পাশেই কারো চাপা কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার।
চোখ খুলতে নিকষ আঁধার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। নিরেট আঁধার।
একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম নাকে। ফুলের গন্ধ।
পাশ থেকে আবারো কে যেন ফুঁপিয়ে উঠল। মেয়েলি কন্ঠ।
ভয় পেলাম আমি। প্রচন্ড ভয়।
মেয়েটা ঠিক আমার পাশেই শুয়ে আছে মনে হল। এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে ফুলের মিষ্টি গন্ধটা বুনো হয়ে উঠছে। নেশা নেশা ভাব আছে গন্ধটায়। ভয়টা জড়িয়ে ধরতে চাইছে চারপাশ থেকে। ভয়কে একপাশে ছুড়ে ফেলে ইচ্ছে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করি আমার পাশে নিরন্তর কেঁদে যাওয়া রহস্যময়ীকে। আচ্ছা, আমি কি কোনো অশরীরীকে ছুঁতে চাইছি না?
ঘুম থেকে ওঠার পর মস্তিষ্কের সাময়িক স্থবিরতা ততক্ষনে কেটে গেছে। নিজেকে ফিরে পাবার সাথে সাথেই আমার মনে পড়ে গেল সব। পুরো বিছানা দখল করে রাখার শেষ দিন গতকালই কাটিয়ে ফেলেছি। গতকাল রাতে আমার বিয়ে হয়েছে।
পরক্ষণেই কপাল কুঁচকে গেল। আমার বউ এই গভীররাতে কেন কাঁদছে?
লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। পাশে এসে বসলাম মায়ার। মায়া তিরতির করে কাঁপছে মায়াহরিণীর মত। চোখের পাতা শক্ত করে চেপে বন্ধ হয়ে আছে। একটানা ফোঁপানোর আওয়াজ বলে দিচ্ছে এই কান্না পরিবারকে ছেড়ে অচেনা এক মানুষের উপর নিজের সারাজীবনের ভার চাপিয়ে দেবার অনিশ্চয়তা থেকে নয়।
মায়া মা বাবার একমাত্র মেয়ে। বড়ই আদরের। হবার কথাই। মায়া লক্ষী মেয়ে।
কাল রাতে বাসর ঘরে ঢুকে দেখি চুপচাপ বসে আছে। দেখে মনে হল, ওর কিছুটা সময় প্রয়োজন নিজেকে খানিক গুছিয়ে নিতে।
'সারাদিন অনেক ধকল গেছে নিশ্চয়ই।' পাশে বসে বললাম।
চোখ তুলে তাকাল শুধু আমার দিকে। বলল না কিছু।
হেসে বললাম,'ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো। তাছাড়া এমনিতেই মেকআপ তুলতে অনেক সময় লাগবে। আমি হেল্প করব?'
মাথা নাড়ল মায়া। কথা না বাড়িয়ে উঠে গেল। বুঝলাম,ঠিক কাজটাই করেছি। মেয়েটা অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল নিশ্চয়ই। যেমনটা বিয়ের প্রথমরাতে প্রতিটা মেয়েই থাকে। এ রাতে একজন স্বামীর চাইতে একজন বন্ধুর বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাদের।
প্রায় আধঘন্টা পর বাথরুম থেকে বের হল মায়া। একটা আটপৌরে সালোয়ার কামিজ পরেছে। খুব আপন মনে হচ্ছে ওকে এই কাপড়ে।
'আপনি কি ঘুমিয়ে পড়বেন?' আমার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে বলল মায়া।
'আমি একটু পরে ঘুমাব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।'
মায়ার চোখে প্রশ্ন দেখে ফের বললাম,'আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে।'
'কী?' একটু টেনে প্রশ্ন করল মায়া।
হো হো করে হেসে উঠলাম। 'ভয় পেয়ো না। খারাপ কিছু না। রাতে ঘুমাবার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এককাপ কফি খেতে হয় আমাকে। নইলে ঘুম আসে না।'
'কী বলছেন?' বিস্ময়ের মায়ার কন্ঠে।
'অবাক হয়েছো,না? কফি সাধারণত ব্যবহার করা হয় ঘুম তাড়াবার জন্য। আমি খাই ঘুম আনবার জন্য। আসলে মাস্টার্স পরীক্ষার সময় রাত জেগে পড়াশোনা করার জন্য খাওয়া শুরু করি। পরীক্ষা চলে গেছে, অভ্যেসটা রয়ে গেছে।'
'ও,আচ্ছা।' খানিক বিরতি দিয়ে মায়া বলল,'আমি বানিয়ে দিই?'
আবারও হেসে উঠলাম। 'দরকার পড়বে না। আমার কফি মেকার আছে। নিজেই বানিয়ে নিতে পারব। আর বানাতে চাইলে কাল থেকে বানিও। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো।'
মাথা নেড়ে বিছানায় উঠতে গেল মায়া।
'মায়া!' আমি ডাকলাম।
ফিরে তাকাল মায়া। 'হুম?'
'আমাকে কি তুমি করে বলা যায়?'
