক সময় ভাবলো কালকে কি বলবে ছেলেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে তারা বানুকে? কিন্তু নাতিটার কথা মনে পড়তে চোখ ভিজে গেল, যাই হোক সকালে কথা বলবে তারাবানু।
খুব সকালে নামাজ পড়ে তসবিহ নিয়ে বারান্দায় বসে, আজকে জুম্মাহ, উসমানের বাবা বেঁচে থাকতে এই জুম্মার দিনগুলিতে খুব ভোরে উঠতেন তিনি। নিজের হাতে ছেলেকে গোসল করিয়ে মসজিদে নিয়ে যেতেন লাল পাঞ্জাবী পরিয়ে। সারা বিকাল বাহিরে বাহিরে মাঠে-জঙ্গলে ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বাসায় ফিরতো বাবা-ছেলে নাক-মুখ লাল করে।
তখন তারাবানু বলতো-
– আপনি তো ছেলেকে ঘরছাড়া করবেন। এতো বাহিরে বাহিরে ঘুরালে নষ্ট হয়ে যাবে, পড়াশোনা করবে না, মা-বাবাকে মানবে না।
তখন তার বাবা জবাব দিয়েছিলেন-
– তারাবানু, আমার ছেলে একদিন গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে, তোমাকে মাথায় করে রাখবে। আমি হবো রাজা, উসমান হবে রাজপুত্র…. হাঃ হাঃ করে হাসতো।
সকাল দশটার দিকে উসমান উঠে চা বানিয়ে নেয় দুই কাপ, এক কাপ মার হাতে উঠিয়ে দেয়। তারাবানু চমকে উঠে, আজকে ছেলের কি হলো? নিজেই চা বানিয়ে মাকে খাওয়াচ্ছে। খুশিতে তারাবানুর চোখ চক চক করতে থাকে। আর ভাবতে থাকে, আহারে সারারাত কি যা তা ছেলের ব্যাপারে চিন্তা করেছে। ছেলে কি আর পর হতে পারে? ফুটা ফুটা রক্ত দিয়ে ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করেছে। বাপমরা উসমানকে সব মায়েদের মতো আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখেনি; বরং নিজের চামড়ার ভিতরে লেপ্টে রেখেছে, সবসময় আত্মনির্ভরশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছে।
হঠাৎ উসমান মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মা কিছু মনে করো না, তুমি বরং এবার বাড়ি চলে যাও, পরে আর একবার এসে ডাক্তার দেখিয়ে যেও আর বেশ কিছুদিন থেকে যেও।
তারাবানুর বুকে যেন কেও এটম বোমা ফাটিয়ে দিল। আর তার ভিতরের কলিজাটা ছিটকে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। চোখের পানিটা কোনভাবে আটকিয়ে বলল,
– কেন বাবা? কোন কিছু হয়েছে? বউমা কি তোমার উপর রাগ? বাবা আমি আসি, আমি তুমি মুনার কাছে মাফ চেয়ে নিবো।
মাথা ঝাঁকিয়ে উসমান বলে-
– না মা, মুনা আমাকে কিছু বলেনি, ও একটু এমনি মাথা গরম, কিন্তু ভাল মেয়ে। বড় ঘরের মেয়ে একটু সামলে চলতে হয়। আমাকে ছাড়া ও আর কাউকে তেমন সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। তুমি বরং এখন চলে যাও, পরে প্রয়োজন বোধে আমি তোমাকে নিয়ে আসবো। বলেই উসমান উঠে নিজ রুমে চলে যায়।
তারাবানু চিন্তাই করতে পারে না উসমান এই কথাগুলি অকপটে বলে উঠে গেল কিভাবে? বউয়ের মন ভাল, স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না, এমনকি শ্বাশুড়িকেও না! মুনা না হয় যা ইচ্ছা তাই চিন্তা করতে পারে, কিন্তু নিজের পেটের সন্তান আজ বউয়ের জন্য মাকে ঠান্ডা মাথায় ঘর থেকে চলে যেতে বলল? উসমান কি একটুও মায়ের কথা চিন্তা করতে পারতো না? এই অসহায় মা আজ এভাবে চলে গেলে কি কষ্ট পেতে পারে? বউ বড় ঘরের মেয়ে হলেই কি পৃথিবীতে ছেলের কাছে মা মূল্যহীন হয়ে যায়? হায় রে কপাল! এই ছিল তারাবানুর কপালে? চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারে না। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকে।
সুন্দর করে আস্তে ধীরে ব্যাগ গুছিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল তারাবানু। এমন সময় উসমান ডাক দেয় মা বলে। তারাবানু ঘুরে তাকায়, দরজার ওপাশে উসমান দাড়িয়ে আছে।
– মা চল ভাত খেতে এসো, তারপর রওনা দিও।
তারাবানু উদাস হয়ে বলে, না বাবা ক্ষিধে নেই। চল আমাকে বাস স্টেশনে পৌঁছে দে। উসমান কাছে এসে বলে, কি বলছ মা, এতো দূর যাবে না খেয়ে? চলতো।
তারাবানু ভাবে, না ছেলের কোন কথা বা কাজে নিজের উপর আঁচড় লাগাতে দিবে না। চুপচাপ বউ-ছেলের সামনে খেয়ে নেয় তারাবানু।
পয়ত্রিশ বছরের লালিত ভালবাসাকে দাফন দিয়ে গ্রামের কোটাতে দিন কাটাতে থাকে তারাবানু। তবে চোখে তার কোন কথা থাকে না, মুখে তার হাসি নাই। উসমান বায়ান্ন বছরের বুড়ি মাকে আর ঢাকায় নিয়ে যায়নি, তবে মাসে মাসে মায়ের হাত খরচ পাঠিয়ে দেয়, ফোনও করে মাকে, মা তারাবানু ভাবলেশহীনভাবে কথা বলে, যেন বলার জন্য কথা বলা।
তারাবানুকে সবাই জিজ্ঞেস করে, কি তুমি যে আর ছেলের কাছে যাও না, ছেলেও তো আসে না। কি ব্যাপার? আমাদের বল- আমরা কি তোমার কিছুই না?
