মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৯৮- ভূতের সঙ্গে প্রেম ?

ভূতেরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ( জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া অঞ্চল ) বাংলার শিক্ষক হিসাবে ভূতনাথ পত্রনবিশ, ২৫ বৎসর বয়সে, যোগদান করে তার নতুন চাকরীতে । রূপদর্শনে কুশ্রী, চেহরাতে খর্বাকৃতি ভূতনাথ, “ প্রথম দর্শনে প্রেম ” –এর বিপরীত অর্থটিকে বোধহয় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন অভিধানে । এ ছাড়াও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাম্মণ পুরোহিত হিসাবেও তার পরিচিতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিলো তার বাসস্থান শিলিগুড়ি ও তার বর্তমান কর্মস্থল বীরপাড়া অঞ্চলে এবং ভুতেরহাটের স্বল্প মানুষ বিশিষ্ট গ্রামটিতে । বোধহয় ভাগ্যের পরিহাসই হবে, ভূতনাথ শিক্ষক হিসাবে যোগদানের ৮/৯ মাসের মধ্যেই ছাত্রছাত্রী স্বল্পতা হেতু স্কুলটিই বন্ধ হয়ে যায় । ভূতনাথও ফিরে যায় তার পুরানো পেশা পুরোহিত বৃত্তিতেই । এই ৮/৯ মাসে ভূতনাথের সঙ্গে আলাপ হয় মা মরা ষোড়শী সহেলী লেপচার সঙ্গে । সে মাসোহারা চুক্তিতে রান্না করে খাবার পৌঁছে দিতো স্কুলের মাস্টারমশাইদের ।
সহেলী লেপচার বাবা ছিলো মদ্যপ । তাই মা মরা এই ছোট্ট ষোড়োশী মেয়েটা এই ছোট্ট গ্রামে খাদ্যসংগ্রহের লড়াইতে নিজেকে যেমন বাঁচিয়ে রেখেছে সঙ্গে বৃদ্ধ মদ্যপ পিতাকেও । ভূতনাথ মধ্যাহ্নের খাবারের অছিলায় প্রায়ই আসতেন সহেলীদের কাঁচা ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরে, বহুসময় গল্পও করতেন সহেলীর সঙ্গে । হয়তো যুবক ভূতনাথের মনে ‘বিয়ে’ শব্দটাও উঁকিঝুকি দিচ্ছিল তখন । কিন্তু কর্মচ্যুতি সম্তবত স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে । ভূতনাথ ফিরে গেছে তার জীবনযুদ্ধে, সহেলী পড়েছে অসহ্য দারিদ্র্যের মধ্যে, ক্ষুধা মেটানোর সংগ্রামে । পিতার মৃত্যুর পর বছর দেড়েক আগে সহায়সম্বলহীন এক প্রৌঢ় গ্রামবাসী সহেলীকে ঘরণী করে সংসার পেতেছিলো এখানেই । কিন্তু কি যে ঘটে গেলো, মাসছয়েক আগে সাংসারিক অশান্তি সহেলীকে বাধ্য করলো গলায় কাটারির কোপ নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে । আর তার স্বামী এখন ক্ষুধা মেটাচ্ছেন জেলের গারদের ভিতর বসে । এতসব খবর অবশ্য ভূতনাথ রাখতো না ।
এমা কী সব বকে চলেছি, ভুতের গল্প লিখতে গিয়ে এসব আবার কি? আচ্ছা বাদ দিলাম তবে বাজে বকা, শোন পরেরটুকু খুব মন দিয়ে । ….