চুপ করে রইল মায়া। খানিকবাদে নীচু গলায় বলল,'আমি চাই কাউকে যখন কোনো সম্বোধন করব সেটা আমার ভেতর থেকে আসুক। সেজন্য একটু সময় প্রয়োজন আমার। দেবেন?'
মৃদু হাসলাম।'ঠিক আছে। যাও শুয়ে পড়ো।'
আমি আধঘন্টা পর বারান্দা থেকে কফি খেয়ে এসে দেখি মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি লাইট নিভিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। এরপর এমন একটা লক্ষী মেয়েকে আমার মত অর্বাচীনের গলায় ঝুলিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙ্গল মায়ার কান্নায়।
'এই,এই মায়া।' আমি নরম স্বরে বললাম। একটু ইতস্তত করে মাথায় হাত রাখলাম। মায়ার শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল।
মাথা থেকে হাতটা কপালে নিয়ে এলাম। না,জ্বর-টর তো নেই। বুঝতে পারছি না কিছুই। এমন করছে কেন মায়া? হিস্টিরিয়ার রোগীদের মত কাঁপছে। ঘামে সারা শরীর ভেজা। ঘামের নোনা গন্ধ ছাপিয়ে মিষ্টি একটা নেশা ধরানো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মিষ্টি গন্ধটা ঘর সাজাবার ফুলের গন্ধ নয়। এ গন্ধ মায়ার গন্ধ।
এবার আরেকটু জোরে ঝাঁকুনি দিলাম। ঝট করে চোখ খুলে গেল মায়ার। চোখে শূন্য দৃষ্টি।
'কী হয়েছে,মায়া তোমার?'
উদভ্রান্তের মত তাকাল আমার দিকে মেয়েটা। এরপর কিছু বুঝে উঠবার আগেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমাকে।
দুই
পরদিন সকালে সব কিছু খুব স্বাভাবিক হয়ে গেল। মায়া আমারও আগে ঘুম থেকে উঠে বাসার সবার জন্য চা বানাতে লেগে গেল। সবাই বলতে আমি,মা, ছোটবোন রিংকি আর ও নিজে। বাবা মারা গেছেন সে অনেকদিন হবে। মা অসুস্থ। চলতে ফিরতে পারেন না। দেখাশোনার জন্য একজন লোক রাখা হয়েছে।
বিয়েটা আমাদের ঘরোয়াভাবেই হয়েছে। কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছিল শুধু। বন্ধুবান্ধব কাউকে বলা হয়নি। বিয়েটাই তো হুট করে হয়ে গেল। সপ্তাহখানেক আগে মেয়ে দেখতে গিয়ে পছন্দ হয়ে গেল, এক সপ্তাহর মাথায় বিয়ে। তাড়াটা ছিল মায়ার পরিবার থেকে। মেয়ে পছন্দ জানবার সাথে সাথেই তারা শর্ত জুড়ে দেয়, বিয়েটা যত দ্রূত সম্ভব হয়ে যেতে হবে। আমরাও আপত্তির কিছু খুঁজে পাইনি। বিয়েটা হয়ে গেল।
গতরাতের ঘটনাটা এখন আমার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই ভয়াবহ কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছিল মায়া। ব্যাপারটা আমার জন্য সুখকরই ছিল বলতে হবে! মায়া তখন সেই যে ঘোরের মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল,এরপর আর ছাড়েনি। ওই অবস্থায়ই একটু পর ঘুমিয়ে পড়ে। খানিকবাদে ওকে শুইয়ে দিয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।
মায়া একটা ট্রে নিয়ে ঢুকল রুমে। গোসল করে কলাপাতা রঙের একটা সূতি শাড়ি পড়েছে। আশ্চর্য রকমের স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।
মায়া যাকে বলে আহামরি সুন্দরী, তেমন নয়। চেহারায় মায়া,লাবন্য,সবই আছে কিন্তু এরপরও ওকে অতি সুন্দরী বলা যাবে না। অতি সুন্দরীদের চেহারায় এক ধরনের আবেদন থাকে। যৌনাবেদন। কিন্তু মায়াকে দেখলে শরীর শিউরে ওঠে না, ওর মাথায় বরং হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। ব্যাপারটা ওর নামের প্রভাবে ঘটছে নাকি নামটাই রাখা হয়েছে ওর মায়ায় পড়ে?
আমি বিব্রতকর প্রশ্নটা এড়িয়ে বললাম,'চলো আজকে মুভি দেখে আসি। স্টার সিনেপ্লেক্সে ভাল একটা মুভি এসেছে।'
ঝপ করে কেন যেন আঁধার ঘনাল মায়ার মুখে। খুব দ্রূত সামলে নিয়ে বলল,' তারচাইতে এক কাজ করেন, ডিভিডি নিয়ে আসেন, সবাই মিলে বাড়িতেই দেখি।'
'সবাই আবার কে? তোমার কি ধারনা মা হলিউডের মারদাঙ্গা সিনেমা দেখে?'
'মা না,রিংকির কথা বলছি।'
'ও-ও আমাদের সাথে যাবে, প্রবলেম কী? তাছাড়া এমনিতেও হলের মধ্যে তো আর রোমান্স করতে পারছি না আমরা,তাই না? হা হা হা!'
