মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৫- নৈশকোচ

লিখাঃ Kishor Pasha Imon

____________________এক ____________________
‘আমি একজন সিরিয়াল রেপিস্ট ।’, শান্তভাবে বলল মানুষটা, ‘শুধুমাত্র আনন্দ পাওয়ার জন্য কাজটা করি আমি ।’
‘আচ্ছা ?’, হাল্কা কৌতুক ফুটে ওঠে নাবিলের চোখে, ‘আপনার কথাই তাহলে বলাবলি করছিল ওরা ? দ্য বীস্ট ?’

হাত উল্টে অপরপাশটা দেখে সহযাত্রী । তারপর থমথমে মুখ এপাশ-ওপাশ দোলায়, ‘না । দ্য বীস্টের কাজের ধরণ আমার থেকে আলাদা । ও মেয়েদের পেট চিরে দেয় না । তাই না ?’
একমত হয় নাবিল, ‘তা দেয় না । আপনি দেন নাকি ?’
কিছু না বলে বাইরের দিকে তাকান সহযাত্রী ।

অন্ধকার হয়ে গেছে বাসের ভেতরটা । পাহাড়ঘেঁষা ছোট্ট শহর থেকে এই একটা বাসই পাওয়া যায় রীহাতুনিতে যাওয়ার জন্য । রীহাতুনি বান্দরবানের কাছেই এক মফস্বল । ইদানিং লোক ছুটছে ওদিকে । গ্রাম-গ্রাম একটা ভাব থেকে স্থানীয়রা যখন নিজেদের একটু গুছিয়ে গোটা দুয়েক হোটেল খুলে ফেলল, জায়গাটা রীতিমত পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠে! অনেকে তো ওখানে থাকার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন । মাত্র সাড়ে ছয় বছরের মাঝে রীতিমত শহর-শহর একটা ভাব চলে এসেছে ওখানে । বাইরের লোকের ভূমিকা আছে মানতে হবে, তবুও শুরু করার জন্য কৃতিত্বটা স্থানীয়দের অনেকখানি দিতে হয় ।

নতুন সভ্যতা । কাজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কম । নাবিল ওদিকে রওনা দিয়েছে এই একটা কারণেই । এই মুহূর্তে পুলিশের ঝামেলাতে পড়ার ভাল একটা ভয় আছে ওর । ঝামেলাতে পড়ার মত কাজ করে এসেছে পেছনের ছোট্ট শহরটাতে ।

পাহাড়ি এলাকা । ঝুপ করে রাত নামে এখানে । আজও নেমেছে । তারমাঝে প্রথমবারের মত সহযাত্রীর সাথে আলাপ করতে শুরু করেছিল নাবিল। ও নিজের পরিচয় দেওয়ার পরই ভদ্রলোক মুখ খুলেছিলেন । এই মুহূর্তে একই কারণে তব্দা খেয়ে বসে আছে নাবিল ।

মিনিট তিনেক পর জানালা থেকে মুখ সরালেন সহযাত্রী । তারপর কোনরকম আগাম সংকেত না দিয়ে হাহা করে হেসে উঠলেন তিনি ।

‘বিশ্বাস করে ফেলেছেন দেখছি ।’, হাত বাড়িয়ে দিলেন অমায়িকভাবে, ‘আমি জাহিদ হাসান । টেলিভিশনে প্র্যাক্টিক্যাল জোকসের ওপর একটা রিয়েলিটি শো আছে আমার ।’
হাতটা ধরে ঝাঁকি দেয় নাবিল, ‘মনে পড়েছে । এজন্যই আপনাকে এতটা চেনা চেনা লাগছিল । টেলিভিশন তেমন দেখা হয় না – নাহলে প্রথম্ন দর্শনেই চিনতাম ।’
হাসিট ধরে রাখেন জাহিদ, ‘আপনি টেলিভিশন দেখেন কি না তা অবশ্য বুঝি নি । তবে আমার শো দেখেন না সেটা বুঝেছিলাম । আমাকে দেখে চিনতে পারেননি বলেই একটু মজা করার ইচ্ছে হল । আমার পেশার অংশই এটা অবশ্য ।’
মুচকি হাসে এবার নাবিলও, ‘তবে আমাকে ঘাবড়াতে পারেননি । আমি জানতাম, আপনি “দ্য বীস্ট” নন ।’
‘ধারণা করতে পারেন সেটা । তবে নিশ্চয় নিশ্চিত হতে পারেন নি ।’, চোখ মটকালেন ভদ্রলোক ।
‘আমি নিশ্চিতই ছিলাম ।’, দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেয় নাবিল ।
‘তাই ?’, কৌতুক ফুটে ওঠে ভদ্রলোকের চেহারাতে ,।
‘শতভাগ ।’, মাথা দোলায় নাবিল ।
‘এর একটাই অর্থ – আপনি জানেন কে “দ্য বীস্ট” । অথবা, ’- নাটকীয় একটা বিরতি দেন ভদ্রলোক, ‘- আপনি নিজেই একজন সিরিয়াল রেপিস্ট ।’

নাবিল ভাল করে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়, সেখানে এই মুহূর্তে ঠাট্টার কোন চিহ্নই নেই । সামনের সীটের ঠিক ডানপাশের সারিতে বসে আছে যে তরুণী – তাকে অন্ধকারে ঠিকমত দেখা যায় না । তবে তার কান যে এখানে পুরোপুরি আটকে আছে তা বুঝতে পারে নাবিল অনায়াসে ।
রেপিস্টের ব্যপারে কথা হলে নারীশ্রোতার অভাব হওয়ার কথা না । বাসের মাঝে রেপিস্ট নিয়ে ঘুরতে ভাল লাগার কথা না তাদের ।

এবার নাবিলের পালা, সবগুলো দাঁত বের করে হাসি দেয় ও, ‘আরেকদফা নাটক করার চেষ্টা করছেন অহেতুক । আপনার অভিনয় দক্ষতা বাড়াতে হবে, মি. জাহিদ ।’
মুচকি হাসলেন জাহিদ, ‘হুঁ । উত্তরটা সহজ, রেপিস্ট কখনও নিজেকে রেপিস্ট বলে পরিচয় দেয় না ।’
হাসি থামিয়ে দেয় নাবিল হঠাৎই, ‘একই সমীকরণ আপনাকে রেপিস্ট সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ কি দেয় না ? নিজেকে আগেই ঘোষণা করেছেন রেপিস্ট বলে । স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নেবে আপনি প্র্যাকটিক্যাল জোকস ছাড়ছেন । এটা ধরে নেওয়ার পেছনে কারণও আছে যথেষ্ট, আপনার টিভি শো-ই প্র্যাকটিক্যাল জোকস নিয়ে ।’
একটু হেসে প্রশ্নটা করেন জাহিদ, ‘এতে আমার লাভ?’
‘একটা প্র্যাকটিক্যাল জোকস ফাঁস করে দিয়ে আরেকটা জোকসের অবতারণা করতে পারছেন । নিজেকে সিরিয়াল রেপিস্ট বলে কনফেস করার পরও সবার সাথে হেসে খেলেই যাচ্ছেন । কয়জন অপরাধী নিজের পরিচয় দেওয়ার মত বুকের পাটা রাখে ?’

মুখ শুকিয়ে গেল জাহিদ সাহেবের । সামনের সীটে বসে থাকা তরুণী মুখ হাল্কা ঘুরিয়ে ওদের একবার দেখে । নাবিল খেয়াল করল, এই অন্ধকারেও মেয়েটার ফুলের মত সুন্দর মুখটা জ্বল জ্বল করছে । আবছা, তবে স্পষ্ট ।

‘আপনি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন ।’, আমতা আমতা করে বলেন জাহিদ সাহেব ।

চাপা গলাতে হেসে ওঠে নাবিল, ‘ধরা খেয়ে গেলেন আপনি নিজেই । দ্যাট ওয়াজ মাই জোক ।’
ভদ্রলোক সামান্য ‘হেহে’ করলেন শুধু, এধরণের মজা করার ইচ্ছে সম্পূর্ণ উবে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
‘বাসে এখন সিরিয়াল রেপিস্ট থাকলেও কিছু এসে যায় না । অন্তত সেফটির কথা ভাবলে-’, নিজেকেই শোনালেন যেন ভদ্রলোক, ‘-গন্তব্য পর্যন্ত কোন হোটেল নেই । আসলেই কিছুই নেই । পাহাড়ি খাদ ছাড়া । কাজেই, বাস থামছে না । রেপিস্টও কারও ক্ষতি করতে পারছে না ।’
মাথা দোলায় নাবিল, ‘বুঝতে পারছেন না ? সিরিয়াল রেপিস্ট কেটে পড়তে পারেই এই বাসে । শহরে পুলিশের তৎপরতা ভয়ানক বেড়েছিল । পুলিশের হয়ে কাজ করছে অনেক কলেজ পড়ুয়া তরুণী । ওরা টোপ হয়ে স্বল্প পোশাকে রাতে ঘুরছে এখন । সিরিয়াল রেপিস্ট জানে এ শহর তাকে ছাড়তে হবে । অথবা থাকলে, থাকতে হবে রেপ করার অভ্যাসটা বাদ দিয়ে ।’