তারাবানু বলে, বলার কিছুই নেই। আমি ঢাকায় আর যাব না, ভালো লাগে না। তবে আমার উসমান আসবে আমার কাছে। মুচকি হাসি দিয়ে বলে। যেন রহস্যের বেড়াজালে আটকে থাকা কিছু চেতনার মতো।
আস্তে আস্তে গ্রামের চার পাশে পরিবর্তন আসে। স্কুল-কলেজগুলি বড় হতে থাকে, কোল্ড স্টোরেজগুলিতে কাজের পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিছু প্রতিবেশি যাদের নিয়ে তারাবানুর দিন যেত, তাদের মধ্য থেকে অনেকেই ঢাকায় পাড়ি দেয়। তারাবানুর সবকিছু জীর্ণ হতে থাকলেও নিজের চৌচালা কোঠাটা খুব শক্ত করে ধরে রাখে। সবকিছু গুছিয়ে রাখে, যেন হাতের নাগাল থেকে কোন কিছু হারিয়ে না যায়।
পচিশ বছর পর…
তারাবানুর বার্ধক্য শরীর যেন কোন কিছুর প্রত্যাশায় দুলতে থাকে সবসময়। কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও তারাবানু বুঝতে পারে যে, তার ভীতরে কিছু উতাল পাথাল করে প্রতিটি ক্ষণে।
পৌষ মাস। উঠনে বসেছিল ঔজ্জ্বল দ্বীপ্ত চোখ নিয়ে সামনের মাঠের দিকে চেয়ে। একটু আগে দুপুরের ভাত খেয়ে উঠানে মাদুর পেতে বসেছিল তারাবানু। টুকিটাকি ঘরের কাজ নিজেই সামাল দেয় এখনো, বড় কাজগুলি পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী বদুর বউ করে দিয়ে যায়। মাসে পাঁচ’শ টাকা দেয়। এমন সময় বড় মাঠের মাঝখান দিয়ে কে যেন একটু কুঁজো হয়ে তারাবানুর কোঠার দিকে আসতে থাকে। তারাবানু ছোট ছোট চোখগুলি দিয়ে সরুভাবে তাকায়, চেনা চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু সন্দেহ ভাবটা যাচ্ছে না। একটু কাছে আসতেই বুঝতে পারলো যে, তার প্রতীক্ষার পালা শেষ। একটু কুঁচকানো চামড়া দিয়ে জড়ানো উসমান এসে মায়ের সামনে দাঁড়ায়, হাতে মিডিয়াম সাইজের ব্যাগ। ব্যাগটা মাটিতে রাখে, মায়ের দিকে তাকায়, তার পরক্ষণেই হকচকিয়ে যায় মায়ের চোখের ভাষায়। উসমানের মনে হলো তারাবানু পচিশ বছর পরও ছেলেকে দেখে একটুও অবাক হয়নি। যেন উসমান আসবে মা জানতেন।
– মা তুমি কেমন আছো? করুন আর মিহি সুরে উসমান মাকে বলে।
তারাবানু মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা ভাল, কিন্তু তোর মুখ মলিন কেন? দুুপুরের ভাত খাসনি কেন? আয় খেতে আয় বলে উঠে দাড়ায়।
উসমান মায়ের দু’কাধ চেপে ধরে বলে, মাগো তুমি কেমনে জানলে আমি দুপুরের ভাত খাই নাই? ফোঁকলা দাঁতে একটু হেসে তারাবানু বলে, তোর চেহারা দেখেই আমি সবসময় বলতে পারি তুই খাইছিস কি না। চল ভিতরে চল।
উসমান বুঝতে পারছে না, মা তার এতো কথা এতোদিন পরও কেন মনে রাখতে পারলো। সেই ছোট বেলা থেকেই মুখ দেখেই উসমানের সবকিছুই মা বুঝতে পারতো। আর উসমানের মনে হলো, মা যেন জানতোই উসমান আজকে আসবে। মাথা চুলকাতে থাকে মায়ের হেটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
রাতের শান্ত নিরবতার মাঝে দুইটি প্রাণ এক হতে গিয়েও হয় না, দু’জনেই বার্ধক্যের পথিক। সমান একাকীত্বে, নিঃশব্দে যেন শ্বাস চলছে, কেউ যেন কারোটা টের না পায়।
