মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৯৯- জ্যোৎস্না

লিখাঃ Bojrodip Saha

একটা বেশ লম্বা বারান্দা। কোন এককালে আভিজাত্য পূর্ণ হলেও আজ তা জীর্ণ। এখানে ওখানে গাছের থাবা, আর সাত জন্মের ঝুল। সূর্যের আলোই ইট বেরিয়ে আসা দেওয়াল গুলোর মুখে এক বিষন্ন হাসি।
আমি বারান্দা ধরে এগিয়ে চলেছি। কোথায় চলেছি জানি না, শুধুই যাচ্ছি। যেন নিশিতে পেয়েছে! কোথা থেকে একটা জংলী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। চারদিক আশ্চর্য রকম নিঃস্তব্ধ।
বারান্দাটার শেষে একটা ঘরের দরজা। নাঃ, দরজা বলা ভুল হবে। দরজা কোন এক সময় ছি্ল ঠিকি, কিন্তু আজ তা অদৃশ্য। উঁই ধরা দরজার ফ্রেম টা হাঁ করে আছে শুধু।
ঘরটা কত বড় বলতে পারবো না। ঘর খানা একরকম ধোঁয়া তে ভর্তি। যেন সারা ঘর একটা পুরু কুয়াশার আস্তারণ দিয়ে ঢাকা। মাথার ওপর দিয়ে ‘অনধিকার প্রবেশ’ এর নোটিশ দিয়ে বোধহয় কয়েকটা বাদুর উড়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার এই যে, তাদের ডানা ঝাপটানোর কোন শব্দ আমি শুনতে পেলাম না। যদিও, আমি এতটুকুও আশ্চর্য হলাম না! সেই সব জ্ঞান যেন আমার লুপ্ত।
হতাৎ, আমার কানে আছড়ে পড়ল একটা মধুর ঝঙ্কার। সম্ভবত পিয়ানোর শব্দ।
হ্যাঁ, পিয়ানোই। ওই তো, কুয়াশার স্তর সরে গিয়ে উঁকি দিয়েছে। একটা মস্ত পিয়ানো। সামনে একটা গাউন পরা লোক। আমার দিকে পিঠ করে এক মনে রিড টানছে। আমি এগিয়ে গেলাম। আমার তো এগিয়ে যাওয়ারি কথা!
যত এগচ্ছি, ততোই নিজেকে ফিরে পাচ্ছি। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে উঠছে। এমন কি ষষ্ঠজনো অতিমাত্রাই সজাগ!
এতক্ষন ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। এখন সব কিছুর সাথে সাথে ভয়টাও ফিরে এসেছে। সারা শরীরে একটা শিরশিরানি অনুভূতি। বেশ বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
ততক্ষণে লোকটার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি। লোকটা পিয়ানো ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং আমার দিকে ফিরলো।
কেও যেন, আমার পা দুটো বরফের মধ্যে গেঁথে দিলো! বিড়ালের চোখ দেখেছি, কিন্তু এই চোখ তার থেকে শতগুন ভয়ানক। চোখের নীচে নাখ বলে কোন বস্তু কোনো কালে ছিল বলে মনে হয় না। মুখটা যেন ব্যাঙের চামড়া দিয়ে গড়া আর দগ দগে ঘায়ে ভরা। সেই ঘা থেকে বিষাক্ত রস বেরিয়ে সারা মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের একটা দিক কাটা। সেই ফাঁক দিয়ে রক্ত মাখা দাঁতের সারি গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।
পিশাচ! হ্যাঁ, এটাকে তা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সে তার হাতটা বারিয়ে দিলো। সেই হাত কোন মানুষের হওয়া অসম্ভব। আমি লুটিয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষন পরেই চোখ মেললাম। ঘরের কুয়াশা তখন কেটে গেছে। কোত্থেকে ভেসে আসছে তানপুরার একঘেয়ে শব্দ।
একটু পরেই নিজে কে ফিরে পেয়ে উঠে বসলাম। বিচ্ছিরী স্বপ্ন। ফ্যানটা তখনো তানপুরার মতো শব্দ করে চলেছে, বাড়িওয়ালা কে হাজার বললেও সারায়নি।
নাঃ আজ আর ঘুম হওয়ার কোন আশা নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। পাশেই ব্যালকুনির দরজা।
দরজা খোলা মাত্রই আমার দু-চোখ জুড়িয়ে গেল। বাইরে তখন বিশ্বচরাচর জ্যোৎস্নায় হাবুডুবু খাচ্ছে। আকাশে একটা ইয়া বড়......