কোচবিহারে যজমানের মেয়ের বিয়ে আগামীকাল, তাই আজই শেষ বাসে বসে পরে ভূতনাথ, যাতে রাত্রের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে । বিধি বাম হলে যা হয় আর কি, বীরপাড়ার কাছে এসে বাস হয়ে যায় খারাপ । চতুর ভূতনাথ বাস থেকে নেমেই চিন্তা করে ‘শাপে বর হলো’, অনেকদিন পর না হয় আজ রাত্রটা সহেলীদের বাড়িতেই গল্পগুজব করে কাটিয়ে দেবে, সকালের প্রথম বাস ধরে না হয় যাওয়া যাবে যজমান বাড়ি । শীতের রাত্রের অন্ধকারে বীরপাড়া থেকে মাইলখানেক দূরে চা-বাগানের মোরাম রাস্তার ধারে ভুতেরহাট গ্রামটি । সে হাঁটা আরম্ভ করলো, কিন্তু দিকভ্রান্ত হয়ে এক ঘন্টাতেও খুঁজে পেল না ভুতেরহাট গ্রাম । তার মন জুড়ে তখন সহেলী, আর বিশ্রামের অবকাশে শুধুই গল্প । এক হালকা পাতলা কমলা লেবু গাছতলাতে দাঁড়িয়ে সে ঠাহর করতে শুরু করে, আর কতদূর । হঠাৎ তার সম্বিত ফেরে যখন ভয়ের দৃষ্টিতে সে দেখে কোথা থেকে যেন এক কদাকার দর্শন বিরাট এক ‘হুতুমপেঁচা’ তার সামনেই, শরীরে শিহরণ খেলে যায় ভূতনাথের, সে ভাবে আজ কী বিপদেই না পরি যে । এই ভাবতে ভাবতেই তার মাথার উপরেই গাছ থেকে ডেকে ওঠে এক ‘শ্মশানকুলি’ পাখি, যেন রাতের অন্ধকারে সাক্ষাত যমরাজ । ভূতনাথের শিরা উপশিরায় এক হিম রক্তস্রোত যেন তাকে অবশ করে দিচ্ছে । কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভূতনাথের অজান্তেই তার হাত চলে গেছে তার জামার নীচে, আর উপবীত ধরে সে ইষ্টনাম আর রামনাম জপতে শুরু করে দিয়েছে । ইত্যবসরে হঠাৎই তার নজরে পরে কিয়ৎ দূরে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে এক মহিলা হেঁটে চলেছে । ভূতনাথের প্রানে জল এল যেন, সে বড় বড় পায়ে মহিলাকে ডাকতে ডাকতে অনুসরন করতে লাগলো । “ ও মেয়ে, শুনতে পাচ্ছ না? ঐ সহেলীদের বাড়িটা কোথায় গো? জান তুমি? আমি যে পথ হারিয়ে খুঁজে পাচ্ছি না ।” মেয়েটি থামলো না, তবে হাত তুলে ইশারায় আসতে বললো তার পিছনে । মেয়েটির দ্রুততার সঙ্গে পা মেলাতে পারছে না কিছুতেই, যাইহোক ভূতনাথ ভাবলো চলি ওর পেছনে পেছনেই, এই রাত্রিতে মানুষের সঙ্গটা অন্তত পাচ্ছি তো । অনেকক্ষন হাঁটার কারণে ভূতনাথের ক্ষিদেও পেয়েছে খুব, ভূতনাথ আবার ডেকে ওঠে, “ ও মেয়ে আমি যে আর পারছি না, খুব ক্ষিদে পেয়েছে গো, একটা মিষ্টির দোকান ছিলো না এখানে? সেও কি বন্ধ হয়ে গেছে নাকি গো?” এই কথা শুনে মেয়েটি বাঁমে বাঁক নেয়, রাস্তা ছেড়ে মাঠের উপর দিয়ে । অগত্যা ভূতনাথও মেয়েটির পিছনে পিছনে মাঠে নেমে নজরে পরে কিছুদূরে একটা ছোট্ট লাইটের আলো । সামনে এসে দেখে হ্যাঁ সেই মিষ্টির দোকানই তো, কিন্তু কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেছে । চাদর মুড়ি দিয়ে মহিলা কয়েক পা দূরে গিয়ে দাড়ালো । সারাদিনের বিক্রি-বাট্টার পর অবশিষ্ট কয়েকটা মাত্র রসগোল্লা খেয়ে, জল খেয়ে ভূতনাথ দোকানীকে শুধোয়, “ ঐ সহেলীদের বাড়িটা কোনটা গো? চিনতে পারছি না চারিদিক যা অন্ধকার ।” দোকানী কেমন যেন চাঁপা বিভৎস গলায় উত্তর করে, “ সহেলী তো আপনার সঙ্গে সঙ্গেই যাচ্ছে আপনাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে । সহেলীকে চেনেন না নাকি আপনি?” অবাক ভুতনাথ বলে, “ না, যা শীত, আর ওর চাদরে ঢাকা মুখটা আমি দেখিনি তো এখনও । আঃ বাঁচালে বাবা তুমি আমায় । হ্যাঁ, তোমার কতো দাম হলো বলোতো?” দোকানী বলে, “ থাক, সহেলীর থেকে নিয়ে নেবো ।” লোভী ব্রাম্মণ তুষ্ট হলো এই উত্তরে । ভুতনাথ সঙ্গে সঙ্গেই সহেলীর দিকে দ্রুত পা বাড়ায় আর বলে, “ এই তুই কিরে? তোকেই তো প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম, তুই বলবি তো যে তুইই সহেলী । দেখ দেখি, আমার ভয় ভয় ভাবটা, এতক্ষনে কাটলো তবে । দাঁড়া, একসঙ্গে যাই এবার গল্প করতে করতে ।” সহেলী উত্তর না করে এবার পা বাড়ায় দ্রুত । আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক ভাঙ্গাচোরা ঘরের ভিতরে ঢুকে পরে । ভূতনাথ বলে, “ এ কী হাল করেছিস রে, এ তো বেড়াটাও জীর্ণ হয়ে ভেঙ্গেচুরে গেছে, ছাদের টালী তো আর্ধেক নেই রে । এ্যাঃ । এখানে তো রাত কাটানোও সমস্যা । আসব ভিতরে ?” এতক্ষনে ভূতনাথ গলা শোনে ভিতর থেকে, “ এসো” । চেনা গলা পেয়ে ভূতনাথ ঘরে ঢোকে । শতছিন্ন বিছানার চাদরটা টানটান করে, ভূতনাথ বিছানায় বসতে গিয়ে তক্তোপোষটা এমন ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠলো, যে ঘরের সব নিস্তব্ধতার অবসান হলো যেন ।যাক গে ভূতনাথ হাঁক দেয়, “ সহেলী, তোর বাবা আজ ফেরেনি ?” পাশের ঘর থেকে উত্তর এল, “সে তো কবেই মরে ভূত হয়েছে গো । হিঃ হিঃ হিঃ ।” সহেলীর হাসিতে ভূতনাথের গা টা ছমছম করে উঠল । ভূতনাথ বললো, “তবে এই ফাঁকা মাঠে ভূতেরহাটের ভূতপুরীটা তুই এখন একাই সামলাস বল ?” আবার সেই ভয়ঙ্কর হাসি হিঃ হিঃ হিঃ । ভূতনাথের কানে এতটাই বাজে ঠেকল যে, তার বুকের ভেতরটা পর্যন্ত ঠকাস ঠকাস করে বাজতে লাগল । “ তুই ও ঘরে কেন, আয় এঘরে, একটু গল্প করি? কতদিন পর তোকে দেখলাম । ” ভূতনাথ ডাকে সহেলীকে । সহেলী চাদর মুড়ে এসে বসে ঐ তক্তোপোষের এক কোনায় । ভূতনাথ বলে, “ তোর মনে আছে, তুই কি সুন্দর সুন্দর রান্না করে খাওয়াতিস আমাকে এই ঘরটায় । তোর রান্নাগুলো কিন্তু এখনও আমার মুখে লেগে আছে । যাকগে সে দিনের কথা । হ্যাঁ রে তুই বিয়ে করলি না কেন রে? কি করে কাটাবি বাকি জীবনটা এই ভূতপুরীতে? ভেবেছিস কিছু ? ” এবার সহেলী চাদর টেনে মুখটা পুরো ঢেকে ভুতনাথের মুখোমুখি বসে উত্তর করে, “ করেছিলাম তো, জান মাষ্টার, কিন্তু সে মরদ তোমার মতো ভালমানুষ নয় গো । সারাদিন মদ আর মদ । আমায় যে কি হার-জ্বালাতন, নির্যাতন করতো গো সে সারাদিন-সারারাত । কি আর বলব তোমাকে ? আমি তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী । একদিন ঝগড়ার সময় সে হাতে দাঁ তুলে আমায় মারতে এলো, জান ? ” “হ্যাঁ, তারপর?” ভূতনাথ জানতে চায় । “ তারপর আর কি? আমারও রাগ ছিলো ঐ মিনসের ঊপর, আমিও এগিয়ে গেলাম, কি