স্কুল পাশ করার পর থেকে শুধু বয়সটাই বেড়েছে, চেহারার আকার আয়তন তেমন একটা বাড়েনি। এটা নিয়ে শুরুতে আমার নিজের মধ্যে কোন দুঃখ ছিল না, কিন্তু আমার শীর্ণ চেহারা নিয়ে আশেপাশের মানুষের দুঃখ দেখে আমিও একটু আধটু দুঃখ অনুভব করা শুরু করলাম। যখন কলেজে পড়তাম তখনও চেহারা অপরিবর্তিত ছিল। কলেজের ফিজিক্স স্যার একদিন বললেন-এই ছেলে নেক্সট দিন থেকে চেহারা ঠিক করে কলেজে আসবে, তোমাকে দেখলে গাঁজাখোরদের মতো মনে হয়!
স্যারের কথা শুনে আমার দুঃখ পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমি খুশি হয়ে উঠলাম। কিছুদিন আগে বাসে করে যাওয়ার সময় কন্ডাক্টরকে যখন হাফ ভাড়া দিয়েছিলাম সে তখন চোখ কপালের একটু উপরে তুলে গভীর বিস্ময়ে বলেছিল-‘কন কি, আপনেও স্টুডেন্ট!’ সেদিন থেকেই আমি কন্ডাক্টরের বিস্মিত হওয়ার কারণ খুঁজে ফিরছিলাম। আমি স্টুডেন্ট হওয়াতে সে এতো অবাক হল কেন? ভেবে কোন সমাধান না পেলেও ফিজিক্স স্যারের কথা শুনে সেদিন কন্ডাক্টরের বিস্ময়ের কারণ আবিস্কার করে ফেললাম। অর্থাৎ আমার চেহারা এরকম পর্যায়ে গেছে যে আমার মধ্যে ছাত্র ভাব নেই! এর সমাধান কি হতে পারে? পাড়ার সিরাজ ভাইরে ধরলাম। সিরাজ ভাই হচ্ছেন আমাদের জুনিয়রদের সব আশা ভরসার আশ্রয় স্থল। অবশ্য বেশীরভাগ সময়ই উনার আইডিয়া ব্যাক ফায়ার করে! এটা নিয়ে আমরা একটু হাসাহাসি করলেও উনি গায়ে মাখেন না। দ্বিগুন উৎসাহে অন্য জনের সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবেন। কেউ সমাধান না চাইলেও গায়ে পড়ে তার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান। সিরাজ ভাই কে ঘটনা খুলে বললাম-‘ ভাই সমাধান দেন।’ উনি কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে বললেন-‘চশমা।’
হঠাৎ চশমা শব্দটা শুনে কিছু না বুঝেই বললাম-ভাই চশমা কে?
-আরে গাধা, চশমা কেউ না। চশমা হচ্ছে তোর সমস্যার সমাধান। এবারে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো। সিরাজ ভাই আমাকে চশমা ব্যবহার করতে বলছেন শুনে আনন্দিত হলাম। ছোটবেলা থেকেই চশমার প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার চোখে কখনই কোন সমস্যা হয় নি। সম্ভবত ছোটবেলায় ভিটামিন এ এর ডোজ একটু বেশীই পড়েছিল। সিরাজ ভাই বলতেই লাগলেন-‘এখন সমাজে এক ধরনের নিয়ম চালু হয়েছে। যারা চশমা পড়ে তারা অনেক জ্ঞানী, গুণী ব্যক্তি। তাদের জ্ঞানের ধার এতো বেশী যে সাধারণ চোখে কারো দিকে তাকালে সে ভস্ম হতে বাধ্য। এজন্য তারা চশমা পড়ে থাকেন। ভাব ধরার চেষ্টা আর কি। আরে মিয়া, জ্ঞান কি চশমায় লেখা থাকে নাকি। অনেক আম পাবলিকরে দেখি চশমা পড়া কাউকে দেখলে এরকম ভুল ধারণা নিয়ে থাকে। এজন্য আমি চশমার বিরুদ্ধে। আমাকে দেখ, আমি কি অন্য কারো চেয়ে কম জ্ঞানী! অথচ আমি চশমা পড়ি না। কেন পড়ি না? মানুষের ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যই চশমা পড়ি না।’
-তাহলে আমাকে চশমা পড়তে বললেন যে? কোন রকমে ধোঁক গিলে জানতে চাইলাম।