আমার রসিকতা স্পর্শ করতে পারল না মায়াকে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
লজ্জা পাচ্ছে মায়া। লজ্জা কাটাবার জন্যই ওকে বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার।
'তাহলে নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নাও। লাঞ্চ বাইরে করব আমরা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।' ঘোষনার ভঙ্গিতে বলে বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে রওনা হলাম আমি। পেছন ফিরে দেখি মায়া একইভাবে বসে আছে। সম্ভবত ভুল দেখলাম আমি, মায়া যেন কেঁপে উঠল একবার।
তিন
তিনটে টিকিট কেটে ফিরে আসছি। মায়া আর রিংকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রিংকি এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। গল্পবাজ মেয়ে। জমিয়ে ফেলেছে ভাবীর সাথে। কী একটা কথায় হেসে ঢলে পড়ছে ভাবীর গায়ে। মায়াও হাসছে,তবে তাতে প্রাণের অনুপস্থিতি এতদূর থেকেও নজর এড়ালো না আমার। লজ্জাটা একটু বেশিই মেয়ের!
'তোমরা গিয়ে বসো,আমি পপকর্ন নিয়ে আসছি।' দুটো টিকিট ধরিয়ে দিলাম ওদের হাতে।
ওরা চলে গেল। দশ মিনিট পর হাতে পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ওরা দু'জন পাশাপাশি বসেছে। মায়ার পাশের সীটটা আমার জন্য বরাদ্দ। গিয়ে বসে পড়লাম।
আরেকটু পরই ছবি শুরু হবে। লাইটগুলো একে একে নিভে গেল। আমি অনূভব করলাম, মায়া একই সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে গেল।
কপাল কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে। হালকা গলায় বললাম,' হরর মুভি দেখতে ভয় পাও?'
'ন..না।'
বলল বটে ,কিন্তু আমি বুঝলাম, ভয় পায় মায়া। ভুল হয়ে গেছে ওকে জিজ্ঞেস না করেই টিকিট কেটে। অন্ধকারে প্রিয় মানুষের হাত ধরে রক্তজল করা মুভি দেখতে সবার ভাল নাও লাগতে পারে- বোঝা উচিৎ ছিল আমার।
লাইটগুলো সব নিভে গেছে। স্ক্রিন কালো হয়ে থাকায় প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার হলে। একটু পরই স্ক্রিনে আলো ফুটে উঠল। শুরু হয়ে গেছে সিনেমা।
মায়া লজ্জা পাবে ভেবে হাতে পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে সটান সামনে তাকিয়ে মুভি দেখা শুরু করলাম। ভুলেও তাকাচ্ছি না ওর দিকে।
কতক্ষণ কেটে গেল, বলতে পারব না। আমি পুরোপুরি সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সেখান হতে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনল রিংকির চিৎকার।
'ভাইয়া, ভাবী!'
ঝট করে ফিরে তাকালাম। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। মায়া মাথা একদিকে এলিয়ে পড়ে আছে। অবস্থা ঠিক কাল রাতের মত। প্রায় সংজ্ঞাহীন। কাঁপছে থরথর করে।
'মায়া!' ঝাঁকি দিলাম ওকে। কোনো পরিবর্তন নেই। একইরকম নির্জীব। পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম মায়াকে। আলতো করে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।
বাইরে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। খুব দ্রুতই সাড়া পাওয়া গেল। চোখ পিটপিট করে উঠল মায়ার। একসময় পুরোপুরি মেলে গেল।
মায়া তাকিয়ে আছে চোখে রাজ্যের মায়া নিয়ে। ওই চোখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি চোখ সরিয়ে নিতে যাব তার আগেই মায়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল,'আই অ্যাম,সরি।'
হু হু করে কেঁদে ফেলল মায়া।
চার
'বাবা, কথাটা তোমাকে আগেই বলা উচিৎ ছিল। বড় ভুল হয়ে গেছে।' চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন ফজলুর রহমান সাহেব। মায়ার বাবা, আমার শশুর।
মায়া অসুস্থ হয়ে পড়াতে আজ ওকে বাবার বাড়ি নিয়ে এসেছি। আমি আর আমার শশুর বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি এই মুহূর্তে। মায়া ভেতরের রুমে একা একা বসে আছে। গতকালের ঘটনার পর থেকে মন খারাপ করে আছে। শরীরও সুস্থ নেই তেমন একটা। দেখে শুনে মনে হল ওকে এখানে নিয়ে আসাই ভাল হবে। ক'টা দিন থেকে যাক।
'কী কথা, আব্বা?' শশুরের কথায় প্রশ্ন করলাম।
'মায়ার অসুখের ব্যাপারটা।'
'মায়ার আবার কিসের অসুখ?'
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। এরপর বড় করে শ্বাস নিলেন।
'মায়া ফোবিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।'
বুকের কোথাও ধক করে উঠল আমার।
'ফোবিক ডিজঅর্ডার?'