রাতের খাবার খেল তারাবানু আর উসমান। খাবারের মাঝে কোন বাহুল্য ছিল না, কোন আতিথ্যও না। উসমান মায়ের দিকে তাকায় স্থির চোখে। বলে, মা একটা কথা বলতো- আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, তুমি মনে হয় জানতে আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। কি ভাবে মা? বলো না মা গো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে যে। তারা বানু পান ছেচ্ছিল, থামিয়ে ছেলের দিকে তাকায়-
– বাবা পচিশ বছর আগে তুই আমাকে যে ভাবে তোর বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলি তখন মনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম, অনেক পেয়েছিলাম রে বাবা! কিন্তু আমি জানতাম তোরও একদিন আমার অবস্থাই হবে। তাই আমি এই পচিশ বছর শুধু তোরই অপেক্ষায় ছিলাম। বাবারে আমি অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারিনাই আমার কোন দোষের কারণে তুই আমার সাথে এমন করলি? সেই থেকেই বুঝতে পেরেছি তুই আমার কাছে একদিন শূন্য হাতে ফিরে আসবি। তাই আমি সব গুছিয়ে রেখেছিলাম।
বৃষ্টির মতো টিপ টিপ করে উসমানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল, বলল উসমান মায়ের দিকে তাকিয়ে-
– মা তুমি তো জান পাঁচ বছর আগে স্ট্রোক করে মুনা মারা যায়। দুই ছেলে আর দুই বউমাকে নিয়ে থাকতাম। আমাকে ওরা সবাই দু’চোখে দেখতে পারতো না, অথচ আমার জীবনের সবকিছুই আমি তাদের দিয়ে দিলাম। কত ভালভাবে রেখেছি তাদের, তারপরও ওরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে চাইলো। তখন আমি তাদের বলে তোমার আশ্রমে চলে এসেছি সারা জীবনের জন্য। মা তুমি আমাকে আশ্রয় দিবে না?
তারাবানু বলে, বাবা তুই আমাকে যেদিন পর করে দিয়েছিলি সেই দিন আমি কষ্ট তেমন পাই নাই। কিন্তু তুইও যে আমার মতো আজকে একা হয়ে গেলি এই কষ্টটা আমার সহ্য হচ্ছে না রে। কি হবে তোর, বলেই তারাবানু থরথর করে কাঁপতে থাকে কান্না সামাল দিতে।
উসমান শীর্ণ মায়ের শরীরটা আঁকড়ে বুকের কাছে লুকিয়ে নেয়। মায়ের হাড্ডিওয়ালা ঘাড়ের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় কান্নার সমুদ্রে।
বাহিরে তখন চমৎকার বড় একটি পূর্ণ চাঁদ ছিল, আর ছিল পুরা উঠানময় ফর্সা জোৎস্নার মাতামাতি। আকাশের মেঘশূন্য কুয়াশাও ঢেকে রাখতে পারেনি আজকের চাঁদের ধূপকেও। সব প্রস্তুতি যেন শেষ হয়ে গেল। দুইটি জীর্ণশীর্ণ দেহ খুজে পেতে চাইল তাদের আপন আস্তানাকে। নিভু নিভু চেরাগের আলোর সাথে দুইটি হৃদপিন্ডও দুলছিল। খুব কাছ থেকে তারা বুঝতে পেরেছিল প্রতিদানটা ষোলোআনাই হলো পুরা। বলতে ইচ্ছে করছে-

প্রতিদান

হারিয়ে ছিলাম দৃষ্টি লোকে
কষ্ট দিয়ে তোমায় মা গো
তোমায় ব্যাথা দিয়ে আমি
চলে ছিলাম মৃত্যুর দিকে।
সব হারিয়ে, সব ছাড়িয়ে
শূন্য হলাম আমি
অনুতাপে অনুতপ্ত
জানে অন্তর্জামী।
জীর্ণ দেহটাকে তোলে নিলে
সব কিছু সহ্য করে।
প্রশ্ন আমার একটাই মা গো
প্রতিদানে তোমায় দিলাম কি গো?