‘কিন্তু একজন সাইকো ক্রিমিনাল তার অভ্যাস ছাড়তে পারে না ।’, আস্তে করে বলেন জাহিদ ।
‘না । কাজেই, সে চাইবে শহরটা পাল্টে ফেলতে । পুলিশবাহিনীর মাথাতে এই সম্ভাবনাটা আসে নি । তাদের ধারণা, ও শহরেই আক্রমণ করে যাবে তাদের অপরাধী ।’
‘এই ফাঁকে -’, হিসেব মেলালেন জাহিদ, ‘রেপিস্ট ভেগে যাচ্ছে রীহাতুনিতে ?’
মাথা দোলায় নাবিল, ‘হয়ত সে এ বাসে নেই । কিন্তু রেপিস্ট ব্যাটা ভাগবে সেটা নিশ্চিত । পুলিশ বাহিনীর একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল । তবে আপনি ঠিক বলেন নি । বাসের সবাই আসলে নিরাপদ থাকবে না, যদি রেপিস্ট মানুষটা যাত্রীর সীটে বসে থাকে।’
বাইরের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব, ‘পথ দুর্গম । সেটা ঠিক আছে । তবে যেমনটা বলেছিলাম, দুই স্টপেজের মাঝে থামার মত কোন জায়গা নেই । রেপিস্ট নিশ্চয় চলন্ত বাসের যাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না ? এটা ইন্ডিয়া নয় ।’
থমথমে মুখে নাবিলও বাইরের দিকে তাকায়, ‘দুই স্টপেজের মাঝে কোন কিছু নেই – কথাটা সত্য । একটা দিক আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন ।’
‘কোন দিক ?’
‘রেপিস্ট লোকটা শুধু রেপিস্ট নয়, খুনীও । চারজনকে খুন করেছে সে এই পর্যন্ত । মেয়েগুলো বাদে ।’
‘সাইকো রেপিস্টরা রেপের পর ভিক্টিমকে মেরে ফেলে । এটা তো স্বাভাবিক । আলাদা করে কেউ বলে না ।’, নিজের কথাতে অটল থাকলেন ভদ্রলোক, ‘একজন খুনীও বাস ভর্তি মানুষের ওপর ঝাঁপাবে না ।’
মাথা নাড়ে নাবিল, ‘তা ঝাঁপাবে না । কিন্তু বাই চান্স বাসটা যদি মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায় ? এই রুটে আর কোন গাড়ি কি চলে, মি. জাহিদ ?’

শুকিয়ে যায় জাহিদের মুখ আরেকটু । দুই পাশে হাল্কা মাথা নাড়লেন তিনি, ‘না । একটাই বাস এ রুটে । শীতকালে প্রাইভেট কার দেখার সম্ভাবনাও দেখছি না ।’
‘বুঝতেই পারছেন, এখানে বাসের ইঞ্জিন নষ্ট হলে -’

নাবিলের মুখের কথা মুখেই থাকে ।
বার দুয়েক বিশ্রী কাশি দিয়ে থেমে গেল বাসটা ।

মুহূর্তের জন্য বাসের মাঝে নীরবতা নেমে আসে । ড্রাইভারকে নোংরাতম গালির বালতি উল্টে ফেলতে শোনে নাবিল । সতর্ক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকায় ও তার মাঝে ।
কালো রাত । পথের একপাশে খাদ নেমে গেছে সম্ভবতঃ পাতাল পর্যন্ত । লোহার ছোট রেলিং দেওয়া আছে সেখানে ।
আরেকপাশে পাহাড়ের এবড়ো-থেবড়ো বুক । সেমি-সমতল ।

‘সম্বুন্ধীর পুত ইঞ্জিনে বিগড়াইবার আর জায়গা পাইলো না !’, দরজার কাছ থেকে কুচকুচে কালো সুপারভাইজার ঘোষণা করল সখেদে ।

____________________দুই ____________________
চার সীট সামনের হুজুরকে দেখা যাচ্ছে তসবীহ বের করতে । দোয়ায়ে ইউনুস পড়বেন মনে হচ্ছে । কাঁথা-কম্বলের পজিশন দেখে বোঝা গেল, হাজারবারের কম না পড়ে শয্যা নেবেন না ইনি ।

কৌনিক দূরত্বে এক সীট সামনে বসে থাকা তরুনীকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । বাস থেমে যাওয়ার পর পরই ভেতরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে । আগে বন্ধ রাখা হয়েছিল যাত্রীদের ঘুমাবার সুবিধে করে দেওয়ার জন্য । এখন আর কারও সুবিধে অসুবিধের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে না ।

বাসে যাত্রীর পরিমাণ খুব বেশি নয় । হুজুরের পরিবার, তরুণী আর অদ্ভুত মানুষ জাহিদ হাসানকে বাদ দিলে আরেকটি পরিবার আছে বাসে, দুটো ফুটফুটে সন্তান তাদের । স্ত্রীটির বয়েস বেশি না । চব্বিশ হবে বড়জোর । স্বামীটির বয়স বোঝার উপায় নেই, তবে খুব বেশি হবে না স্ত্রীর থেকে । তাদের পেছনের সারিতেই বসেছে এক ষণ্ডা ।

শীতের রাতে বেশি মানুষ নেই ভ্রমণের মত । কাজেই মাত্র দশজনকে নিয়েই ছাড়তে হয়েছে বাস । আড়চোখে একবার ষণ্ডার দিকে তাকায় নাবিল । মুখচোখ ভয়ংকর হয়ে আছে মানুষটার । বাস নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তার মধ্যে কোনরকম উদ্বেগ কাজ করছে না সেটা নিশ্চিত । ভয়ংকর মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে শুধু ।

চোখে চোখ পড়তে নাবিল সরিয়ে নেয় চোখ । জাহিদ হাসান নিচের দিকে ছুটেছেন বাস থামার সাথে সাথেই ।
সম্ভবতঃ ‘বিড়িরোগ’ । তাকে অনুসরণ করতে নিজের সীট থেকে ওজনদার পশ্চাদ্দেশটা উঠিয়ে ফেলে নাবিল ।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তরুণীর চোখেও চোখ পড়ল । কালো মনিতে কি যেন একটা দেখে নাবিল, খুব সম্ভব দ্বিধা ।

বাসের সামনের চাকার ফাঁক দিয়ে লম্বা পা নিয়ে ঢুকে পড়েছে সুপারভাইজারের । পেছন থেকে সমানে তাল দিচ্ছে ড্রাইভার । সেই সাথে রেঞ্চ-টেঞ্চ যা লাগে বের করে পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে সুপারভাইজারের লিকলিকে হাতের দিকে ।
জাহিদ হাসান প্রাণপণে সিগারেট টানছিলেন, শান্তভঙ্গিতে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নাবিল । জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে বের করে বেনসনের প্যাকেটটা ।

‘অদ্ভুত না ?’, গল গল করে একদিকে ধোঁয়া বের করে দিতে দিতে বললেন তিনি, ‘আপনি বলতে না বলতেই গাড়িটা বিকল হয়ে গেল ।’
‘ভাবছেন, এতেও আমার হাত আছে ?’, কাঁধ ঝাঁকায় নাবিল ।
কিছু না বলে আরেকবার সুপারভাইজারের লিকলিকে পায়ের দিকে তাকান জাহিদ । কিন্তু বাসের ড্রাইভার এগিয়ে এসেছে ওদের দিকে ।

‘খবর কি, ড্রাইভার সাহেব ?’, জানতে চান জাহিদ সাহেব, ‘বাস ছাড়তে পারবেন আবার কখন ?’
দুইপাশে ঘন ঘন মাথা নাড়ল ড্রাইভার, ‘এই গাড়ি আঁ নড়ত না ।’
‘মানে কি ? আমরা এখানেই আটকে থাকব নাকি ?’
একটু ভাবে ড্রাইভার, ‘সাত মাইল দূরে এক মেকানিক স্যারের বাসা আছে হুনছিলাম । উনার কাছে বাবলুরে পাঠায়া দেখি, কোন গতি হয় কি না ।’

খসখস শব্দ করে বাসের সিঁড়ি থেকে নেমে আসছে তরুণী, সেদিকে তাকিয়ে নাবিলের প্রথমবারের মত প্রশ্নটা মাথাতে আসে । মেয়েরা রাতের বেলাতে সাধারণতঃ বের হয় না । হলেও একা বের হয় না তারা । সুন্দরী হলে তো আরও না ।
অথচ, এই মেয়ে বের হয়েছে । অদ্ভুত !