'হুম। ভয়ের জিনিসে মানুষ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভয়ের মাত্রা যখন অস্বাভাবিক হয় তখন সেটা আর স্বাভাবিক থাকে না। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো বিশেষ একটি জিনিসকে ভয় পায়। অস্বাভাবিক তীব্র ভয়। কেউ পোকা মাকড়, কেউ বদ্ধ জায়গা আবার কেউ উচ্চতাকে ভয় পায়। আর মায়া ভয় পায় অন্ধকারকে।'
'হুম, এরকম আমিও শুনেছি। কতদিন ধরে এ সমস্যা?'
'চার বছর।'
'ওকে ডাক্তার দেখাননি?'
'দেখিয়েছি। অনেক ডাক্তারই দেখানো হয়েছে। কয়েকবার কাউন্সিলিংও করা হয়েছে, লাভ হয়নি। মায়ার অসুখটা লাস্ট স্টেজে পৌঁছে গেছে আমাদের সবার অজান্তেই।'
'আপনাদের অজান্তে মানে?'
'হুম, রোগের প্রকাশ চার বছর ধরে হলেও ওর মধ্যে এ রোগের বীজ অনেক আগেই ঢুকে গিয়েছিল। ওর বয়স তখন তিন বছর। সে সময় ওর মা ওকে একবার ঘুম পাড়িয়ে পাশের বাসায় গিয়েছিল। এমন সময় কারেন্ট চলে যায়। ওর মা বাসায় ঢুকতে গিয়ে বুঝতে পারে ভুলে চাবি ঘরের ভেতরই রেখে এসেছে। ততক্ষনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে মায়ার। ঘুম থেকে উঠে ছোট্ট বাচ্চাটা নিজেকে আবিষ্কার করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। ভয় পেতে থাকে ও।
ওর মা বুঝতে পারেনি মায়ার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পাশের বাসার এক ছেলেকে পাঠায় আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসবার জন্য। খবর পেয়ে আমি নিজেই চলে আসি। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আমরা ভেতরে গিয়ে মায়াকে অজ্ঞান অবস্থায় পাই।
ভয়ের বীজটা সেদিনই ওর অবচেতন মনে ঢুকে যায়।' এটুকু বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন ফজলুর রহমান সাহেব।
'তারপর?'
'সুপ্ত বীজটা মহীরূহের আকার ধারণ করে চার বছর আগে। ইন্টার পরীক্ষার পর বান্ধবীরা মিলে হলে ছবি দেখতে গিয়েছিল। সেখানে একটা দৃশ্য ছিল, নায়ক কবরের মত একটা বদ্ধ অন্ধকার জায়গায় আটকা পড়ে। হলের আঁধার আর এই দৃশ্য মায়ার অবচেতন মন থেকে সেই ভয়টাকে টেনে বের করে আনে। হলের মধ্যেই জ্ঞান হারায় মায়া। সেদিন থেকেই ও অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। রাতেও লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায়। ছোটবেলা থেকেই এই ভয়টা মনের মধ্যে সুপ্ত থাকায় এখন এর ফলটা হয়েছে ভয়াবহ। আমি এতক্ষন যা বললাম, এগুলো সব সাইকিয়াট্রিস্টদের ব্যাখ্যা।'
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। মায়া অসুস্থ? এমন বিশ্রি একটা রোগ মায়ার মত মেয়েকে কিভাবে ক্ষয় করে দিচ্ছে ভাবতেই মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। স্যাঁতসেঁতে এই ভয়কে সঙ্গী করে কিভাবে বেঁচে আছে মেয়েটা? মায়ার জন্য আমার তীব্র মায়া হতে লাগল।
'আচ্ছা, এ রোগের কী কোনোই চিকিৎসা নেই?'
চুপ করে রইলেন ফজলুর রহমান সাহেব।
'উহুঁ, নেই। তবে একটা সম্ভবনা আছে। যেহেতু মায়ার রোগটা বেশ জটিল সেজন্য ওকে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য ওকে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেন্টাল এসাইলাম, সোজা কথায় পাগলা গারদে থাকতে হবে। হতে পারে সেটা কয়েক বছরের জন্য। এরপরও কোনো গ্যারান্টি ডাক্তাররা দিতে পারেননি, মায়া আসলেই সুস্থ হবে কি না। আমি পারিনি মেয়েটাকে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে।' মানুষটার কন্ঠে আদ্রতা। দীর্ঘ বিরতি নিলেন তিনি।
'আমি সত্যিই খুব দুঃখিত,বাবা?'
'দুঃখিত? কেন?'
