মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৭৯- ভূত না ভূতুড়ে - অমিত গাঙ্গুলী

গপ্পো টা অনেক দিন আগেকার, সেই আমার ছোট্টবেলার। তখন
আমাদের শহর এতো ঝাঁ চকচকে ছিল না। চারিদিকে প্রচুর গাছপালা,
বেশ ফাঁকা ফাঁকা। আমার বয়স তখন ১৩/১৪ হবে। এদিক সেদিক যাবার
স্বাধীনতাও ছিল বিস্তর। আমরা কজন বন্ধু মিলে সাইকেল
চড়ে শহরের আনাচে কানাচে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম।
তার মধ্যে গঙ্গার ধার টা ছিল বেশ মনোরম। কি সুন্দর গাছ
গাছালি তে মোড়া। গঙ্গায় চান করতে যাবার ঘাট, সেখানে বাঁশের
মাচা করা বসবার জায়গা .... সারা দিন ধরে ফুরফুরে হাওয়া খাবার আদর্শ
জায়গা। চারি দিকে সবুজ আর সবুজ। মাচায় বসে বসে দেখতাম
জেলেরা মাছ ধরছে, মাঝি হাল ধরা নৌকা নিয়ে লোক
পারাপার করছে, মাছরাঙ্গা মাছ ধরছে আর পানকৌড়ি জলে ডুব দিচ্ছে। গঙ্গার
ধারে একটা পুরনো কালী মন্দির আর তার ধারেই শ্মশান। শ্মশান টাও ছিল সুন্দর
গাছগাছালি তে মোড়া। সেই শ্মশানে গাছের ওপর
মাচা করে তার ওপর একটা ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতো এক
গুণিন। সে নাকি মস্ত তান্ত্রিক। আর থাকতো এক ডোম
(যে মরা পোড়ায়) আর এক মরুই পোড়া বামুন (ব্রাহ্মন-
মরা পোড়ানোর আগে যে শেষ ধার্মিক আচার আচরণ পালন করায়)।
ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম একটু বেশি সাহসী।
দুপুর বেলা এর ওর গাছ থেকে পেয়ারাটা জামটা আমটা পেড়ে আনা।
গঙ্গায় চান করতে গিয়ে জলের তলায় দম বন্ধ করে অনেক ক্ষন
বসে থেকে অন্যদের ভয় পাইয়ে দেওয়া বা সাপের গর্ত
থেকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে সাপ বের করে আনার মতো দুঃসাহসিক
কাজ অনায়াসেই করতাম। ঘুরতে ঘুরতে বহুবার
শ্মশানে গিয়ে সেই গুনিনের তন্ত্র সাধনাও দেখতাম। আলাপ
পরিচয় ও হয়ে গেছিল।কতবার লোকের গাছের ফল
দিয়ে এসেছি গুণিন কে। গু্ণিন একাই থাকতো। আমরা গেলে বেশ
আনন্দই পেতো। আমরা কজন বন্ধু মিলে গিয়ে ওনার
থেকে নানা রকমের ভূতের গল্প শুনতাম। বয়স্ক লোক আর তাই কতই
অদ্ভুত ঘটনার কথা বলতে পারতেন।
তিনি আমাদের একবার এক ঘটনার কথা বলেছিলেন ভাবলে আজ ও
শিহরণ জাগে। তিনি নাকি ভূতেদের বশ করতে জানতেন। তার কথায়
নাকি ভূতেরা ওঠা বসা করতো। আমি কিন্তু মনে মনে বেশ
মজা পেতাম, গল্প শুনতে ভালো লাগলেও কোনোদিনই ওনার কথা বিশ্বাস
করতাম না। ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি ?
যাই হোক ওনার সেই গল্পটা এবার সংক্ষেপে বলি।
উনি নাকি পিশাচ সিদ্ধ। তন্ত্র সাধনা করে ওনার শক্তি এতই
বেড়ে গেছিল যে অনায়াসে উনি ভূতেদের ডেকে এনে নিজের কাজ
করাতেন। আমরাও দেখেছি তার আসনের সামনে একটা মড়ার
খুলি থাকতো সিঁদুর মাখানো। এমনকি বেড়ালের মাথার খুলিও
দেখেছি। ভূতেদের দিয়ে তিনি নিজের সেবা করাতেন আবার ওনার খাবারের ব্যবস্থাও
নাকি ভূতেরাই করে দিত। কিন্তু এমনটাই বা আর কতদিন চলে?