“কিরে উঠে পড়লি?”
আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। যদিও চমকাবার কোনও কারণি ছিল না। বারান্দার রেলিং টা বেশ চওড়া। ওখানে চাঁদের আলো গায়ে মেখে গৌরব বসে আছে। আমি আর গৌরব এক কামরার এই বাড়িটা ভাড়া করে থাকি। একরকম মেস টাইপের। আচ্ছা, আমি যখন উঠে এলাম, তখন কি পাশের বিছানা ফাঁকা ছিল? গৌরব ছিল না সেখানে?
নাঃ সপ্নটার পর থেকে উলটা-পালটা ভাবছি!
“হুম, ঘুম ভেঙে গেল।”
গৌরবের দিক থেকে কোনও উত্তর এলো না। ও একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। আমিও রেলিঙে উঠে বসলাম। আকাশ থেকে রুপো ঝরে পড়ছে। গাছের পাতা গুলো তে যেন বরফ জমেছে। কোটি কোটি তার গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। এখানে ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে অন্ধকারেরা। এখন জ্যোৎস্নার রাজত্ব, তাদের বেরনোর উপায় নেই। সন্ধাগোলাপ গাছটা থেকে ভারি মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। একটা রাত জাগা পাখি অদ্ভুত ভাবে ডেকে উঠল।
এ যেন এক অন্য জগৎ। যেখানে কল্পনারা সব আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। আমরা দুজন এখানে নিতান্তই বহিরাগত।
গৌরবের দিকে তাকালাম। গ্রিল ভেদ করে ওর মুখে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়ছে ওর মুখে। মুখ খানা অদ্ভুত মায়াময় লাগছে।
“তনি, তুই ভুতে বিশ্বাস করিস।”
“নো। নেভার।”
তারপর আবার চুপ। গৌরব এরকমি, হতাৎ হতাৎ করে একেকটা প্রশ্ন করে। তার পর চুপ মেরে যায়।
আকাশে থালার মতো গোল চাঁদ। এত বড় চাঁদ আমি আগে দেখিনি। এরকম চাদনি রাতেই জেগে ওঠে পৃথিবীর সব ‘না-মানুষেরা’। এরকম রাতেই মানুষ হয়ে ওঠে ওয়্যারউলফ.........।
দুর, ভুতুরে চিন্তা গুলো কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারছি না।
আমরা দুজন বসে বসে জ্যোৎস্নায় ভিজছি। মুনবাথ। আচ্ছা, সূর্যের আলোয় ভিটামিন-ডি থাকে। কিন্তু, চাঁদের আলোয় কি থাকে?
“চাঁদের আলোয় শান্তি থাকে।”
চমকে উঠলাম। গৌরব থট রিডিং করছে না কি!
আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের আমরা একদম সহ্য করতে পারি না। গৌরব হচ্ছে সেই গোত্রের। কেন জানি না ওকে দেখলেই আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়......।
“এক অপার শান্তি” আবার ভেসে এলো গৌরবের গলা। তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলে উঠল “আচ্ছা তনি, তুই আমাকে সহ্য করতে পারিস না, না?”
আবারো চমকালাম। তবে কি এই জ্যোৎস্না, আমার মনের গহন অন্ধকার কে আলোকিত করছে? বের করে আনছে সব সত্য কে?