'তোমাকে আগেই জানানো উচিৎ ছিল সবকিছু। মায়াও আমাদের সাফ বলে দিয়েছিল,পাত্রপক্ষকে যেন আগেই জানানো হয়। কিন্তু কী করব বলো? এর আগে তিনটে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে এ কথা জেনে। তাই এবার আমরা বাধ্য হয়েই এই অনৈতিক কাজটা করে ফেলেছি। মায়াও জানত যে তোমরা ওর অসুখের কথা জানো না। কিন্তু কী ভেবে ও এবার রাজি হয়ে যায়। মায়া নিজেও হয়ত মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল বারবার বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াতে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সত্যিই বড় অন্যায় হয়ে গেছে।' খানিক ইতস্তত করে বললেন,'তুমি চাইলে মায়াকে ডিভোর্স...।'
আমার জোরগলার হাসিতে মাঝপথে থেমে গেলেন ফজলুর রহমান সাহেব। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
'আব্বা, আপনি জানেন না, আপনি কত ভাল একটা কাজ করে ফেলেছেন।' আমি হাসি থামিয়ে বললাম। 'আপনারা যদি আগেই মায়ার অসুখের কথা আমাকে বলতেন তাহলে হয়ত আমিও বেঁকে বসতাম। সেক্ষেত্রে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড় সম্পদটা হারাতাম। মায়ার জন্য সারারাত ঘরে লাইট জ্বালিয়ে রাখা ছাড়াও আরো অনেক কিছুই করা যায় এক জীবনে। তবে আমি মায়াকে এমন থাকতে দেব না। ওকে আমি সুস্থ করে তুলবই ইনশাল্লাহ।'
'কিভাবে?' ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল ফজলুর রহমান সাহেবের।
'জানি না।'
পাঁচ
অফিসে বসে কলম পিষতে পিষতে হুট করে বিরিয়ানীর সুঘ্রাণ পেলে হাত মাথা দুটোই একসাথে স্থবির হয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। তারউপর যদি সময়টা হয় লাঞ্চটাইম।
আমি কাজ থামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধু দাঁড়িয়ে। দরজাটা খুলেছে নিঃশব্দে। এভাবে দরজা খুলে মানুষকে হকচকিয়ে দেয়া শুধুমাত্র ওর পক্ষেই সম্ভব। হাতে দু'প্যাকেট বিরিয়ানী আর বোরহানির বোতল নিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে সে। চেহারায় উদভ্রান্তের দৃষ্টি, কিন্তু এই ছেলের মত বুদ্ধিমান মানুষ কমই আছে পৃথিবীতে। অন্তত আমার দেখা পৃথিবীর সবচাইতে বুদ্ধিমান ছেলে ও।
সস্তার বার্মিজ স্যান্ডেল পরেই দামী কার্পেট বিছানো রুমে ঢুকে পড়েছে। এবং এজন্য সে বিন্দুমাত্রও বিচলিত নয়।
'কেমন আছিস?' একগাল হেসে আমার সামনে বসে পড়ল।
আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এই ছেলের সাথে আমার দেখা নেই প্রায় দু'বছর। আমার ঠিকানা কোত্থেকে পেল আল্লাহ মালুম, তারচাইতেও বড় কথা, আমি ওর এমন বন্ধু ছিলাম না যে দু'বছর যোগাযোগ না রাখলেও ঠিকানা যোগার করে একেবারে অফিসে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।
'ভাল।' আমি আড়ষ্টতা নিয়ে বললাম। 'আমার ঠিকানা পেলি কোথায়?'
'যোগার করেছি।' কথাটা এমনভাবে ও বলল, যেন এতেই আমি সব বুঝে যাব।
'জিজ্ঞেস কর, কেন করেছি।'
'কেন করেছিস?'
'শোন, আজকে হল বৈচিত্র্য দিবস। আজকে...।'
'দাঁড়া,দাঁড়া, এই বৈচিত্র দিবস আবার কী জিনিস।'
'সেটাই তো ব্যাখ্যা করছি। আজকের দিনে আমি আমার কাছের মানুষদের জন্য বৈচিত্রের আয়োজন করি। এই যে তোর ঠিকানা নিয়ে হুট করে চলে এলাম, এটা একটা বৈচিত্র্য না?'
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আমার পাগলাটে বন্ধুর দিকে।
'তোর ঠিকানা যোগার করতে গিয়ে জানতে পারলাম কিছুদিন আগে বিয়ে করেছিস। বিয়েতে নাকি কাউকে দাওয়াত দিস নাই। এইটা ঠিক করিস নাই তুই। ওলীমা করা সুন্নত। ওলীমা মানে বুঝিস? আচ্ছা বোঝার দরকার নাই। আমি খাবার দাবার নিয়ে এসেছি তোর অফিসেই ওলীমা হবে।'
আমি যথেষ্ট লজ্জা পেলাম। মানুষকে সুক্ষ্মভাবে লজ্জায় ফেলে দিতে ওর জুড়ি নেই।
'আচ্ছা, তোর বউয়ের কী সমস্যা?' মাথা নীচু করে বিরিয়ানীর প্যাকেট খুলতে খুলতে নিতান্তই অসচেতনতার সাথে বলল সে।
আমি ভয়াবহ চমকে উঠলাম। আমার বউয়ের সমস্যার কথা অভ্র নামের এই অদ্ভুত ছেলেটা কি করে জানবে?
'তুই কিভাবে জানলি?'