‘বাস কি আর যাবে না ?’, রিনরিনে কণ্ঠে জানতে চায় মেয়েটি ।
ড্রাইভারের হয়ে নাবিলই উত্তর দেয়, ‘না । ইঞ্জিন নষ্ট ।’
‘এখন রীহাতুনি পৌঁছাব কি করে ?’, আঁতকে ওঠে তরুণী ।
ড্রাইভার মাথা চুলকাচ্ছে, ‘বিহানে ‘গোরুর’ গাড়ি যায় । উই দিকে কিছু গ্রাম আছে । শাকপাতা ব্যাচে এই দিককার এক বাজারে । একটা ‘গোরুর’ গাড়ি ধইরা যাইতে পারবেন ।’
মেয়েটার মুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয় গেল ।
গোলাপী গাল দুটো শীতে হাল্কা লালচে হয়ে আছে । ত্বক আর্দ্রতা সহ্য করতে পারেনা খুব সম্ভব । কালো চুলগুলো রেশমী, কাঁধের ওপর হেলে আছে নিজেদের মনমত । রাতের অন্ধকারে মেয়েটাকে কেন জানি মানালো না ।

জাহিদ হাসান এক পা এগিয়ে গেলেন তার দিকে, ‘আমি জাহিদ হাসান । উনি নাবিল মুহতাশিম ।’
ছোট্ট কাশে মেয়েটা, ‘আমি অনীলা ।’
নাবিল জানতে চায়, ‘রীহাতুনিতে প্রথমবারের মত যাচ্ছেন ?’
মাথা নাড়ে অনীলা, ‘আসলে, আমার অরিজিনই ওই জায়গা ।’
প্রশ্নবোধক দু’জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে দ্রুত জানায় ও, ‘আমার দাদাবাড়ি সেখানে ।’

বাবলু নামক সুপারভাইজারটিকে দেখা যাচ্ছে লিকলিকে শরীর নিয়ে প্রায় দৌড়ে সামনের দিকে চলে যেতে । ড্রাইভার তাকে মেকানিকের বাড়ি পাঠাচ্ছে । তারপর আবার সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল বাসের ভেতরে । বাইরের ঠাণ্ডাতে কেঁপে মরার ইচ্ছে তার নেই ।

‘আপনারা ? প্লেজার ট্রিপ ?’, বুকের কাছে হাত বেঁধে জানতে চায় অনীলা ।
‘হুঁ ।’, সাথে সাথে ঘোষণা করে দিলেন জাহিদ ।
‘হুম ।’, এক সেকেন্ড পর বলল নাবিলও ।
চোখ মটকায় অনীলা, ‘অর্থাৎ, ভ্রমণের উদ্দেশ্য জানানোর ইচ্ছে আপনাদের কারও নেই । তা বেশ, আমি কাস্টম এজেন্টও না । আমি ভেতরে চললাম ।’

একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা । মেয়েটা ওদের রেপিস্ট নিয়ে কথা বার্তা শুনেছে আগেই । সম্ভবতঃ তার মনে ঢুকে গেছে ব্যাপারটা, এদের মাঝে কেউ হতে পারে পেছনে ফেলে আসা শহরটার সিরিয়াল রেপিস্ট । স্থানীয় রেডিও চ্যানেলগুলোতে এই রেপিস্টকে বলা হচ্ছে “দ্য বীস্ট” । খবরের কাগজগুলোও বাদ দিচ্ছে না একে সে নামে ডাকতে ।

ঢাকা থেকে গোয়েন্দা পর্যন্ত এসে গেছে রেপিস্টকে পাকড়াতে । তিন মাসে উনিশটা মেয়েকে ধর্ষণ করার পর খুন করেছে এই লোক । খুনগুলো করেছে খুবই নৃশংসভাবে । মুখে বালিশ চেপে দম বন্ধ করে দিয়েছে তাদের, একই সাথে দানবিক একেকটি লাথি মেরে থেঁতলে দিয়েছে শিকারের জননাঙ্গ ।

নিখুঁতভাবে ধর্ষণের জন্য এই ধর্ষকের নাম গিনেস বুকে ওঠা উচিত । প্রথমতঃ অতি সতর্ক খুনী এক ফোঁটা সূত্রও ফেলে যায়নি পেছনে । অতিমাত্রায় প্রটেক্টিভ প্রসিডিউর মেনে একেকটি ধর্ষণ করারর কারণেই পুলিশের হাতে কোন এভিডেন্সও নেই । দ্বিতীয়তঃ আজ পর্যন্ত তার কোনরকম বর্ণনা কেউ দিতে পারেনি । শুধু এটুকুই ধারণা করা যায়, রেপিস্ট শারীরিকভাবে অসামান্য শক্তির অধিকারী ।

এসব জানা তথ্যের সাথে দুইজন সম্ভাব্য ধর্ষকের সাথে অনীলা দাঁড়াবে – এটাই একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য হত, ভাবে নাবিল । মেয়েটার কাপড়ের কোণাটুকুও বাসের মাঝে হারিয়ে যেতে নড়ে ওঠে ওরা । একে অন্যের দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না, সিগারেট শেষ করার চেয়ে জরুরী একটা কাজ যেন দেখা দিয়েছে আচমকাই ।
বাসে ওঠা ।

বাইরে এখন কেউ নেই । দিগন্তে মিলিয়ে গেছে বাবুল সুপারভাইজার, যেদিকে তাকানো যায়, শুধু কুয়াশাঢাকা কালো রাত । থেকে থেকে একটা প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে । ঝিঁঝিঁর শব্দ আসছে খাদের অপর পাশ থেকে । ওদিকে জংলামত হয়ে আছে সবকিছু । অশুভ একটা এলাকা মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জায়গাটাকে ।
আরেকটা অনুভূতি – আড়াল থেকে কেউ একজন যেন দেখছে ওদের ।

ঝড়ের বেগে গাড়িতে উঠে আসতেই ড্রাইভারের মুখ প্রসন্ন হয়ে ওঠে । যেন এ অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষণ সে ।
হুজুরের বিবির মুখ বোরখাসহ কুঁচকে উঠল সাথে সাথেই । পরপুরুষের সাথে মনের ভাব প্রকাশে ইনি ব্যবহার করলেন তাঁর স্বামীকে ।

‘সিগারেট চুষা অপচয় ।’, ফট করে জানা জিনিসটা জানিয়ে দিলেন তিনি, ‘আর অপচয়কারী শয়তানের ভাই ।’
‘শয়তান ঠাপালাম না ।’, উদাস ভঙ্গিতে জানালেন জাহিদ সাহেবও, ‘আমি দরজাতেই খেয়ে শেষ করে ঢুকব, ভাববেন না।’

নাবিল এরই মাঝে হাল্কা চমকে না উঠে পারে নি ।
ওদের পেছনের সীটের সুখী দম্পতি ঠিকমতই বসে আছে । তবে তাদের পরে ষণ্ডামার্কা লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না ।
বাসের ভেতর কোথাও একটু আগে ঢুকে পড়া অনীলাকেও চোখে পড়ে না ওদের !

____________________তিন____________________
‘মি. জাহিদ !’, চাপা গলাতে ডাকে নাবিল ।
‘দেখেছি ।’, বিড় বিড় করে বললেন জাহিদ হাসানও ।

সাবধানে এগিয়ে আসে নাবিল সামনের দিকে । প্রতিটা সীট সতর্কতার সাথে পার হচ্ছে, মাথার মাঝে একটা অংশ বলছে – পেছনের দিকে গেলে সহ্যের অতীত কিছু দেখতে হবে ওদের ।
রেপিস্ট মানুষটা শহর পাল্টে ফেলে আবারও তার নৃশংসতা চালিয়ে যাবে – এটা নাবিলের নিজস্ব থিওরি । তবে এটাতে বিশ্বাস করে ও । এই মুহূর্তে ফেলে আসা শহরটাতে পুলিশী তৎপরতা কেমন বেড়েছে তা নাবিলের জানা আছে । একই কারণে পালাতে হয়েছে তাকেও । পুলিশের চোখে পড়া চলবে না ।
কিন্তু রেপিস্ট ব্যাটা এই বাসেই উঠবে কেন ?