-এই নষ্ট ভ্রষ্ট সমাজে তোর সমস্যার সমাধান ওই একটাই। তাই পড়তে বললাম। চশমা পড়লেই দেখবি পথে ঘাটে, বাসে, কলেজে সবাই তোকে সমীহ করে চলবে। এক কাজ কর, আজই চোখের ডাক্তারের কাছে যা।
-‘জ্বি ভাই।’ জ্বি ভাই, বলা যতটা সহজ, চশমা পাওয়া তত সহজ হল না। ডাক্তার চোখ টোখ পরীক্ষা করে, চোখে কোন সমস্যা না পেয়ে একটা ড্রপার হাতে ধরিয়ে বের করে দিতে ধরেছিলেন, পরে অনেক কষ্টে উনাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে আমার ড্রপারের দরকার নেই, চশমাই দরকার।
চশমার শখের মতো আমার আরও একটা শখ ছিল। বিয়ের আগে একটা মেয়ের সাথে হলেও প্রেম করবো। কিন্তু আমার মতো ‘হ্যাংলা-পাতলা’ টাইপের ছেলের সাথে কে প্রেম করবে? চশমা ব্যবহারের কারণে ভার্সিটি জীবনে সবাই আমাকে ভালো ছাত্র ভেবে ভুল করতো, মেয়েরা নোটস নেওয়ার জন্য যেচে পড়ে কথা বলতো। কিন্তু ওই পর্যন্তই, প্রেম আর হয় না। ভার্সিটির শেষ বর্ষে গিয়ে সাথী নামে একটা মেয়েকে এতোটাই মনে ধরলো যে আমার মনে হতে লাগলো এই মেয়েকে না পেলে আমার মানব জন্ম বৃথা! সাথী আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র। মেয়েটা যখন আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে চুলের বেণী দুলিয়ে যায় তখন আমার হ্যাংলা-পাতলা মনের ভেতর ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ বয়ে যায়। ধীরে ধীরে সাথীর চিন্তায় অস্থির থেকে অস্থির হতে হতে যাকে বলে নাওয়া খাওয়া ভুলে গেলাম। এতে আমারই লস হল। অনিয়মিত খাওয়ার কারণে চেহারা খানা আরও হ্যাংলা হয়ে গেলো। বন্ধু বান্ধব আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন জোর করেই আমাকে সাথীর সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাকে প্রপোজ করতে বললো। আমি ভয়ে হরবর করে কি বলেছিলাম মনে নেই, তবে সাথী যে উত্তর দিয়েছিলো সেটা বেশ মনে আছে। বলেছিল-‘আয়নার সামনে দাঁড়ালে সম্ভবত নিজের চেহারা দেখতে পান না, তাই না ভাইয়া? অবশ্য দেখতে না পাওয়ারই কথা। এরকম সুতার মতো একটা চেহারা দেখাতে আয়নাও লজ্জা পাবে!’ কি অপমান! কি অপমান! এই অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না।
অবশ্য মরে যাওয়ারও কোন মানে হয় না। সে যাই হোক, এরকম অপমানের প্রতিশোধ তো নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এবারো বন্ধুরাই সিদ্ধান্ত ঠিক করে দিলো। তুই যে করেই হোক, দুই মাসের মধ্যে মোটা হয়ে সাথী কে দেখিয়ে দিবি তুই কি জিনিস! বন্ধুর কথা মনে ধরলো। সেদিন থেকে মোটা হওয়ার জন্য খোঁজ খবর শুরু করলাম। রাস্তার অনেক জায়গাতেই দেখলাম-‘আপনি কি ওজন কমাতে চান? স্বাস্থ্য কমাতে চান?’ টাইপের বিজ্ঞাপন। এরকম বিজ্ঞাপন দেখে হিংসাই লাগলো। এরকম ভাগ্যবান মানুষও তাহলে আছে যারা স্বাস্থ্য কমায়! আহ! অন্যের ভাগ্য দেখলে আমার চলবে না। কিন্তু ‘মোটা হওয়ার উপায়’ টাইপের কোন বিজ্ঞাপন খুজেও পেলাম না। নীল ক্ষেতে গিয়ে সমস্ত বইয়ের দোকান চষেও মোটা হওয়ার ১০১ টি উপায় টাইপের কোন চটি বই পেলাম না, যদিও বা চটি বইয়ের অভাব সেখানে ছিল না।