আমার দিকে তাকিয়ে ভূবন ভোলানো একটা হাসি দিল অভ্র।
‘শার্লক হোমসের মত জামার রং দেখেই তোর বউয়ের সমস্যা জেনে ফেলার মত কেউকেটা এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। তবে আমার ইনট্যুশন যথেষ্ট ভাল। বিয়ের কথা শুনেই তোর চোখে মুখে এক ধরনের বিষাদ ফুটে উঠেছিল...উঁহু, আয়নায় তাকাতে হবে না। এই জিনিস সবার চোখে ধরা পড়বে না।’
আমি অভ্রর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার কোনো কারণ ছাড়াই অযৌক্তিকভাবে মনে হতে লাগল, একমাত্র এই ছেলেই আমার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে।
আমি বিরিয়ানীর প্যাকেট টেনে নিয়ে শুরু করলাম মায়ার গল্প। মাঝে কয়েকবার থেমে যেতে হল। অভ্রকে দেখে মনে হচ্ছে না আমার কথায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে ওর। এরচাইতে বিরিয়ানীর স্বাদ আস্বাদন করাই যেন ওর জীবন মরণের ব্রত। মাঝে মধ্যে খাওয়ার আনন্দে ওর চোখ বন্ধ হয়ে গেলে আমার গলার জোর কমে যাচ্ছে। সাথে সাথেই ও ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে আমার দিকে। মোটামুটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে সব বলা শেষ করলাম। আমার বলা শেষ হতে হতে বিরিয়ানীও শেষ হল।
খাওয়া শেষে টিশ্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে চেয়ারে আরাম করে হেলান দিল অভ্র। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি অভ্রর দিকে।
‘একটা ভুল করে ফেলেছি রে।’ বলে উঠল। সিরিয়াস একটা ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে ওর চেহারায়।
‘কী ভুল?’ আমি আগ্রহের আতিশ্যয্যে হেলান ছেড়ে দু’হাত সামনে ঝুঁকে এলাম।
‘পান আনতে ভুলে গেছি। পিয়নকে ডেকে দুটো পান আনা। টেনশন নিস না, পানের টাকা আমি দেব। গুরুপাক খাবারের পর পান খাওয়া ভাল। কেন জানিস? পান খেলে প্রচুর পরিমানে লালা উৎপন্ন হয়। লালায় থাকে টায়ালিন নামক এনজাইম। হজমে সহায়ক।’
আমি আবার হতাশা নিয়ে চেয়ারে হেলাম দিলাম। বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে পান আনতে পাঠালাম। মিষ্টি পান। অভ্র পুরোটা সময় চেয়ারে মুনিঋষির মত চোখ বুজে হেলান দিয়ে রইল। যেন সদ্যই তিব্বতী লামাদের থেকে দীক্ষা নিয়ে ফিরেছে।
বেয়াড়া পান নিয়ে রুমে ঢোকার সাথে সাথেই ঝট করে চোখ খুলে গেল ওর। আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম।
‘জানিস, এতক্ষণ কী করলাম? ‘কাইলুলা’। নবীজী সা. এর সুন্নত। ‘কাইলুলা’ মানে হল দুপুরে খাবারের পর খানিক বিশ্রাম নেয়া। রাতে ঘুমানোকে বলে ‘লাইলুলা’ আর বিকেলে ঘুমানোকে বলে ‘গাইলুলা’। ‘কাইলুলা’ আর ‘লাইলুলা’ শরীরের পক্ষে উত্তম। গাইলুলা করা মোটেও ভাল না, শরীর খারাপ হয়।’
‘তোর পান।’ আমি শুকনো মুখে একটা পান বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে।
‘পান পরে। আগে বোরহানি।’
সময় নিয়ে বোরহানির মুখ খুলল অভ্র। এরপর এক ঢোক গলায় ঢেলে আমার সামনে রেখে বলল, ‘খেয়ে দেখ,সেই মাপের জিনিস!’
আমি বোতল স্পর্শ করলাম না।
‘কি রে, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত মন খারাপ করে থাকলে চলবে? বোরহানি খা, পান খা, কাইলুলা কর, এরপর তোর বউকে নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’
আমি ফুঁসে উঠলাম। ‘সামান্য? আমি কতরাত ঘুমাতে পারি না তুই জানিস?’
‘হুম, জানি। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমানোটা সহজ কাজ না।’
অভ্রর স্বভাব জানা না থাকলে হয়ত মেরেই বসতাম!
‘গাধা, লাইটের জন্য না, আমি মায়ার চিন্তায় ঘুমাতে পারি না।’
‘ও,আচ্ছা।’
‘ও আচ্ছা মানে?’
‘শোন,’ অভ্র আমার কথায় কান দিল না। ‘তোর বউকে তীব্র ভয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে হবে।’
‘মানে? বুঝলাম না।’ আমার কপালে গভীর ভাঁজ।
‘না বোঝার মত তো কিছু বলি নাই। ছায়াকে যখন...।’
‘ছায়াটা আবার কে?’
‘তোর বউ।’
‘ওর নাম মায়া।’
‘সরি। তো মায়াকে যখন আমরা ভয়ের শেষ সীমায় দাঁড় করিয়ে দেব তখন আশা করা যায় ও ভয় কাটিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসতে পারবে।’
আমি কপালে আরো ভাঁজ ফেলে বললাম,‘কিন্তু ডাক্তার তো কখনো এমন কিছু বলেনি।’
‘ডাক্তার বলেনি বলেই তো আমি বললাম। তারা বললে আর আমি বলতে যাব কেন?’
