আরও দুটি প্রাণ অকালে ঝরে গেলো। ঝরে গেলোর পরিবর্তে আসলে বলা উচিত খুন হলো। বাস্তবে তাই ঘটেছে। খুন দুটো করেছে কৌশিক। কৌশিকের হাতে এখনও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। যারা প্রফেশনাল খুনি তাদের জন্য তো বটেই সব ধরনের খুনিদের প্রিয় সময় রাত। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড রাতেই সংঘটিত হয়। শুধুমাত্র কৌশিকের বেলায় একটু ব্যতিক্রম। ওর চোখের একটু সমস্যা থাকায় রাতের বেলা দেখতে অসুবিধা হয়। তাই ওর কাছে খুনের প্রিয় সময় ভোরবেলা।
কৌশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শুধু ছাত্র নয়, ওর আরেকটা পরিচয় ও একজন ছাত্রনেতা। ছাত্রনেতা হওয়ার পর থেকেই কৌশিকের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আগে একদম রক্ত সহ্য করতে পারতো না। অথচ এখন প্রায়ই ওর দিন শুরু হয় কারো জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে। এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, তবে করার কিছু নেই। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হলে, ওর নিজের জীবন টিকিয়ে রাখতে হলে এই খুনগুলো জরুরী,ভীষণ জরুরী।
হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ ধোয়ার জন্য বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ও। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই অবাক হলো। কি সুন্দর শান্ত-শিষ্ট, নিরীহ ধরনের চেহারা। এই চেহারার আড়ালে যে একজন নিষ্ঠুর খুনি থাকতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এধরনের কথা ভেবে কৌশিকের অনেক ভালো লাগলো। শিষ বাঁজাতে বাঁজাতে রুমে এসে ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সকাল আটটায় ওর ক্লাস। ও অবশ্য ক্লাস করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভার্সিটি যাচ্ছে না। ছাত্র নেতা হিসাবে ওর অনেক কাজ। ক্লাস নিয়ে পড়ে থাকলে কাজের দেখাশুনা কে করবে?
অনেক ভিড় ঠেলে, বাদুর ঝোলা হয়ে কৌশিক বাসে উঠতে সক্ষম হলো। বাসে একটা মুরগী ওঠানোর জায়গাও নেই। তারপরেও বদমাশ ড্রাইভার যেখানে-সেখানে বাস থামাচ্ছে। ফাজিল কনডাকটার হাঁকছে –“আয়া পড়েন ভাই, আয়া পড়েন। ডাইরেক গুলিস্থান,সদরঘাট...। সিট আছে, সিট আছে, আয়া পড়েন। ওই গুলিস্থান,সদরঘাট...।”
কৌশিকের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। ভোরের খুন দুটোর মত ড্রাইভার আর কনডাকটারকেও খুন করতে ইচ্ছে করছে। ব্যাটা ফাজিলের ফাজিল। বাসে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর শালা...। কৌশিক অনেক কষ্টে রাগটা দমন করলো। এটা পাবলিক বাস। চাইলেই তো সবকিছু সম্ভব নয়। আর এদের খুন করেই বা কি হবে? এরা তো কষ্ট দিচ্ছে কয়েকজন মানুষকে। অথচ যাদের উপর পুরো দেশের মানুষের জীবন নির্ভর করছে, যারা দেশের সবাইকে কষ্ট দিয়ে নিজেরা আরামে আছে , দেশকে ফকির বানিয়ে নিজেরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে- তাদের তো কেউ খুন হচ্ছে না। কৌশিকের অবশ্য মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই ধরনের লোকদের খুন করতে। প্রতিদিন সকালে যদি দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অসৎ, দেশপ্রেমহীন দুয়েকটা নেতাকে ও খুন করতে পারতো তাহলে ওর অনেক ভালো লাগতো। কৌশিক আশা করে একদিন সেই সুযোগও আসবে। ছোট ছোট খুন থেকেই বড় খুনের সূচনা হয়। আজ হয়তো ও পুঁটি মাছ মারছে কিন্তু এভাবে অভ্যাস হয়ে গেলে রুইকাতলা মারতে কতক্ষন? এসব উল্টাপাল্টা ভাবতে ভাবতে কৌশিক ভার্সিটির এলাকায় প্রবেশ করলো।
সারাদিন বিভিন্ন মিটিং, এর সমস্যা, ওর সমস্যা মিটিয়ে বিকালের দিকে আবার বাদুর ঝোলা হয়ে বাসে উঠলো। বাসে ওর পাশে এক মহিলা অনেক কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলার সামনে একটা সিটে ৫-৬ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে স্কুল ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। কৌশিক ওই বাচ্চাকে উঠিয়ে দিয়ে মহিলাটা কে বসতে বললো। কিন্তু মহিলা রাজী হলেন না। বললেন-“বাবা, এটা আমারই ছেলে। স্কুলে না জানি কতো কষ্ট করে এসেছে, এজন্যই এখন একটু আরামের প্রয়োজন।” এই বলে মহিলা তার আচল দিয়ে ছেলেটির কপালে জমে থাকা ঘাম মুছিয়ে দিলেন। অথচ ওই মহিলা নিজে ঘেমে প্রায় ভিজে গেছেন, সেদিকে খেয়ালই নেই।
সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কৌশিককে মুগ্ধ করলো। বাসায় এসে বসে ভাবতে লাগলো। হঠাৎ ওর নিজের কথা মনে পড়লো। আচ্ছা ও তো প্রতিদিন দুই একটা প্রাণ কেড়ে নেয়, ও যাদের হত্যা করে তাদেরও কি পরিবার আছে? যে পরিবারে মা হয়তো বসে থাকে তার সন্তান ফিরে আসবে- এই আসায়। অথচ তারা আর ফিরে আসে না । কৌশিক অদের ঘরে ফিরতে দেয় না, বরং ওদের রক্তে হাত লাল করে দিন শুরু করে। কৌশিকের মনে হঠাৎ এক ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলো আজ থেকে ও আর কাউকে খুন করবে না, কোন প্রাণ আর ওর হাতে ঝরতে দেবে না। ও যদি সামান্য একটু চেষ্টা করে তাহলেই তা সম্ভব।
পুনশ্চঃ হ্যাঁ, কৌশিক ওর কথা রেখেছে। নতুন করে ওর হাতে কাউকে প্রাণ হারাতে হয়নি। আসলে গরমের কারণে এতোদিন ও মশারি না টাঙ্গিয়ে ঘুমাতো। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর থেকে ও রাতের বেলা মশারি টেনে ঘুমায়। মশারা আর ওকে বিরক্ত করতে পারে না। ফলে সকাল করে আর কারও রক্ত ঝরে না। কৌশিকের হাতেও কোনও মশার অকালে প্রাণ দিতে হয় না!