দম্পতির স্বামীপ্রবরকে দেখা গেল মাত্র ঘুম থেকে উঠতে । আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই দুইজন মানুষকে চোরের মত সীটের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে প্রশ্নটা না করে পারলেন না তিনি, ‘কি হয়েছে ? গাড়ি থেমে কেন ?’
ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলে নাবিল ।

সবকিছু উল্টোভাবে চলছে । গতকাল থেকেই ।
ঝামেলাটার শুরু হয়েছে তৃণা নামের মেয়েটার জন্য । মেয়ে না বলে তাকে কি কিশোরী বলা চলে ?
চলে ।

মেয়ের বাবা হিসেবে শরফুল ইনসান বাড়াবাড়ি করে ফেললেন । পার্কের মাঝে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন নাবিলকে । তারপর অতর্কিত আক্রমণ করে একেবারে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিলেন । তারপর নাবিলের পেটে একের পর এক লাথি হাঁকিয়ে -
এলাকাতে লোকজন তেমন ছিল না । সকালবেলার পার্ক । জগিং করতে আসা লোকজন ছাড়া আর কেউ ছিল না । কাপলদের অভাবে চিপাচুপি ছিল ফকফকা । তার মাঝে কি মনে করে শরফুল সাহেব যে ওইদিকে জগিং করতে এসেছিলেন – কে জানে ?

মেয়েটা পটে এসেছিল প্রায়, আর ক’টা দিন পার করতে পারলেই বিধিনিষেধকে থোরাই কেয়ার করে হোটেলে চলে আসত নাবিলের সাথে । ঠিক এরকম একটা অবস্থানে সব ঘুঁটি, তখন শরফুল সাহেবের সবকিছু বাগড়া দেওয়ার দরকারটা কি ছিল ? যদিও এলাকাটা ছিল জনশুন্য, লোকে বলে, নাবিলের আত্মসম্মানবোধটা একটু বেশিই প্রখর । বয়স্ক একজন লোক তার পেটে লাথি মারবে তা বেশ অহং-এ লাগার মতই বিষয় ।

‘কিছু পেলেন ?’, পেছন থেকে ফিস ফিস করে জানতে চান জাহিদ হাসান ।
‘না ।’, একইভাবে উত্তর দেয় নাবিল, শেষের দুই সারি দেখে নিয়েছে এই মাত্র । বাসের মাঝে নেই অনীলা অথবা ষণ্ডা ।
‘কিভাবে সম্ভব ?’, স্রেফ হা হয়ে যান জাহিদ ।

দ্রুত ফিরে আসে নাবিল ড্রাইভারের কাছে, ‘বাসে কোন সিক্রেট চেম্বার আছে ?’
‘আপনার মাথাত সমইস্যা নাকি ?’, সোজাসুজি জানতে চায় ড্রাইভার ।
‘জবাব দিন । ফলস বটম, ব্যাকডোর, ওপেন-হ্যাচ, ভেন্টিলেটর – যে কোন ভাবে বাস থেকে নেমে পড়া সম্ভব ?’
‘নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না । মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে কারও ফোনে ?’, চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন ফ্যামিলির স্বামীপ্রবর । স্ত্রীটির ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন তিনি এই ফাঁকে ।

সাবধানে মোবাইল বের করে দেখে জাহিদ, নেটওয়ার্ক ডেড তারও ।
বিড় বিড় করে শুধু, ‘বালামার !’

‘এইটা তো স্যার, ’ জবাব দিল ড্রাইভার, ‘হিন্দী মুভি না । আমার বাসে ওসব কিছু নাইগা ।’
‘ফাক !’, সিঁড়িতে লাথি মারে নাবিল ।
‘দুই দুইটা মানুষ কি করে উধাও হয়ে যায় তাহলে ?’, জাহিদ এগিয়ে যায় নাবিলের দিকে ।
‘উধাও ?’, আঁতকে ওঠেন হুজুর আর ড্রাইভার একসাথে ।

জবাব দেয় না নাবিল তাদের, ‘বাইরেটা খুঁজে দেখা দরকার ।’
‘আমি একমত ।’, হাল্কা মাথা দোলান জাহিদ, ‘চলুন ।’
‘আমিও আসি আপনাদের সাথে ?’, ঝটপট উঠে দাঁড়ান হুজুর।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় ওরা, নাবিলই বলে, ‘আসবেন ? বিপদ হতে পারে ।’
হুজুর সামান্য নড়ে উঠলেন এবার, সীট থেকে বের হচ্ছেন, ‘আল্লাহ ভরসা ।’
দুই বাচ্চার বাপের আঁতে লাগল মনে হয়, তাঁকেও উঠে দাঁড়াতে দেখা যায়, ‘আমিও আসব ?’

পকেটে হাত পুরে ঘুরে দাঁড়ায় নাবিল, ‘মার্চপাস্টে যাচ্ছি না আমরা । যাচ্ছি সম্ভাব্য একজন রেপিস্টের হাত থেকে সম্ভাব্য একজন ভিক্টিমকে বাঁচাতে । ওকে ? আপনি এখানে মেয়েদের সাথে থাকুন । ওদের নিরাপত্তার দিকটা আপনি দেখবেন ।’
নিরাপত্তার কথা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল ভদ্রলোকের ।

তিনজন মিলে বের হয়ে আসে ওরা বাইরে । চারপাশে তাকায় নাবিল, ‘একদিকে খাদ । কয়েকশ ফিট নিচে চলে গেছে ওটা । এদিক দিয়ে কেউ যেতে পারবে না । অন্য দিকটা খুঁজে দেখতে হবে ।’
হুজুর উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ছেন, দেখে হা-হা করে উঠলেন জাহিদ সাহেব, ‘করছেন কি ? করছেন কি ?’
কিছুক্ষণ উবু হয়ে থেকে আবার উঠে দাঁড়ালেন হুজুর, গা থেকে ধুলোবালি ঝাড়ছেন, ‘গাড়ির নিচটা দেখলাম আর কি ।’
‘গুড থিংকিং ।’, প্রশংসা করে নাবিল, ‘রাস্তার ওপাশে চলেন । তিনজন ছড়িয়ে যাব আমরা, ওকে ? তাহলে বড় একটা অংশ দেখা হয়ে যাবে একবারেই ।’
‘ফাইন । রাস্তা ধরে দুইদিকে যাবেন তাহলে দুইজন । একজন সোজা ওইপাশের পাহাড়ি বনে ঢুকে যান ।’

নাকের গোড়া চুলকায় নাবিল, ‘কথা হল, ওই জঙ্গলে ঢুকবে কে ?’
বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসলেন হুজুর, ‘আমি -’
‘থ্যাংকস ।’, চটপট বলে ফেলেন জাহিদ ।
‘-বাম দিকটা দেখে আসি রাস্তার, কি বলেন ভাই ?’, বাক্যটা শেষ করলেন হুজুর শরীফ ।
মুখ কাল হয়ে গেছে বাকি দুইজনের, তার মাঝেই কষ্টে হাসি ফোটায় নাবিল, ‘আমি জঙ্গলে দেখছি । আপনারা ডানে বামে ধরে চলে যান রাস্তা বেয়ে । অনীলাকে খুঁজে পেলে, অথবা কিছু উল্টাপাল্টা দেখলে ফোন দেবেন । নাম্বার রাখেন ।’
‘নেটওয়ার্ক নাই এই এলাকাতে । টাওয়ার আছে একেবারে রীহাতুনিতে ।’, মনে করিয়ে দিলেন জাহিদ ।
‘ফাইন । গলাই ভরসা ।’

একে অন্যের দিকে একবার করে তাকিয়ে তিনজন তিনদিকে রওনা হয়ে গেলেন । হাতে জ্বলন্ত মোবাইল । অন্ধকারের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে একমাত্র অস্ত্র ।

প্রচণ্ড শীত এদিকে। বাসের ভেতর বাতাসের সরাসরি প্রবাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় ছিল । এখানে নেই । অবশ্য জঙ্গলমত জায়গাটাতে কিছু গাছপালা আছে । বাতাসের কাঁপন কমেছে সেজন্য । খোলা রাস্তাতে থাকা জাহিদ আর হুজুরের জন্য খানিকটা অনুকম্পা বোধ করে ও প্রথমবারের মত ।
অবশ্য, অতিরক্ত অন্ধকার এদিকের শীতটা যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে । মোবাইলের আলোতে চারফিটের বেশি দেখা চলে না ।