‘কাজ হবে এতে?’ আমি এই উদ্ভট চরিত্রের ছেলের ততোধিক উদ্ভট কথাবার্তায় আস্থা রাখতে পারছি না।
‘জানি না। হতেও পারে আবার বেশি ভয় পেলে মরে টরেও যেতে পারে, শিওর না।’ মুখের ভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না এনেই ভয়াবহ কথাটা অবলীলায় বলে ফেলল অভ্র। আমার আহত দৃষ্টিকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে পান মুখে দিল, এরপর উঠে দাঁড়াল।
‘সর্বমোট খরচ, তিনশো পচাশি টাকা। পানের দশ টাকা আমার। বাকি তিনশো পচাত্তর টাকা দিয়ে দে,আমি বিদেয় হই।
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে একশো টাকার চারটা নোট ওর সামনে রেখে বললাম,‘আচ্ছা, মায়াকে কিভাবে ভয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবো?’
‘কিভাবে দাঁড় করাবি তার আমি কী জানি?’ খুচরো পঁচিশ টাকা টেবিলে রেখে দরজার দিকে হাঁটা দিল অভ্র। থমকে দাঁড়াল ঠিক দরজার মুখে গিয়ে। ‘তবে এতটুকু বলে দিতে পারি, তোর বউ যেহেতু অন্ধকারকে ভয় পায় সেহেতু তোকে পৃথিবীর সবচাইতে অন্ধকারে জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। সেখানে নিয়ে যেতে হবে মায়াকে। তাহলেই ও সুস্থ হয়ে যাবে।’
আমি চোখে প্রশ্ন এবং বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি অভ্রর দিকে। পৃথিবীর সবচাইতে অন্ধকার জায়গা?
আমি মাথা নামিয়ে নিলাম, আমার দিকে তাকিয়ে ঠিক এই সময় রহস্যময় এক হাসি দিল অভ্র। হাসিটাই যেন আমাকে বলে গেল উত্তরটা। আমি জেনে গেলাম পৃথিবীর অন্ধকারতম জায়গার ঠিকানা। শিউরে উঠলাম এই ভর দুপুরবেলাতেও।
ঝট করে মাথা তুললাম। রুম খা খা করছে। কেউ নেই।
ছয়
আঁধার চেপে বসতে চাইছে চারদিক থেকে। এতটাই গাঢ় যেন শরীর আছে ওদের। মোচড় খাচ্ছে, পাঁক খাচ্ছে মেঘের মত। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় মুহূর্তেই। পৃথিবীর অন্ধকারতম জায়গা!
আমি মায়ার হাত ধরে বসে আছি। মায়ার জ্ঞান নেই। প্রায় দু’ঘন্টা যাবত সংজ্ঞাহীন মায়া। কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। সেভাবেই ওকে ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে।
জমাট আঁধারে কেটে গেল আরো কিছুক্ষণ। আমার হাতের ভেতর মায়ার হাতে প্রাণ এল। নড়ে উঠল। কাচের চুড়িতে আওয়াজ উঠল টুং করে। বদ্ধ জায়গায় রিনরিনে প্রতিধ্বনি। মায়ার জ্ঞান ফিরেছে। আমি না দেখেও উপলব্ধি করতে পারলাম, চোখ খুলে নিকষ আঁধার দেখে মায়ার ভেতরটা কেঁপে গেল।
‘মায়া?’ আমি নরম স্বরে ডাক দিলাম।
‘এত অন্ধকার কেন?’ গলা কেঁপে গেল মায়ার। ঘামের স্রোত বইল দেহে। জায়গাটা বড্ড ভ্যাঁপসা।
‘মায়া, আমরা এখন কোথায় আছি জানো?’
‘কোথায়?’ ভয় পাচ্ছে মায়া।
‘আমরা এখন মাটির নীচে। এখানে মাটি খুড়ে একটা ঘরের মত বানানো হয়েছে। দশ মিনিট আগে আমাদের এখানে রেখে উপরে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। আধঘন্টা পর আমার লোক খুঁড়ে বের করবে। আমাদের দু’জনের আধঘন্টা চলার মত অক্সিজেন এখানে আছে। ব্যাকআপ হিসেবে অক্সিজেনের সিলিন্ডারও রাখা হয়েছে। তবে...।’ আমি ইচ্ছে করেই থেমে গেলাম।
‘তবে কী? এসবের মানেটাই বা কী? প্লিজ, আমাকে এখান থেকে বের করে নিন। আমি খুব ভয় পাচ্ছি।’ এবার মায়ার গলায় কান্নার আভাস। হাতটা অদম্য ঘোড়ার মত অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছে। গোটা দেহের খবর জানি না।
‘তবে...এখানে কোনো আলো নেই। বাইরেও আজ ঘোর কৃষ্ণপক্ষ। আরো বিশ মিনিট পর আমাদের এখান থেকে বের করা হবে, তার আগে আমরা চাইলেও বের হতে পারব না। বলতে পারো, আমরা এখন এক ধরনের কবরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে আছি। পৃথিবীর অন্ধকারতম জায়গা!’
