মাঝরাত্তিরে শোভনের ঘুমটা হঠাত ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার কারণটা ধরতে খানিকটা সময় লাগল তার। কোথাও যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মৃদু কন্ঠে কারা যেন কথা বলছে। এই কথার শব্দেই কি ঘুমটা ভেঙেছে? কিন্তু এই গভীর রাতে কারা কথা বলবে? নাকি সে ভুল শুনছে? শোভনের ভ্রু কুচকে গেল।
বিদ্যুত কি এসেছে? শোভন উপরে ফ্যানের দিকে তাকাল। গরমকাল হলে ফ্যানের দিকে তাকালেই বিদ্যুত আছে কিনা বোঝা যেত। শীতকাল আসে নি, তবু আজ বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। শোভন ফ্যান অফ করে বেশ কম্বল-টম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিল। এর মাঝে এই হতচ্ছাড়া আওয়াজ তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। উঠে বাতি জ্বালিয়ে কি দেখবে বিদ্যুত আছে কিনা? পরক্ষণেই চিন্তাটা বাদ দিল সে, আরামদায়ক উষ্ণতা ছাড়তে মন চাইছে না। আওয়াজটা কি এখনো শোনা যাচ্ছে??
কান পাতলো শোভন। হুঁ, এখনো শোনা যাচ্ছে, কারা যেন কথা বলছে।
কারা?
ঠিক তখনই আস্তে অথচ একটা তীব্র ধমক শোনা গেল, তারপরই মেয়েলি ফোঁপানি। শোভনের আত্বা কেঁপে উঠলো। সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। তার রুমের দরজার দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলো শোভন। দরজার নিচে হালকা নীলাভ আলো। দরজার ওপাশের ডাইনিং রুম থেকে আলোটা আসছে। কিসের আলো ওটা?
অবশ্যই লাইটের আলো নয়। লাইটের আলো তো এমন নয়। তাছাড়া আলোটা কাঁপছে, রঙ বদল করছে। একটু আগে ছিল নীল, তারপর হল হলুদ ঠিক তার পরপরই লাল।
না, চোখের ভুল নয় শোভন নিশ্চিত।
মৃদু আলাপটা থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে, কন্ঠও যেন বদলাচ্ছে। কথা বুঝতে পারছে না শোভন। দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে আসা ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাকের কারণে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। দক্ষিণ দিকের জানালাটা কি সে লাগায় নি? শোভন মনে করতে পারল না। খুব সম্ভবত লাগানো হয় নি, এজন্যই ঘরের ভেতরটা এতটা ঠান্ডা।
শোভন যে খুব সাহসী তা নয় আবার তাকে ভীতুও বলা যায় না। অন্তত ভূত-টুতের ভয় সে পায় না। তবে এখন সে ভয় পাচ্ছে, বেশ ভাল ভয়।
শোভনদের বাসাটা দোতলা। নিচতলাটায় এক কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেও থাকে না। বাড়িওয়ালা দেশের বাইরে থাকেন। দেশে আসলে নিচতলাটা ব্যবহার করেন। দোতলাটা একটা মেস। খাবারঘর আর রান্নাঘর বাদে আরো চারটা রুম। সেই চার রুমে সব মিলিয়ে পনেরোটা ছেলে থাকে যার একজন হল শোভন। আজ পুরো মেস ফাঁকা। শোভন একা আছে। তিনদিন একটানা হরতাল। মেসে যারা আছে তারা সবাই কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র। ফাঁক পেয়ে বাড়ি ছুটেছে। অন্য সময় হলে শোভনও থাকত না কিন্তু মাত্র দুদিন আগে সে বাড়ি থেকে এসেছে, আবার যাওয়া মানে আবারো যাতায়াত ভাড়া খরচ। এটা ভেবে সে যায় নি। যাবার আগে রাশেদ জিজ্ঞেস করেছিল, 'একা থাকবি, ভয় পাবি না তো?'