বড় গাছ খুব বেশি নেই । ছোট ছোট গুল্মের জন্যই জংলা হয়ে আছে জায়গাটা ।
নাবিল নিশ্চিত, এই জায়গাতে দিনের বেলাতে দাঁড়ালে দেখা যাবে খুবই খোলামেলা একটা প্রায়-সমতলভূমি । রাতের অন্ধকারে দৃষ্টিসীমা কমে এসেছে । মনে হচ্ছে আমাজন জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে ও । দৃষ্টিসীমার জন্য পুরো পরিবেশ সম্পর্কেই কি করে একজনের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে – তা ওর জানা আছে ।

ষণ্ডাটা অনীলাকে বাস থেকে সরিয়ে ফেলল কি করে ? প্রশ্নটা ধাক্কা দেয় নাবিলকে ।
ওদের দুইজোড়া চোখের সামনে বাসে উঠেছে অনীলা । ষণ্ডা গায়েব হয়ে যেতেই পারে । পুরুষমানুষ । জানালা থেকে একটা ছোট্ট লাফ দিলেই কাজ হয়ে যাবে ।
কিন্তু অনীলাকে কিভাবে জানালা দিয়ে বের করে নিয়ে গেল এই লোক ?
ড্রাইভার ছিল, সামনের সীটে বসে ছিল দম্পতি । তারা কেউ টের পেল না কেন ?
প্রাপ্তবয়স্কা একটা মেয়েকে টান দিয়ে জানালা থেকে বের করা হয়ত সম্ভব । কিন্তু নিঃশব্দে ? নাবিলের মনে হয় না ।

সিরিয়াল রেপিস্ট “দ্য বীস্ট” কেন আজ পর্যন্ত ধরা পড়েনি, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও ।

ঠিক তখনই দূর থেকে চিৎকারটা কানে আসে ওর ।
নারীকণ্ঠ !
অনীলা !

ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদিকে ছুটছে নাবিল প্রাণপণে । প্রতিসেকেন্ডে বাড়ছে গতি, একটা সময় পাগুলো মাটি ছুঁচ্ছে কি ছুঁচ্ছে না, ছুটে চলেছে ও । প্রায় একটা ছুটন্ত বুলেটের মতই ছোট্ট টিলাটাকে পার করে আসে নাবিল । চিৎকারের স্বর আরও ওপরে উঠেছে ।
পরক্ষণেই খুব কাছেই বেজে ওঠে হুজুরের গলা । উচ্চস্বরে আরবীতে দোয়া পড়ছেন তিনি । এমন অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে কেন ?
সাথে সাথেই বুঝতে পারে নাবিল – দৌড়াতে দৌড়াতে এদিক আসছেন হুজুর, তার ফাঁকেই দোয়া পড়ে যাচ্ছেন তিনি ।

টিলাটা সম্পূর্ণ ঘুরে আসতে অন্ধকারে কারও ধ্বস্তাধস্তির ব্যাপারে টের পাওয়া যায় । হুজুরের চেহারা মোবারক দেখা যায় প্রায় সাথে সাথেই । অন্যপাশ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছেন তিনি । পরমুহূর্তে হাতের মোবাইলের ফ্ল্যাশটা ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দের উৎসের দিকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি ।

আচমকা আলোকিত হল অনীলার শরীরটা ।
গায়ের নীল জামা ছিঁড়ে গেছে । ফ্যাকাসে সাদা ব্রা ছিঁড়ে দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে মাটিতে । টাইট জিন্সটা নামিয়ে এনেছে ষণ্ডা অনেকখানিই । ফর্সা উরু বেরিয়ে পড়েছে মেয়েটার । খোলা বুক ঢাকার চেষ্টা করছে না ও, কারণ, দুই হাতে মাটি খামচে সরে যাওয়ার জন্য যুঝছে ও, সরে যেতে চাইছে ষণ্ডার নাগাল থেকে ।

হুজুর হাউমাউ করে অন্যদিকে চোখ ঘোরাচ্ছিলেন, সেই সাথে ঘুরে যাচ্ছিল আলোটা ।
সিরিয়াল রেপিস্টটাও মেঘের মত গর্জন করে কিছু একটা বলতে চাইছিল ।
তারমাঝেই কোমরের কাছ থেকে পিস্তলটা বের করে আনে নাবিল ।

একবার, দুইবার, তিনবার – এলাকা কেঁপে ওঠে গুলির প্রচণ্ড শব্দে ।
একদিনের মাঝে দ্বিতীয়বারের জন্য ব্যবহার করা হল অস্ত্রটা ।

অনীলার নগ্ন শরীরটা লাল হয়ে যাচ্ছে । ছলকে পড়ছে রক্ত ।
তৃতীয় গুলিটা লেগেছে ষণ্ডার গলাতে ।






____________________চার____________________
পরিবেশ ঠাণ্ডা হয়ে যেতেই নিজের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল মেয়েটা । ব্যস্ত হাতে ছেড়া জামাটা জড়িয়ে নেয় শরীরে ।
কাঁপছে হি হি করে । বিহ্বল ভঙ্গিতে চারপাশে তাকায় অনীলা ।
এক পা এগিয়ে আসে নাবিল । নিজের জ্যাকেটটা খুলে পরিয়ে দেয় মেয়েটাকে ।

হুজুর একটা কথাও বলছেন না ।
বিড়বিড় করছেন নিজের মনে । পেছনে কারও ছুটন্ত পদশব্দ শোনা যায় তখনই । শব্দের উৎসের দিকে ঘুরে যায় নাবিল বিদ্যুৎবেগে । ঝোপঝাড় কাঁপিয়ে দৃশ্যে অবতরণ করলেন জাহিদ হাসান ।

নিজের মোবাইলের ফ্ল্যাশ অ্যাপলিকেশনের সাহায্যে ষণ্ডাশ্রেণির রেপিস্টের দিকে আলো ফেলেই দুই পা পিছিয়ে গেলেন নিজের অজান্তে । এরকম একটা মুহূর্তেও হাসি পেল নাবিলের । প্র্যাকটিক্যাল জোকিংয়ের সখ একেবারেই উবে গেছে ভদ্রলোকের চেহারা থেকে ।

‘গুড গড ! ওহ গড !’, স্রেফ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি এরপরই, ‘এই শালাই রেপিস্ট নাকি ?’
রক্তে ভেজা অনীলা কাঁপা গলাতে এরই মাঝে বলে ফেলে, ‘আমাকে কেউ গাড়ির দিকে নিয়ে যাবেন প্লিজ ? ঠাণ্ডা ... অসম্ভব ঠাণ্ডা ...’
‘ফাক !’, মোবাইলে নেটওয়ার্কের জায়গাটা শুন্য দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ চাপা চিৎকার দেয় নাবিল ।
‘সবাই গাড়ির দিকে চলেন । আল্লাহর ইচ্ছা সব ।’, হুজুর কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন ।

চারপাশে তাকিয়ে দেখে নাবিল । একেকজনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না । তবে কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে প্রত্যেকে বিধ্বস্ত ।
এক হাত বাড়িয়ে দেয় ও অনীলার দিকে । মেয়েটার মাঝে সেটা ধরার কোন লক্ষণ দেখা গেল না । মাটিতে, কুয়াশা ভেজা ঘাসের ওপর বসে আছে এখনও সে । কাঁপুনির পরিমাণ বেড়েছে আগের চেয়েও ।
আরেকটু ঝুঁকে মেয়েটার বাম কনুই ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয় নাবিল । টলে উঠে ওর বুকে পড়ে যায় অনীলা । শক্ত করে ওকে ধরে সোজা করে ও, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ।

ঝিঁঝিঁর ডাক কানে লাগছে না আগের মত । গুলির শব্দে কানে ধাঁধা লেগে গেছে । ছোটখাট শব্দ এখন কানে আসার কথা না । দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক শোনে তাও নাবিল ।
ওর পেছনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পায়ে থপ থপ করে হেঁটে আসে হুজুর আর জাহিদ হাসান ।

‘লোকটা ... এত রক্ত আমি জীবনেও দেখিনি !’, হাল্কা কেঁপে ওঠে অনীলা ।
‘শান্ত হোন । আপনি এখন নিরাপদ । সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ।’, ফিস ফিস করে বলে নাবিল ।