আমার কথা শেষ হবার আগেই হু হু করে কেঁদে উঠল মায়া।
আমি মায়ার কাঁধে হাত রাখলাম। টেনে নিলাম বুকের সীমানায়। দু’জনেই ঘামে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছি। মায়ার চুলে হাত ঢুকিয়ে দিলাম।
‘ভয় পেও না,সোনা। এই তো আমি এখানে। দেখো, তুমি যে অন্ধকারকে ভয় পাও সেই অন্ধকারেও আমি তোমার পাশে আছি। সারা জীবন থাকব। আমরা দু’জন মিলে আঁধারে আলো জ্বালব। ভয়ের কিচ্ছু নেই।’ বিরতি নিয়ে ডাক দিলাম আবারও,‘মায়া?’
ডুকরে উঠে সাড়া দিল মেয়েটা। থরথর করে কাঁপছে। কয়েক পোচ ঘাম শাড়িটাকে আরো ভিজিয়ে ফেলছে।
‘মায়া,আমি জানি, চোখ বন্ধ করে আছো তুমি। চোখ খোলো,মায়া। অন্ধকারকে একবার ছুঁয়ে দেখো, ঠিক তোমার পরনের শাড়ির মত, তোমার চুলের মত মোলায়েম ওরা। জানো অন্ধকার গান গায়? নিস্তব্ধতাই ওদের গান। শুনবে তুমি?’
আমার কথাগুলো ওর কানে যাচ্ছে কিনা আমি জানি না। এই মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদছে মায়া। স্বাভাবিক কান্না নয়। বিকারগ্রস্থের কান্না।
আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আরো পনেরো মিনিট। এতক্ষণ টিকবে তো মেয়েটা? আমি আরো কাছে টেনে নিলাম ওকে। চুলের আরো গভীরে হাত পৌঁছে গেল।
‘মায়া, আমাকে বিশ্বাস করো তুমি?’ জবাবের অপেক্ষায় না থেকেই বললাম,‘তাহলে একটাবার চোখ খোলো। অন্ধকারকে কাছ থেকে দেখো। তাহলেই বুঝবে আঁধার কতটা নিরীহ। এই তো, আমি আছি। কোনো ভয় নেই তোমার। চোখটা খোলো,মায়া। অন্ধকারের ভেতর দেখতে চেষ্টা করো। দেখবে, এক ধরনের অপার্থিব আলো দেখতে পাবে। চোখ খোলো মায়া, চোখ খোলো।’ শেষের দিকে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। মায়ার দেহের কাঁপুনি তখন আমার কন্ঠেও।
আমি ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে জীবনের সব চাইতে বড় ভুলটা করে ফেলেছি আমি। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে। মায়ার কান্না আর আমার চিৎকার আরো বেশি করে অক্সিজেন টেনে নিচ্ছে ফুঁসফুঁস। স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত কমে আসছে জীবনীশক্তি। আমি দিশেহারা হয়ে পড়ছি, ঠিক সেই সময় প্রবল আতংক নিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার হাতের মধ্যে মায়া নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কোথাও কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। বুকের ওঠা নামায় ধীর গতি। একসময় থেমে গেল সমস্ত আন্দোলন। নিথর হয়ে গেল মায়া!
হঠাৎই আমার আতংক বদলে গেল চূড়ান্ত বিস্ময়ে। মায়া নিস্তেজ হয়নি, ওর কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেছে শুধু! ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি। তাতে নেই কোনো অস্বাভবিকতা।
আচমকা থেমে গেল সেটাও। কবরের মধ্যে নেমে এল সত্যিকারের কবরের নিস্তব্ধতা!
আমি দম বন্ধ করে আছি। মায়াকে ডাক দেবার সাহস পাচ্ছি না। মায়া কি তবে ফুরিয়ে গেল? নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ভয়াবহ অসহায়বোধ আমাকে অন্ধকারের মতই চেপে ধরছে। হঠাৎই এমনসময় জল তরঙ্গের বাজনায় কথা বলে উঠল কেউ।
‘তুমি সত্যিই সারা জীবন এভাবে আঁধারে আলো দেখাবে আমায়?’
আমি প্রশ্নের জবাব দিলাম না। দিতে পারলাম না। আরো স্পষ্ট করে বললে, আমি প্রশ্নটা বুঝতেই পারলাম না। আমি শুধু বুঝতে পারলাম, মায়া সুস্থ হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, আর কখনই মায়া অন্ধকারকে ভয় পাবে না। বুঝতে পারলাম, মায়া জমাট আঁধারেও ওর ভেতরে আমার জন্য উপযুক্ত সম্বোধন খুঁজে পেয়েছে।
মায়াকে জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত হল। শক্ত হল মায়ার বাঁধনও।
আমি,আঁধার আর মায়া নিস্তব্ধ কবরে জড়াজড়ি করে বসে আলোর অপেক্ষায়...