সে বুকে টোকা দিয়ে বলেছে, 'শোভন কাউকে ভয় পায় না'
শোভন সারাদিন ভয় পায় নি। সারাদিন টো টো করে ঘুরে সন্ধ্যায় মেসে ফিরেছে। চা খেয়ে গল্পের বই পড়েছে। ফেসবুকে এক মাথাগরম ছেলেকে ক্ষেপিয়েছে। এক মেয়ের সাথে ন্যাকা ন্যাকা চ্যাট করেছে। রাতে ভাত খেয়ে বসে বসে একটা হিন্দি চ্যানেলে একটা ভৌতিক নাটক দেখেছে। অবশ্য পুরোটা দেখতে পারে নি। অর্ধেক দেখার পর বিদ্যুত চলে গেছে। রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই আর বসে থাকে নি। অন্যান্য রুমগুলোর দরজা-জানালা পরীক্ষা করে খাবার ঘরে বাতির সুইচ অফ করে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। তারপর কানে হেডফোন গুঁজে রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আর তারপর?
তারপর তো সেই মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে যাওয়া আর আর সেই অদ্ভুত ফিসফিসানি আর সেই বিচিত্র লাল-নীল-হলুদ আলো।
শোভন নিজেকে শান্ত রাখার চেস্টা করছে, পারছে না। ভয়ে আর ঠান্ডায় তার গা কাঁপছে। জানালা লাগানো দূরের কথা সেদিকে তাকাতেও ভয় লাগছে, নেমে বাতি জ্বালাতেও এখন ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে এখন বাতি জ্বালাতে গেলে ডাইনিং রুমের অশরীরীটা ছুটে আসবে।
তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না তো!?
উঁহু, নিজেকেই বলে সে, এটা হ্যালুসিনেশন নয় এটা প্রবল বাস্তব।
মেসের কেও লুকিয়ে থেকে ভয় দেখাচ্ছে না তো?
উঁহু, সেটাও সম্ভব নয়।
শোয়ার আগে সবগুলো রুমের দরজা-জানালা পরীক্ষা করেছে, ঘুরে দেখেছে, নিজ হাতে দরজাগুলোয় হুড়কো লাগিয়েছে। থাকলে অবশ্যই তার চোখে পড়ত।
মাথা ঠান্ডা রেখে যুক্তি খোঁজার চেস্টা করে শোভন। যুক্তি না পেয়ে ভয় তীব্র হয় তার।
বালিশের নিচে রাখা ফোন। কাঁপা হাতে সেটা সে তুলে নেয়। আর বেশি সাহস দেখানো উচিত নয়। কাউকে তার অবস্থা বলা উচিত। ফোন হাতে নিয়ে দেখা গেল সেটা অফ। পাওয়ার বাটনে চাপ খেয়ে অন হয় সেটা, নিজের অপারগতা প্রকাশ করে অফ হয়ে যায় আবার। ফোনে বই পড়েছে, চ্যাট করেছে, ঘুমানোর আগে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে রুমগুলো পরীক্ষা করেছে তারপর আবার কানে হেডফোন গুজে রেডিও অন করে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এত ধকল ফোন সইতে পারে নি। চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে গেছে। নিজের বোকামিতে কান্না পাচ্ছে তার।
পাশের রুম থেকে অদ্ভুত ফিসফিসানি আর আর হাসি-কান্না ভেসে আসছে। আসছে রাগী স্বর কখনো বা উতফুল্ল চিতকার। মাঝে মাঝে কি বাজনাও শোনা যাচ্ছে?
হ্যাঁ, বাজনাও শুনতে পারছে শোভন।
'একটা নয় অনেকগুলো অশরীরী। শোভনকে ভোজন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে' বিড়বিড় করে নিজেকে বলে শোভন।
ভৌতিক নাটকটার কথা মনে পড়ে তার।
গল্পটা এরকম- একটা মেয়ে যে কিনা ভূত-প্রেত নিয়ে ঠাট্টা করত। তারপর এক রাতে মেয়েটার সাথে সাক্ষাত করতে আসে সাক্ষাত ভূত।
শোভনও তো ভূত-প্রেত নিয়ে মজা করে। রাতে নাটক দেখার সময় নিজের মনেই সে বিদ্রুপ করেছে। তবে কি ওরা এসে গেল?
শোভন ঢোক গিলল। পানির পিপাসা হচ্ছে ওর। সেই সাথে নিম্নাঞ্চলে প্রবল চাপ। ভয়ের সময় অনেকে কাপড়-চোপড় নস্ট করে বলে শুনেছে শোভন, আজ সেও কি ঐ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে?
