মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৭৭- ভূতের গল্পের গল্প

রাত আর শীতের সাথে ভূতের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। রাত যত ঘন হয় আর ঠাণ্ডা যত ছুরির মত হাড়ের ভেতর ঢোকে ভূতের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে। ভূতেরা অবশ্য বিশ্বাসী লোক ছাড়া দেখা দেয় না। বয়ে গেছে তাদের অবিশ্বাসীদের দেখা দিতে। সাধুবাবাদের সাথে এইখানেই ভূতেদের প্রধান প্রভেদ। সাধুবাবারা খালি ফন্দিফিকির করে চেলাচামুণ্ডা বাড়ানোর ধান্দা করেন। ক্যান্সার সারিয়ে দেব, ভুঁড়ি কমিয়ে দেব ক্রমাগত এইসব লোভ দেখান। ভূতেদের এসব ছ্যাঁচড়ামো নেই। নিজে থেকে কেউ ভয় পেলে পেল, না পেল তো বয়েই গেল।

আমি তো তাই মনে করি বিশ্বাস করতে হলে সাধুবাবার থেকে ভূতে বিশ্বাস করা অনেক ভালো।

কলকাতার থেকে রিষড়ায় বেশি ঠাণ্ডা পড়ে তাই কলকাতার থেকে রিষড়ায় ভূত দেখতে পাওয়ার চান্স বেশি। আমি দেখেওছি। অনেক ছোটবেলায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আবছা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখেছি জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা দেখলে মনে হতে পারে ও মা এ তো আমাদের পেঁপেগাছটা কিন্তু সেটা চোখের ভুল। পেঁপেগাছের কি ওরকম মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর লম্বা লম্বা হাত পা থাকে? সবথেকে বড় কথা পেঁপেগাছ দেখে কি হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, এক হাতের মধ্যে শুয়ে থাকা মাকে ডাকতে গিয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না? কাজেই ও নির্ঘাত ভূত। পেঁপেগাছ সেজে ভয় দেখাতে এসেছে।

রিষড়ার থেকেও অবশ্য বেশি ঠাণ্ডা পড়ত দিল্লিতে। JNU-তে তো আরও বেশি। জানুয়ারি মাসের শেষরাতে দিল্লিতে যখন আবহাওয়া অফিসের থার্মোমিটার জিরো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুঁইছুঁই তখন পূর্বাঞ্চলের প্রফেসর কোয়ার্টারসের সামনে পার্ক করা গাড়ির ছাদে বিন্দু বিন্দু জল অলরেডি জমে কাঠ। তবে আমার JNU-বাসের সময়ে আমি বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মেয়ে ছিলাম কিনা, তাই ভূতেরা আমাকে দর্শন দেয়নি।

আমরা তাই ভূতের সাধ ঘোলে মেটাতাম। অর্থাৎ ভূতের গল্প দিয়ে। ভূতের গল্প ব্যাপারটাকে আমরা সকলেরই খুব সিরিয়াসলি নিতাম। কাজেই যখন তখন যেখানে সেখানে সে গল্পের আসর ফেঁদে বসতাম না। আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করা হত। সেদিন আমাদের ক্লাসে কারও মন বসত না, বিকেলের ধাবার আড্ডা ছেঁড়া ছেঁড়া হত। তারপর রাতের খাওয়া সেরে উঠতে না উঠতেই জগদীশ ভাইয়া এসে আমার পিঠে টোকা মেরে বলত, “ভিজটর হ্যায়, ভিজটর।” বাইরে গিয়ে দেখতাম আমার ভিজটরেরা সবাই মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোয়েটার, শাল, টুপিতে এমন চাপাচুপি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে তারা ভূত না মানুষ সেটা বোঝাই দুষ্কর।

ভূতের গল্প করার মতো ক্যাম্পাসে দুটোই জায়গা ছিল। এক ইস্ট গেট। দুই কুলফি পয়েন্ট। দুটো জায়গার নামই আক্ষরিক। ইস্ট গেট ছিল ক্যাম্পাসের পূর্বদিকে। কুলফি পয়েন্ট আসত পূর্বাঞ্চল যাওয়ার পথে। একটা সাপের মত রাস্তা, এঁকেবেঁকে যেতে যেতে হঠাৎ খাড়া নেমে গিয়ে আবার উঠে গেছে। ওই নেমে যাওয়া অংশটুকুর নাম ছিল কুলফি পয়েন্ট। সার্থক নাম কারণ বাকি রাস্তাটার থেকে কুলফি পয়েন্টের তাপমাত্রা হেসেখেলে অন্তত দু’তিন ডিগ্রি কম ছিল।