তুমি আমাকে মারবে নাকি ? সে রেগে গিয়ে আমাকে ও ঘরে বিছানায় ফেলে কি মারটাই না মারল । জান, মাষ্টার আমি যখন যন্ত্রনাকাতর অবস্থায় উঠতে যাব বিছানা ছেড়ে, তখন ও ওর হাতের দাঁ টা চালিয়ে দিলো আমার গলায় । আমার আর কিছু মনে নেই গো । আমি এখন শুধু আমার এই পৈতৃক ঘরটা পাহারা দিই । আর তো কিছুই নেই চারিদিকে, সবই তো শ্মশান হয়ে গেছে গো এখানে ।” এবার ভূতনাথ বোধহয় কিছুটা ভয় পেলো এইসব কথা শুনে, আর খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “ তারপর ? কে চিকিৎসা করাল তোর ? আর সেই ব্যাটাই বা কোথায় এখন ? ” সহেলী বলে, “ কি যে বল, চিকিৎসা ? হিঃ হিঃ হিঃ । কিছুই হয় নি । আমি তো মরে গেলাম, সঙ্গে আমার পেটের ভিতরের বাচ্চাটাও । আর ওর কথা বলছো ? ও এখন গারদে । ওর ফাঁসি হলে ওকে নিয়ে আসব এখানে আবার, আর আমরা দুটিতে মিলে পাহাড় দেবো এই ভূতপুরী । ” এবার ভূতনাথের আর বাক্য সরছে না, মুখে শুধু অস্ফুটে বলছে, “ মা-মা-মা—নে ? তুই কি তবে……… ? কি সর্বনাশ । সহেলী, আমায় ছেড়ে দে, আর কখনো এ মুখো হবো না, দয়া কর …….।” সহেলী বলে, “ এমা, তুমি অমন করছো কেন ? জান, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি বলেই তো, বাসস্ট্যান্ড থেকে তোমাকে এখানে নিয়ে আসলাম। আর তুমিও তো বাসস্ট্যান্ডে আমার কথাই ভাবছিলে, তাই না মাষ্টার ? হিঃ হিঃ হিঃ । ভয় করো না, তোমাকে আমি এখানে পাহাড়া দেবো । তুমিও তো আমাকে একসময় বউ করতে চেয়েছিলে, তাই না ? আমার দুর্ভাগ্য পারলাম না তোমার সেবা করতে । তবে মাষ্টার তুমি ঐ ঘরে যেও না, সইতে পারবে না ও দৃশ্য । তুমি তো খুবই দুর্বল মনের লোক, আমি জানি । তাই তো ঢেকেঢুকে বসে আছি আমি । তুমি নিশ্চিন্তে থাক আর একটু সময়, আলো ফুটলে চলে যেও । আমি ও ঘরে যাই । তোমার কোনো ভয় নেই । হিঃ হিঃ হিঃ । ” এই বলে সহেলী পাশের ঘরটায় চলে যায় । ভূতনাথ তার অবশ দেহটাকে আর তুলতে পারছে না বিছানা থেকে, টালির ফাঁক দিয়ে আকাশ ফর্সা হচ্ছে দেখে অনেক কষ্টে নিজেকে বিছানা থেকে তুলে, ভূতনাথ ঔৎসুক্য নিয়ে উঁকি দেয় পাশের ঘরে, আর দেখে একটা কঙ্কাল শুয়ে আছে ভাঙ্গা তক্তোপোষটায়, যার খুলিটা ধর থেকে সম্পূর্ন আলাদা, আর আশেপাশে কালো দলা দলা রক্তপিন্ড শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে । প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় মুখে শুধু “ রাম রাম ” করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দেখে সত্যিই আশেপাশে শুধুই ফাঁকা মাঠ । আর মনে মনে ভাবে, তাহলে কালকের সেই মিষ্টির দোকান ? রসগোল্লা ? আর ঐ দোকানী ?... সবই কি তাহলে ………… ? ভুতনাথ বুঝলো সবটাই এখন । তার প্রেয়সী সহেলীই যে তাকে বাঁচিয়েছে, এ যাত্রা এ কথা মনে রেখে মনকে শক্ত রেখে বাসস্ট্যান্ড খুঁজতে খুঁজতে তার গন্তব্যে চললো ধীরপায়ে । সারাজীবনে ভূতনাথ আর কখনো ভুতেরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয় নামও মুখে আনে নি ।