আমার দুঃখে কাতর হয়ে সিরাজ ভাই এবারো এগিয়ে এলেন। আমি যেহেতু ডুবন্ত মানুষ, তাই খড় কুটো হিসেবে সিরাজ ভাইকেই আঁকড়ে ধরলাম। সিরাজ ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন একটা খামারে, যেখানে আশেপাশে অনেক নাদুস নুদুস গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সিরাজ ভাই সম্ভবত গরু কেনার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন, পরে বুঝলাম ঘটনা অন্য কিছু। উনি সরাসরি উনার পরিচিত এক গরুর ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন-‘স্যার, আপনি তো কুরবানির আগে গরু-ছাগল মোটা করে দেন, আমার ভাইটাকে একটু মোটা করে দেন না স্যার? ওর অনেক দুঃখ! প্লিজ স্যার ওকে একটু মোটা করে দেন।’ সিরাজ ভাইয়ের কথা শুনে ডাক্তার আমার দুঃখ বুঝলেন কি না জানি না, তবে আশেপাশের গরু গুলোকে দেখলাম মায়াময় চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!’ সিরাজ ভাইকে অনেক ধমক ধামক দিয়ে গরু মোটাতাজাকরন খামার থেকে ডাক্তার আমাদের বিদায় দিলেন। এতে আমি অপমানিত বোধ করলেও সিরাজ ভাইকে আনন্দিত হতে দেখলাম। উনাকে আনন্দের কারণ জিজ্ঞেস করলাম, উনি একটা রহস্যময় হাসি দিলেন। বললেন-‘রাতে জানতে পারবি। তুই আর মোটা হওয়া নিয়ে টেনশন করিস না। সব সমস্যার সমাধান আজ রাতেই হবে।’ জীবনে সিরাজ ভাই এর উপর ভরসা না করলেও আজকের কথাটা শুনে অনেক ভালো লাগলো। সব সমস্যার সামাধান যদি আজ রাতেই হয় তাহলে...তাহলে সাথী তুমি তৈরি থেকো। তোমাকে আমি দেখে নেবো!
রাত ১২ টার দিকে সিরাজ ভাই আমাকে তার বাসায় ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি ষণ্ডা মার্কার দুই তিন জন লোক দাঁড়িয়ে আছেন, আর সিরাজ ভাই কি একটা ইনজেকশনের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি যাওয়া মাত্র ষণ্ডা লোকগুলো আমার হাত পা শক্ত করে আটকে ধরলো। মনে হচ্ছে আমাকে বন্দী করলো। আমি কিছু বলার আগেই সিরাজ ভাই বললেন-‘শোন মুখলেস, ভয় পাস না। ব্যাটা গরুর ডাক্তার কিছু না বুঝেই বিদায় করে দিলো এটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি সিরাজ কি সহজে হাল ছাড়বো, বল? আসার সময় গরু মোটা করার জন্য যে ইঞ্জেকশনটা দেয় ওটা চুরি করে এনেছি। এখন এটা তোর শরীরে পুশ করলেই তোর দুঃখ দূর হবে। তোর সাথী না মাথী কি নাম যেন বলেছিলি মেয়েটার ওকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে পারবি। নে, আর দেরী করা ঠিক হবে না। এই তোমরা ওকে একটু শক্ত করে ধরো।’
সিরাজ ভাইয়ের কথা শুনে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেলো। পালানোর জন্য ধস্তাধস্তি করলাম, লাভ হল না। ষণ্ডা মার্কা লোকগুলোর গায়ে অনেক জোর। আমার মুখ দিয়ে এক ধরনের গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতে লাগলো। সিরাজ ভাই ধীর স্থির ভাবে হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনার মুখে ঝুলছে দ্বিগবিজয়ি বিজ্ঞানীর হাসি। অজ্ঞান হওয়ার আগে হাসিটাকে বড় ভয়ংকর লাগলো!