“না, পারি না।
“চাঁদের আলোর এই এক গুন কোন কথায় লুকানো থাকে না।
“জানিস, আমার মাও আমাকে সহ্য করতে পারে নি।
“আমার দুই পিসি তাদের বৌদি কে দু চোখে দেখতে পারত না। আমি হওয়ার পর আমাকে কেড়ে নেয় মাএর কাছ থেকে। পিসিদের কাছেই বড় হই। আসলে আমি ছিলাম ওদের কাছে একটা অস্ত্র মাত্র, বিষাক্ত মারনাস্ত্র। ছোট থেকেই আমার কানে বিষ ‘তোর মা একটা ডাইনি’, ‘ওকে কুপিয়ে মারা উচিৎ’ । আমিও হয়েছিলাম ভক্ত হনুমান। মার ভাতের থালায় থুতু ফেলে দিতাম, মার বিছানায় আলপিন পুঁততাম ,মেঝেতে তেল ফেলে রাখতাম যাতে মা উলটে পরে। মা অনেক দিন সহ্য করে ছিল। তার পর এক দিন....... ফুরুৎ”
গৌরব অদ্ভুত একটা শব্দ করে হাসল। আমি কোন দিন হায়নার হাসি শুনি নি। তবে সেটা বোধহয় এরকমি হয়।
“এক দিন সন্ধাবেলা। আমাদের বাড়ির সামনে একটা বট গাছ আছে, ওখানে রোজ দুটো বাদুর ঝুলত। সেদিন দেখা গেল বাদুর দুটো নেই তার জায়গায় ঝুলছে মা!
সে দিন রাতেও এরকম একটা চাঁদ উঠেছিল। মায়ের চিতায় আগুন দেওয়া হোল। মায়ের প্রতিমার মতো মুখটা আস্তে আস্তে কুঁচকে কালো হয়ে গিয়ে ডাইনির মতো দেখাচ্ছে। ছোট বেলায় আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগত। ‘আচ্ছা চামড়া পুড়ে রক্ত পরে নিশ্চয়, সেই রক্তে চিতা নেভে না?’ না নেভে না।
চিতার আগুন অনেক টা ওপরে উঠল, পট পট করে শব্দ হচ্ছে। চিতার আলোয় পিসিদের মুখ দূটো দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিজয়াল্লাসের হাসি। মায়ের দুটো হাত চিতা থেকে বেড়িয়ে ছিল। হাতের জয়েন্ট পুড়ে গিয়ে সে দুটো খসে পড়ল। কয়েকটা কুকুর ঘুরছিল। তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। একটা হাত কোন রকমে......”
“স্টপ্ন ইট। প্লিজ স্টপ।”
“সহ্য করতে পারছিস না? কিন্তু, আমাকে যে আজ বলতেই হবে। পরে হয় তো আর...।
তারপর পিসিরাও বাঁচে নি। এক জন পুকুরে ডুবল, আর এক জন গেল ওলাওঠায়। বেঁচে আছি যমের অরুচি এই আমি। যত বড় হয়েছি ততো বুঝেছি, যে কি ভুল করেছি! আর ভেতর ভেতর শেষ হয়েছি।
জানিস আমি আমার মায়ের মৃত্যুদিন জানি না। জানার চেষ্ঠাও করিনি।
কিন্তু প্রতি বছরি ঠিক বুঝে যায়। মা এসে মাথার কাছে চুপচাপ বসে থাকে। কিছু বলে না। আজ সেই দিন। মা এসেছিল। আজ বলল “চল, আমার সাথে। আর ক দিন এখানে পড়ে থাকবি?””
“আমি বললাম ‘চলো’”
গৌরবের চোখের কোন থেকে এক ফোটা মুক্ত খসে পড়ল।
“গৌরব।”
“হুঁ?”
“চল না আমরা সব ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু হই। হবি না?”
“হাঃ হাঃ হাঃ। বড্ড দেরি হয়ে গেছে মাই ফ্রেন্ড, বড্ড দেরি হয়ে গেছে........ এখন সব হাতের বাইরে।”
কথা গুলো শুনে অকারণেই আমার গা টা শিরশির করে উঠল।
গৌরব রেলিং থেকে নেমে ঘরে চলে গেল। আর পরক্ষনেই ভেসে এলো গৌরবের আর্ত চিৎকার এবং লুটিয়ে পরার শব্দ। সকালের আগে ওর জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হয় না।
আমার শরীরটা ক্রমশ হালকা হয়ে আসছে। এখানে বসে বসে ঘরের মধ্যে টা দেখতে পাচ্ছি। চাঁদের আলো গিয়ে পড়ছে আমার বডিটার ওপর, থুরি ডেড বডিটার ওপর।