তারপর কুলফি পয়েন্ট বা ইস্ট গেটে পৌঁছে বসত আমাদের ভূতের গল্পের আসর। আমরা ক’জন আর আমাদের পিছু পিছু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে একটা অফ হোয়াইট রঙের পাঁচমেশালি পেডিগ্রির কুকুর। আদর করে সায়ন্তন তার নাম রেখেছিল শাহরুখ। দুটো জায়গাতেই কালভার্ট ছিল রাস্তায়, আমরা সেই কালভার্টের পাঁচিলে বসে গল্প করতাম। বানানো, মিথ্যে মিথ্যে ভূতের গল্প না কিন্তু। সত্যি ঘটনা। যেমন ধরুন পেরিয়ার হোস্টেলের একতলার বারোমাস বন্ধ থাকা ঘরটায় যে ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়েছিল তার গল্প। সরস্বতীপুরমের খোলা কুয়োটার ভেতর আরেকটি ছাত্রের ডেডবডি আবিষ্কার হয়েছিল, হোস্টেলের ঘর থেকে সে নিখোঁজ হওয়ার পাক্কা তিন রাত্তির বাদে। তাছাড়াও ব্ল্যাক ম্যাজিক, ভুডু, তন্ত্রমন্ত্র, নিশির ডাক। গল্প করতে করতে রাত বাড়ত, আমাদের ঘিরে ভারি কুয়াশা নামত, ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘষা কাঁচের মতো ঝাপসা হয়ে আসত। তখন আমরা অকারণেই ক্ষণে ক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের জঙ্গলের দিয়ে তাকাতাম, একে অপরের কাছ ঘেঁষে আসতাম, শাহরুখ পর্যন্ত লাফ মেরে সায়ন্তনের কোলে উঠে বসত। ওই একই গল্প দিনের বেলায় মেসে বসে শুনলে হাস্যকর কিন্তু সেসব শীতের রাতে তার এফেক্ট বিশ্বাস করা যায় না। শৌভিক ওর দাদুর মুখে শোনা একটা ঘটনা বলেছিল এখনও মনে আছে। দাদু তখন কিশোর। সামনে বোর্ডের পরীক্ষা আসছে, মাঝরাত্তিরে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দাদু একমনে অঙ্ক কষছেন। হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল। কেউ আড়াল থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে যেমন লাগে, তেমন। ঘরের বাতাসের তাপমাত্রারও চুলচেরা তফাৎ ঘটল কি? ঘাড় ঘুরিয়ে কিশোর দাদু এদিক ওদিক দেখলেন, কোত্থাও কিছু নেই ফাঁকা ঘর। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা বাবার হালকা নাকডাকার শব্দে আশ্বস্ত হয়ে দাদু আবার অঙ্কখাতার দিকে চোখ ফেরালেন।

অমনি বাঁ গালের খুব কাছে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ।

দাদুর হৃদপিণ্ড ছিটকে গলার কাছে চলে এসেছিল প্রায়। তবে মুহূর্তের মধ্যেই গলা থেকে একটা স্বস্তির গোঙানি বেরিয়ে এল। পাজি মোটা হুলোটা। কখন ঘরে ঢুকে পড়েছে কে জানে। মোটা অঙ্কবইটা তুলে নিয়ে ছোঁড়ার ভঙ্গি করতেই ল্যাজ তুলে হুলো সামনের খোলা জানালাটা দিয়ে লাফ মেরে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওই শীতের রাতেও দাদুর কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে। হাতের তেলোয় সে ঘাম মুছে নিয়ে তিনি আবার অঙ্কে মনোনিবেশ করলেন।

কিন্তু তারপর হুলোটা আবার ঢুকল ঘরে। একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার নয়, চারবার নয়, পাঁচ পাঁচ বার। প্রত্যেকবার সেই একই ব্যাপার। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ অকারণেই ঘাড়ের পেছনে একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি, আর তারপর হুলোর জ্বলন্ত পান্নার মতো চোখ। বার বার দাদু হুলো তাড়ালেন, বার বার সে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালাল, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।

সেদিন রাতের মতো আর পড়ার আশা ত্যাগ দিয়ে দাদু বইখাতা গুটিয়ে উঠে পড়লেন। শুয়ে পড়ার আগে একটু হাওয়া খেতে খেতে হতভাগা হুলোটার মুণ্ডপাত করবেন বলে জানালার দিকে পা বাড়িয়েই থমকে গেলেন দাদু।

ঘরের একমাত্র জানালার পাল্লাদুটো পাটে পাটে বন্ধ। ছিটকিনি তোলা।

আমাদের ভূতের গল্পের আসর শেষ হতে বেশির ভাগ দিনই রাত আড়াইটে তিনটে বেজে যেত। তখন আমরা একে অপরকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতাম। ফেরার পথে বেশি কথা বলত না কেউ। সায়ন্তন সবথেকে বেশি সাহসী ছিল, ও সবার শেষে একা হোস্টেলে ফিরত। বলত আরে ধুর একা কোথায়, শাহরুখ আছে তো। কীরে আছিস তো? বলে ভালবেসে শাহরুখের দিকে তাকাত আর অমনি শাহরুখ তার চামরের মতো ল্যাজ নেড়ে ঘউ ঘউ করে চেঁচিয়ে হ্যাঁ বলত। ভাবখানা যেন, আসতে দাও ভূতকে, ব্যাটাকে চিবিয়ে সাবাড় না করেছি তো আমার নাম শাহরুখ না।