ও জানে, কিছুই ঠিক হবে না । মেয়েটাকে রাতের পর রাত তাড়া করে ফিরবে আজকে রাতের স্মৃতি । আর ওকে তাড়া করবে পুলিশ । এরা সবাই ওর চেহারা দেখে ফেলেছে । পার্কের মাঝে তৃণার বাবার লাশটা পড়ে আছে – সে নিয়ে খুব একটা চিন্তাতে এতক্ষণ ও ছিল না । তৃণাকে নিজের ব্যাপারে সত্য তথ্য খুব কম দিয়েছে ও ।
মেয়েটার সাথে কথা বলে পুলিশ ওর নাগাল কোনদিনও পেত না । ঝামেলা করবে তারা এখন । এতগুলো মানুষের কাছে নিখুঁতভাবে পেয়ে যাবে ওর চেহারার বর্ণনা । পুলিশ এখন জানবে ও গেছে রীহাতুনিতে ।

সমস্যাটার সহজ সমাধান দেখতে পায় ও খুব দ্রুত ।
রীহাতুনিতে পৌঁছে পরের বাসে ফিরে আসতে হবে আবারও শহরে । এ বাসের যাত্রীরা নিশ্চয় সাথে সাথে ফিরে আসবে না । পুলিশের সাথে তারাই ঝামেলা মেটাক, নাবিলের কিছু না ।
রীহাতুনি যেতে হবে আলাদা কোন উপায়ে । এই বাসে করে ওই মফস্বলে পা রাখার অর্থ একটাই – ইচ্ছে করে ফাঁসীর দড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়া । যাওয়ার আগে ডাম্প করতে হবে পিস্তলটা ।
কোনকারণে পথে যদি পুলিশ চেকিংয়ের মুখোমুখিও হতে হয় ওকে, তারা আটকাবে না । বাংলাদেশের পুলিশ এখনও এতটা তৎপর হতে শেখেনি । মালপত্র চেক করে এখনও তারা শতভাগ নিশ্চিত হতে চেষ্টা করে । অনায়াসে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে ওদের সে পথ ।
একটা দিন কতটা বাজে যেতে পারে ! মনে মনে নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দেয় নাবিল ।

‘ওই তো বাস । আলহামদুলিল্লাহ !’, হুজুরের গলা বাস্তবে ফিরিয়ে আনে ওদের ।
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার নিজেই । ওদের দেখে উৎকণ্ঠিত গলাতে জানতে চায়, ‘গুলির শব্দ শুনলাম মনে হল ।’
‘ঠিকই শুনেছেন । এই ভদ্রলোকের কীর্তি ।’, এক আঙুলে নাবিলকে দেখিয়ে দেন জাহিদ ।
‘উনাকে ধন্যবাদ ।’, রিনরিনে কণ্ঠে বলে অনীলা, ‘নাহলে এতক্ষণে পশুটা আমাকে -’
‘ভাববেন না, আপনি নিরাপদ এখন ।’, নিচু গলাতে জানায় নাবিল ।
‘উনার শরীরে রক্ত কেন ?’, আঁতকে ওঠেন দম্পতির স্ত্রীটি । এঁর নাম জানা হয়নি ।
‘পিস্তল পেলেন কোথায় উনি ?’, গমগমে কণ্ঠে যোগ করলেন স্বামীটি ।

ঝট করে তার দিকে তাকিয়েছেন জাহিদ সাহেব । হুজুর সম্ভবতঃ বিস্ময়ের উর্ধ্বে চলে গেছেন । তাঁর শান্ত জীবনে এই প্রথম এমন ঝামেলাতে নেমেছেন খুব সম্ভব ।
স্বাভাবিকভাবে কাঁধ ঝাঁকায় নাবিল, ‘পেশাতে আমি একজন বেসরকারী গোয়েন্দা । ফায়ার আর্মস রাখার লাইসেন্স আছে আমার ।’

পেশিতে ঢিল পড়ে সবার । স্বামীপ্রবর উঠে এসে হাতই বাড়িয়ে দিলেন, ‘সেক্ষেত্রে মানব সভ্যতার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই । মার্ডারের সমর্থন আমি কখনই করব না । কিন্তু ধর্ষক-প্রসঙ্গে আলাদা কথা ।’
হাত মেলায় নাবিল মানুষটার সাথে । উষ্ণ ।

‘পুলিশে খবর দেওয়া দরকার ।’, কাঁপা কণ্ঠে বললেন স্ত্রীটি ।
স্বামীরও টনক নড়ল মনে হয়, বললেন, ‘আপনার লোক তো অনেকক্ষণ হল গেছে । আসে না কেন, ড্রাইভার সাহেব ?’

এখনও দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল । অনীলা ভেতরে উঠে একটা সীটে বসে কাঁপছে থর থর করে ।
‘ড্রাইভার সাহেব’ উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন । পেছনে ফিরে হুজুরকে দেখতে পেল না নাবিল, গেলেন কোনদিকে ?

‘ফির‍্যা আসা তো উচিত । দৌড়ায়া গেল, সাত মাইল রাস্তা যাইতে আইতে দ্যাড় ঘণ্টা ইনাপ ।’, ড্রাইভার বলল ।
‘লাগেজ বক্সের চাবি কি আপনার কাছে ?’, দোরগোড়াতে হুজুরকে দেখা যায় ।
‘না ।’, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় ড্রাইভার, ‘ওইটা তো বাবুলের কাছে রাখছিলাম । নিয়ে গেল নাকি হালার পুতে ?’

নাবিলের চোখ চলে যায় সামনের কুয়াশা ঢাকা রাস্তার দিকে । ড্রাইভারের ‘শালার ছেলে’ বাবুলকে আচমকাই কুয়াশা ভেদ করে বেড়িয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে । একটু নড়ে ওঠে নাবিল, উধাও হয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে । এ ব্যাটা গাড়ি ঠিক করে ফেলার আগেই কেটে পড়তে হবে ।
এতদূর এসে ধরা পড়ার কোন মানে হয় না ।

হুজুর এগিয়ে যাচ্ছেন বাবুলের দিকে । নাবিল আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় । সবার অগোচরে সরে যেতে হবে । এখন ওর দিকে অনেকগুলো চোখ ।
বাবুল যদি বলে সাহায্য আসতে কিছু সময় লাগবে – একটা ফাঁক বের করে নিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারবে ও ।

হুজুর আর বাবুলের মাঝে বেশ খাতির জমে উঠেছে মনে হয় । কথা বলতে বলতে আসছে ওরা ।
বাবুলকে হেসেও উঠতে দেখা গেল । হুজুর কি শুরু করেছেন ?
একটু আগে যা হয়ে গেছে সেটা বলছেন কি ? সম্ভবতঃ না । বরং ঝামেলা এড়াতে তার সাথে সস্তা জোকস শেয়ার করছেন খুব সম্ভব ।

যত বেশি মানুষ ঘটনা জানবে, ফিরে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে সময় ব্যায় করতে হবে তত । সবাইকেই আজ স্টেটমেন্ট দিতে হবে ।
তবে সেখানে নাবিল থাকবে না ।

বাবুল দরজার কাছে চলে এসেছে । মুখভর্তি হাসি ।
‘গাড়ি ঠিক করার কোন ব্যবস্থা হল ?’, নাবিলই প্রশ্নটা করে ওকে ।
‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, স্যার ।’

সময় যেন থমকে গেছে ।
বাবুলের হাসিমুখ আচমকা নিভে যায়, একই সাথে নাবিল কোমরের কাছে হাল্কা অনুভব করে । তারপর, ক্লিক করে হাল্কা শব্দ একটা ।
পরমুহূর্তে নিজের হাতটা হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো দেখতে পায় নাবিল । সরে যাওয়ার আগেই আরেক প্রান্ত একটা রডের সাথে লাগিয়ে দেয় সুপারভাইজার । রডটা সরাসরি বাসের সাথে যুক্ত ।

‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট ফর দ্য মার্ডার অফ শরফুল ইনসান ।’, খনখনে কণ্ঠে জানিয়ে দেয় বাবুল, ‘তৃণা নামের একটা মেয়েকে আশা করি মনে আছে আপনার, মি. নাবিল ? আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে আছে ও । কোর্টে ।’

____________________পাঁচ____________________
‘হোয়াট দ্য -’, অযথাই হাত নাড়ে নাবিল । একচুল নড়াতে পারে না হ্যান্ডকাফের অন্যপ্রান্তটাকে ।

বাসের সবাই থমকে গেছে । অনীলার সুন্দর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেছে সামান্য । নাবিলের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও দুটো ? নাকি ও ভুল দেখল ?