শোভন বুঝতে পারে আজ তার জীবনের এক ভয়াল রাত।
শোভন একমনে আয়তুল কুরসী পড়ার চেস্টা করছে। দোয়াটা মুখস্ত ছিল। অথচ শুরুটা মনে পড়ছে না। তার নিম্নাঙ্গে চাপ বাড়ছে।
কি করবে এখন? ভোর হচ্ছে না কেন?
কটা বাজছে জানতে পারছে না সে। নিজের প্রিয় ফোনটার উপর তার তীব্র আক্রোশ হচ্ছে। সালা অফ হবার সময় পেল না।
না, আর বসে থাকলে হবে না। এবার তাকে কিছু একটা করতে হবে। এভাবে আর বসে থাকলে কাপড় বিছানা কম্বল সব নোংরা হবে।
ভূতের মুখোমুখি হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শোভন। খারাপ কিছু হবে হোক সে কাপড় ভিজিয়ে মরবে না, প্রতিরোধ করে মরবে।
দেরি না করে বিছানা থেকে নেমে পড়ে শোভন। হাতড়ে হাতড়ে বাতি জ্বালায়। অল্প পাওয়ারের হলুদ বাতি। আলোয় খানিকটা সাহস পায় সে। উবু হয়ে খাটেরর নীচ থেকে দু হাত লম্বা রড তুলে নেয়। রডটা কে এনে রেখেছিল কে জানে, শোভন অনেক আগে থেকেই খেয়াল করেছিল, খাটের নীচে এই রড রাখা।
রড হাতে পেয়ে সাহস আরো খানিকটা বাড়ে তার। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় শোভন। দরজার কাছে গিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নেয় তারপরই দরজা খুলে ফেলে। সাথে সাথে সেই ফিসফিসানি উঁচু গলার আওয়াজে পরিণত হয়। সেই রহস্যময় আলো খানিকটা যেন বেড়ে যায়। শোভন হতভম্ব হয়ে আওয়াজ আর আলোর উৎসটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিদ্যুত পরিচালিত চতুষ্কোণ বাক্স!!
সে কি ওটা বন্ধ করে নি? প্লাগ খুলে রাখে নি? নিশ্চিত মনে পড়ে শোভনের, সে যন্ত্রটা বন্ধ করে নি। বিদ্যুত যাবার পর সে উঠে রুমগুলা পরীক্ষা করে ডাইনিং রুমের বাতি নিবিয়ে এসে দরজা লক করে শুয়ে পড়েছিল।
শোভন এক তীব্র আক্রোশ নিয়ে যন্ত্রটার দিকে ছুটে যায়।
দিনতিনেক পর শোভনের মেসের অন্য ছেলেরা এসে দেখতে পায় তাদের সবার চাঁদা দিয়ে কেনা টিভিটা এক কোনায় ভেঙেচুরে পড়ে আছে। কেয়ারটেকারের কাছে জানতে পারে, দু রাত আগে দোতলায় ধুড়ুম-ধাড়ুম শব্দ শুনে কেয়ারটেকারের ঘুম ভাঙে। সে সোজা দোতলায় এসে কলিংবেল চাপে। অনেক্ষণ অপেক্ষা করে যখন সে ভাবছে ফিরে গিয়ে আর লোকজন ডেকে আনবে কিনা তখন দরজা খুলে যায়। দরজায় রড হাতে দাড়িয়ে শোভন। ঘরে ঢুকে দেখা যায় সারা ডাইনিং রুমে ছড়ান ছিটানো টেলিভিশনের ধ্বংসাবশেষ। কেয়ারটেকারের প্রশ্নের উত্তরে শোভন জানায়, কি একটা বাজে প্রোগ্রাম দেখে তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল, তাই রাগের মাথায় টিভিটা ভেঙে ফেলেছে। অন্যদের কাছেও শোভন একই ব্যাখা দিয়েছে। সে টিভির দাম দেবে বলেও কথা দিয়েছে। সবার কাছে গোপন করলেও আমার কাছে সত্যটা স্বীকার করেছে শোভন। অন্যরা হাসাহাসি করত, আমি সেটা করি নি। সে কাওকে বলতে মানা করেছে তাই কাওকে বলিও নি। যদি লিখতে মানা করত তবে আমি আজ সেটা লিখতামও না। মানা করে নি বলে লিখে ফেললাম।