ভুতেরাও মনে মনে ভাবত যে আমরা এতো শক্তিশালী হযে একটা সাধারণ
মানুষের সেবা করছি! কিন্তু উপায় কি- গুণিন যে পিশাচ সিদ্ধ। ওনার
তন্ত্র সাধনার কাছে সবাই নতি স্বীকার করতে বাধ্য হত। তা এভাবেই বেশ চলছিল। হঠাৎ
একদিন সুযোগ এসে গেল। সেই গুনিনের আফিমের নেশা ছিল।
রাতের বেলায় আফিম খেয়ে ঝিমিয়ে থাকতো। সেদিন মাত্রা টা বোধহয় একটু বেশি হযে গেছিল। জেগে থাকলেও হুঁশ ছিল না। এই সুযোগেরই সদব্যবহার করেছিল এক
ব্রহ্মদত্তি। ব্রহ্মদত্তি হলো অপঘাতে মারা যাওয়া ব্রাহ্মণ। সেই ব্রহ্মদত্তিটার চোখগুলো যেন
এক একটা জ্বলন্ত আগুনের পিন্ড। বড় বড় গোল গোল টক টকে লাল। যেন সব কিছু জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে। সে সেই গুনিনের পাশে রাখা হ্যারিকেনটা দিল
উল্টে। আর তাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল গুনিনের ঝুপড়ি তে।
সেই আগুনে ওনার মুখের এক অংশ পুড়ে যায়. সেই পুড়ে যাবার দাগ
টা আমরাও দেখেছি। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে গুনিনের গাছের
ওপরের ঝুপড়িতে। সব কিছু নিমেষে ভস্মীভূত হয়। সে যাত্রায়
ভাগ্যক্রমে শ্মশানের ডোমের নজরে এসে যাওয়ায় গুনিন
প্রাণে বেঁচে যায়। এর পর ছিল বদলা নেবার পালা। পরের দিন ই
গুনিন শুরু করে তার কঠোর তন্ত্র সাধনা আর সেই ব্রহ্মদত্তি কে বশ
করে। সেই ব্রহ্মদত্তি নাকি আজও আটক রযেছে গুনিনের কাছে। এই
অবধি শুনে আমি আর থাকতে না পেরে ফিক
করে হেসে ফেল্লাম। তাই দেখে গুনিন গেল বেজায় চটে।
বলল “আমার কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? যদি সাহস থাকে তাহলে আজ রাত
বারোটার পর আয়, আমি তোকে দেখাবো আমার কয়েদি কে”।
সবাই তো গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমি বল্লাম
“ঠিক আছে আসবো”। মিথ্যে বলব না, মনে মনে একটু ভয় ও পেলাম। সাহসী হলেও
অতো রাতে শ্মশানে যাব এতটা সাহসও ছিল না। বাড়ি ফেরার পথে বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল ... “তুই কি সত্যিই আসবি নাকি রাতে?” আমি বল্লাম “হ্যা, নিশ্চয়ই, ভুত
দেখার সুযোগ কি কেউ ছাড়ে?” অনেক কিন্তু কিন্তু করেও
রাতে আর যাওয়া হলো না. অনেক রাতে শুতে চলে গেলাম।
মনে মনে কিন্তু ওই একই চিন্তা। গেলে কি সত্যিই ভুতের
দেখা পেতাম? কেমন দেখতে ব্রহ্মদত্তি? গুণিন
কি সত্যি কথা বলছে? নাকি জানে আমি ভয় পেয়ে গিয়ে যাব না। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি ... আমার
মাথার কাছে গুনিন দাঁড়িয়ে। আমাকে ডাকছে। “কিরে তোর
সাহস শেষ হযে গেল? ভুত দেখতে যাবি না?” আমার হাত
ধরে সে নিয়ে গেল শ্মশানে। গায়ের প্রতিটা রোম
খাড়া হযে গেছে। আমি স্বপ্নেই দেখছি কত ধরনের ভূত গুণিনের
সেবা করছে। তাদের গঠন ধোঁয়ার কুন্ডলির মতো। আকৃতি মানুষের
মতো হলেও তাদের পা নেই। চোখ গুলো যেন আগুনের গোলা আর বেশ
বড় বড়। মানুষের মতো সোজা নয়, একেবারে কপাল অব্দি টানা আর
তারপরেই দেখি গুণিন আমার হাত ধরে শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে গেল এক
গাছের একেবারে মগ ডালে। সেখানে এক কাঠের
তৈরী খাঁচা। তার মধ্যেই আটক এক বিশালকায় ভূত। এটাই
নাকি ব্রহ্মদত্তি। চোখ গুলো সত্যিই জ্বলছে। টক টকে লাল।
ধারের দুটো দাঁত বেশ বড়।আমার দিকে স্থির
দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে।মনে হল যেন অজ্ঞান হযে যাব। বুকটা ধড়াস
ধড়াস করছে। হঠাৎ ই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। হার্ট -বিট
মনে হয় ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। ঘেমে চান করে গেছি। চোখ
খুলতেই সারা শরীর ঠান্ডা হযে গেল।
স্বচক্ষে দেখছি সেই লাল চোখ। আমাকে গিলে খেতে আসছে।
কোনো কথা বলতে পারছি না। গলার স্বর আটকে গেছে। সেই
ব্রহ্মদত্তি কি তাহলে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
আমার ঘরে সে কি করে এল? গুনিন তন্ত্র সাধনার
দ্বারা তাকে নিশ্চয়ই আমার কাছে পাঠিয়েছে। উঠে দাঁড়াতে গেলাম কিন্তু
পারলাম না। লাল চোখের দিকে তাকিয়ে অচেতন হযে যাবার উপক্রম। কিছুক্ষণের
মধ্যে যেই চেতনা ফিরল অবাক হযে গেলাম। আরে !!!!!!!!!! এটা ব্রহ্মদত্তির চোখ কোথায়? এ তো আমাদের বাড়ির সুইচবোর্ডের লাল আলোর ইন্ডিকেটারটা।
মনে মনে নিজের ওপরেই হাসি পেল। কিন্তু হাসতে পারলাম না। সত্তিই কি ভূত বলে কিছু আছে নাকি? সবটাই তো কেমন ভূতুড়ে।