‘আমি শরফুল ইনসান বলে কাওকে চিনি না ।’, গলার রগ ফুলিয়ে বলে নাবিল, ‘ইয়াপ, একটু আগে একজনকে খুন করেছি আমি, তবে সে তখন নিরপরাধ এক মেয়েকে রেপ করতে উদ্যত হয়েছিল – সাক্ষী আছে -’
‘সে তো মি. শরফুল ইনসানকে খুন করার সময়ও ছিল । তৃণাকে মেরে ফেলা উচিত ছিল তোমার, নাবিল ।’, শান্তকণ্ঠে বলল ‘সুপারভাইজার’ ।

পিনপতন নীরবতা নেমে আসে গাড়ির ভেতর ।

‘ও, তৃণা এখন যদি নাও থাকে, আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা না । ব্যালিস্টিক রিপোর্ট কি বলবে না – একই পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল এখানে, আর শরফুল ইনসানের বুকে ?’

কথা খুঁজে পায় না নাবিল ।

‘তৃণা তোমার ব্যাপারে জানাতেই আমার ভুল হয়নি চিনতে তোমাকে, নাবিল । এককালে দুর্ধর্ষ ছাত্রনেতা ছিলে। তোমার সুকীর্তি আমার ঘাড়েই পড়েছিল । ভার্সিটিতে পড়ুয়া অবস্থাতে কয়টি খুন করেছিলে মনে আছে তোমার ?’

গলা শুকিয়ে গেছে নাবিলের, কিছু বলতে পারে না ও ।

‘আটটা । প্রতিটার কেস আমার হাতে ছিল । সন্দেহ ছিল তোমার প্রতি । কিন্তু সরকার দলীয় একজন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে নামার উপায় আমার ছিল না । তখনও কিশোরীদের প্রতি তোমার দুর্বলতা ছিল । মনে আছে ?’

নাবিল এবারও কিছু বলে না ।

‘আমি তোমার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারিনি, ঠিক আছে । কিন্তু স্টাডি চালিয়ে গেছি । পুরো চারটি বছর আমার নখের নিচে ছিলে তুমি । শুধু আমার হাত-পা ছিল বাঁধা । ভার্সিটি লাইফ শেষে আচমকাই হারিয়ে গেলে তুমি । শুধু হারায় নি আমার বিবেক ।

পরের বছর সরকারে পরিবর্তন আসল, তারও তিন বছরের মাথাতে আমি এমপির ছেলের বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ আনলাম । সরকারদলীয় এমপি । ওই যে, স্বভাব – অন্যায় আমি তোমার সময় সহ্য করেছি, বয়েস আমারও কম ছিল । সেবার আর পারিনি ।’

কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যান গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারটি, তারপর আবার শুরু করেন, ‘আমাকে বদলী করে দেওয়া হল । এমপির ছেলে নিখুঁত অ্যালিবাই দেখালো – বলাই বাহুল্য, সব টাকাতে কেনা । আর আমার বদলীটাও হয়ে গেল কারও ইশারাতে । পোড়া এই শহরে চলে এলাম ঢাকাকে বিদায় দিয়ে ।’

একটু কাশে অনীলা । হতচকিত ।

‘কিশোরী তৃণা সময়মত থানাতে আসে । একটা কাজে আমিও ছিলাম ওখানে । তোমার এম. ও. আমার চেনা আছে । সেই সাথে তৃণার বর্ণনা থেকে বুঝে ফেললাম পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হবে আমার ।’, নিঃশ্বাস ছাড়লেন গোয়েন্দা সাবধানে, ‘আগের আটটা খুনের পর কি করেছিলে বল তো ?’

কিছুই বলে না নাবিল ।

‘সেরাতেই বাস ধরে কেটে পড়েছিলে শহর থেকে । কোনবার কোন বাসে করে ভেগেছ, সেটা পর্যন্ত আমি নোটিস করেছিলাম, ছেলে । এবারও তাই করলে । আর ঝটপট হয়ে গেলাম একজন বিশ্বস্ত সুপারভাইজার ।’, ড্রাইভারের দিকে তাকালেন তিনি, ‘মাকসুদুর অসাধারণ অভিনয় করেছে । ও আমাদের বিভাগের লোক নয় কিন্তু । আসলেই এই রুটে ড্রাইভিং করে ও । গাড়িটা জায়গা মত থামিয়েছে সে-ই । জানা ছিল, সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়লেই খোলস থেকে বেড়িয়ে পড়বে তুমি । তোমাকে দিশেহারা হতে সুযোগ করে দিতে শুধু একটু সরে গেছিলাম আমি ।’

বিজয় আনন্দেই হেসে উঠলেন যেন গোয়েন্দাটি । জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে নাবিল ।
তবে বেশিক্ষণ নয়, পরের বাক্যটা বাসের সবাইকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায় একেবারে ।

‘সিরিয়াল রেপিস্ট, দ্য বীস্ট – এই বাসের মাঝেই আছে ।’, গমগমে গলাতে হুংকার ছাড়েন হুজুর, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিস অনীলা, ফর রেপ অ্যান্ড মার্ডার ।’

____________________ছয় ____________________
অনীলাকে কেউ যেন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়েছে – সীট থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও ।

‘আপনি একজন মেয়ের প্রতি মার্ডার চার্জ আনতে পারেন, রেপ চার্জ না । মাথা ঠিক আছে তো আপনার ?’
হুজুর বাসের ভেতর পা রাখলেন সাবধানে, নাবিলের নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ।

‘মে আই প্রেজেন্ট মাইসেলফ ? ডিটেক্টিভ আসাদ রউফ, ঢাকা থেকে আমাদের তিনজনের টীম আপনাদের শহরে অবস্থান করছি গত এক সপ্তাহ ধরে ।’
‘মাই গড !’, মাথাতে হাত দিয়ে বসে পড়লেন জাহিদ হাসান ।
‘উনি ডিটেক্টিভ আয়শা আরেফিন ।’, নিজের ‘স্ত্রী’র দিকে দেখিয়ে দেন ডিটেক্টিভ আসাদ ।

আয়শা আরেফীনের বোরখার নিচ থেকে হাত বেড়িয়ে এসেছে । পিস্তলটা সরাসরি তাকিয়ে আছে অনীলার দিকে ।

‘আমরা ইনভেস্টিগেট করছিলাম আপনাদের শহরের অজ্ঞাত রেপিস্ট “দ্য বীস্ট”কে নিয়ে । আপনি টেলিভিশনের লোক, মি. জাহিদ । এনামেই তো ডাকেন তাকে ?’
মাথা দোলান জাহিদ হাসান ।

‘এই রেপিস্টকে আপনাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ধরতে পারেনি । কারণ, সে কোন সূত্র পেছনে রেখে যায় না । উনিশটি মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছে ও, সামান্য বীর্যের স্যাম্পলও রেখে যায় নি । ব্যাপারটা আমরা ভেবেছিলাম এক্সট্রা প্রোটেক্টিভ মীসারস । ধর্ষক অতি সাবধানী । কিন্তু সত্যটা অন্যখানে । আমাদের সো কলড রেপিস্ট একজন মেয়ে ।’

‘বুলশিট !’, চিৎকার করে ওঠে অনীলা ।

‘রেপিস্ট মেয়েটা আসলেই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল দেখছি !’, হাহাকার করে উঠলেন জাহিদ হাসান, ‘নাবিল ভাইয়ের ধারণা সঠিক ।’
‘শুধু পুলিশগুলোকে যতটা গর্দভ ভেবেছিলাম, তারা ততটা নয় ।’, চোখের আগুন বিন্দুমাত্র কমেনি, হাতকড়া ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে নাবিল ।

‘না, আমরা ততটা নই ।’, থমথমে গলাতে বললেন ডিটেক্টিভ আসাদ, ‘আমাদের ধারণা ছিল রেপিস্ট একজন ছেলে । বাসে ওঠার আগ পর্যন্ত । সত্যি বলতে কি, আমাদের সন্দেহ ছিল, মি. নাবিলের দিকে । তাঁর নারীলোলুপতার কথা ও শহরেও প্রতিষ্ঠিত কি না !’
‘বালামার !’, বিড় বিড় করে বলে নাবিল ।
‘আমরা বাসে উঠে পড়লাম । ফলো করছিলাম মি. নাবিলকে । একই সাথে বাসের সম্ভাব্য শিকার মিস অনীলার দিকে চোখ রাখছিলাম । জানতাম, কেউ শিকার হলে তিনিই হবেন । এমন সুন্দরী বাংলাদেশে সাধারণতঃ দেখা যায় না । যাকগে, যখন বাসটাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ড্রাইভারের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে উঠব, তখন আচমকাই থেমে গেল বাস ।’, সুপারভাইজাররূপী গোয়েন্দার দিকে হাল্কা মাথা দোলালেন তিনি, ‘হ্যাঁ, আমাদেরও ইচ্ছে ছিল মিস অনীলাকে টোপ হিসেবে কিছুক্ষণের জন্য রাখার । ধারণাটা ভুল ছিল এই যাহ ।’

‘আবোল তাবোল বলে পার পাবেন না ।’, গর গর করে ওঠে অনীলা, ‘আমাকে আক্রমণ করেছিল গুণ্ডাটা ।’

‘ওখানেই ভুল করে ফেলেছ তুমি, ডিয়ার অনীলা ।’, মাথা নাড়লেন আসাদ, ‘আমাদের ডাটা অনুযায়ী রেপিস্ট শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্ত সমর্থ । কাজেই, নাহিয়ান ছিল আমাদের মাসল । নাহিয়ান – যাকে তুমি এই মাত্র গুণ্ডা বললে । নাহিয়ান, যাকে খুন করেছে নাবিল । তোমার নাটকে বিভ্রান্ত হয়ে ।’

মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় অনীলার ।

‘মি. নাবিল আর মি. জাহিদ বাস থেকে সিগারেট খেতে নামার কিছুক্ষণ পরই তুমি নেমেছিলে বাস থেকে । মনে পড়ে ?’, বলে চলেছেন আসাদ, ‘আমরা খুশি হয়েছিলাম । টোপ হিসেবে কাজে লাগতে যাচ্ছ তুমি – অন্তত তখনও ওটাই আমাদের ধারণা । তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই জানালা গলে সাবধানে নেমে পড়ে নাহিয়ান । দূরে গিয়ে চোখ রাখে তোমাদের তিনজনের ওপর ।’

অনীলার মুখ নেমে গেছে সামান্য ।

‘ওখান থেকে তুমি ফিরে আসো নিরাপদে, নাহিয়ান আবার জানালা দিয়ে ফিরে আসতে চাইছিল । কিন্তু তোমার চোখে ধরা পড়ে গেল অসঙ্গতিটা । নাহিয়ান তার সীটে নেই । কাজেই, সাবধানে জানালা গলে নেমে পড়লে তুমি । নাহিয়ান দূর থেকে তোমাকে দেখল কাজটা করতে । যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল ওর । আর তুমিও যা বোঝার বুঝে নিলে । আমরা দুই ইডিয়ট তখনও মনে করছি আমাদের পিছের সীটে নিরাপদে আছ তুমি ।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহিদ হাসান একপাশ থেকে । মাথা দুলিয়ে আবার শুরু করলেন ডিটেক্টিভ আসাদ, ‘নাহিয়ান সরে পড়ছিল বাস থেকে দূরে । তবে তুমি পিছু নিলে । বৃত্তাকারে একে অন্যের লেজে পড়ার চেষ্টা করছিলে দুইজনই – তখনই কনসার্নড সিটিজেন মি. নাবিল আর মি. জাহিদ তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল । ভলান্টিয়ার করলাম আমি । থেকে গেল আয়শা, ব্যাকআপ হিসেবে । এর মাঝে মি. নাবিলের পদচারণা তোমার আর নাহিয়ানের কানে গেল । প্রায় সাথে সাথে নাহিয়ানের হাতে ধরা পড়লে তুমি ।’

‘একটা কাজই করার ছিল তখন ওর ।’, মেঝেতে থুতু ফেলল নাবিল, চোখে অবিশ্বাস, ‘নিজেকে ভিক্টিম হিসেবে দেখানো । নাহলে, নিজের সন্দেহজনক আচরণের ব্যাখ্যা দিত কি করে ?’
‘এই মেয়ে দেখছি একেবারে একটা খাড়া খান-’, শুরু করেছিলেন জাহিদ হাসান, থামিয়ে দিলেন আরেকজন ।
‘পুরোটা সময় দূর থেকে আমি তোমাদের দেখে গেছি, পানি কোনদিকে গড়ায় দেখার অপেক্ষাতে ছিলাম । রেপিস্ট কেসের ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথে আর নাক গলাই নি ।’, কৈফিয়ত দিলেন সুপারভাইজাররূপী গোয়েন্দা ।

হাতকড়া পরা লোকটার দিকে তাকালেন আসাদ, ‘ঠিক তাই । নিজের জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে প্যান্ট নামিয়ে লাথি মারল ও নাহিয়ানকে । রিফ্লেক্সের বশে খামচে ধরল ওটা নাহিয়ান । আলো জ্বেলেছিলাম আমি ঠিক সে সময় – দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছিলাম আলোটা । কারণ, যা বোঝার বুঝে ফেলেছি আমি । তবুও শেষ রক্ষা হল না । দ্বিতীয় কিলার নাবিল ফায়ার ওপেন করল ।’

‘স্টপ ইট !’, হিস হিস করে ওঠে অনীলা, ‘আপনাদের লোক ওই নাহিয়ান, সে ধোয়া তুলসীপাতা কিভাবে বুঝলেন ? সিরিয়াল রেপিস্ট হয়ত সে নিজেই ছিল । আপনাদের চোখে এখনও ধুলো লেগে আছে নাকি ? আমি একজন মেয়ে হয়ে আপনার ভিক্টিমদের কি করে -’

‘প্রথম কথা, নাহিয়ান আঠারোটা রেপের সময় আমাদের সাথে ঢাকাতে ছিল ।’, এক আঙুল তোলেন ডিটেক্টিভ আসাদ ।
‘তাতে কি ? সুযোগ বুঝে সে প্রথমবারের মত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি তার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন ? সে জানত, এখানে আমার ওপর হামলা করে আমাকেই রেপিস্ট বানাতে পারবে সে !’
‘এগুলোর কি ব্যাখ্যা দেবে ?’, অনীলার ব্যাগটা বাইরে থেকে এক হাত বাড়িয়ে টেনে তুললেন তিনি, তারপর ছুঁড়ে মারলেন মেয়েটার দিকে, লাগেজ বক্সের চাবি হুজুরের কি দরকার, বোঝা হয়ে যায় নাবিলের, ‘ভেতরে এতসব লেসবিয়ান টয় কেন, মিস অনীলা ? নকল পুরুষাঙ্গের কাজ কি থাকতে পারে একটা মেয়ের ?’, একটু থেমে উত্তরটা দিয়েই দেন তিনি, ‘নিজেকে তৃপ্ত করা । ও হ্যাঁ – আরেক কাজে ব্যবহার করা যায় তো ... ধর্ষণের কাজে !’

আঁধার নেমে আসে অনীলার মুখে । স্পষ্ট বুঝতে পারছে, হেরে গেছে সে ।
হেরে গেছে সে নিয়তির কাছে !

____________________পরিশিষ্ট____________________
বাসটার আগে পিছে ছিল পুলিশের গাড়ি । ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের সাহায্যে এদের ডেকে এনেছেন ডিটেক্টিভ আসাদ ।
স্থানীয় ‘সুপারভাইজার’রূপী গোয়েন্দাটি নিজের নাম বলেন নি । থাকেনও নি বাসে, পুলিশের গাড়িতে নিজের সাসপেক্টকে নিয়ে ফিরে গেছেন পেছনের শহরে । একই সাথে গেছে অনীলাও ।
ডিটেকটিভ আসাদ অবশ্য গাড়ি পাঠিয়ে আবারও বাসে চড়ে বসেছেন ।

এখন বাসটা ছুটছে তাগড়া ঘোড়ার মতই । ডিটেক্টিভ আসাদ আর ডিটেক্টিভ আয়শার গোপন বিয়ের কথা প্রথমবারের মত জানতে পারল জাহিদ তখনই । এঁরা এখন সফল কেসের পর কয়েকদিন বেড়িয়ে আসবেন রীহাতুনি থেকে ।

‘ভালোই দাঁড়ি লাগিয়েছেন যা হোক ।’, মুচকি হেসে বলেন জাহিদ, ‘আমিও ভেবেছিলাম এটা আসল দাঁড়ি !’
রীতিমত লাল হয়ে গেলেন ভদ্রলোক পাশের সীটে, ‘এটা আমার জেনুইন দাঁড়ি, স্যার ! বড় দাঁড়ি রাখা ক্রাইম নাকি ?’

জিভ কাটেন জাহিদ ।
পেছনে সহকর্মী নাহিয়ানের লাশ পড়ে আছে, তা নিয়ে ও একে বিচলিত হতে দেখে নি । নিমেষেই যেন ভুলে গেছে ওরা সহকর্মীকে ! এরা অন্য ধাতুতে গড়া !
প্র্যাক্টিক্যাল জোকস নিয়ে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে ওকে – মনে মনে ভাবেন জাহিদ হাসান ।