এক।
সারাদিন প্রচন্ড গরম। একেবারে
বাজে রকমের ভ্যাপসা গরম। একটা গাছের পাতাও নড়ে না এরকম সময়ে। প্রচন্ড গরমের
বিরুদ্ধে গাছপালাও মনে হয় অহিংস আন্দোলনের উদ্দেশ্যে একেবারে মৌনতা পালন করে।
অবশ্য এই দু'হাজার বারো সালে ঢাকা শহরে গাছ আছেই বা কোথায়। এই জায়গাটায় অবশ্য
এখনও গাছাপালা আছে বেশ কিছু। ঢাকা শহরের প্রচণ্ড ব্যাস্ততার মধ্যেও এই জায়গাটা
একটু অন্যরকম, বিশেষ করে ছুটির দিনে। ইন্দিরা রোড। রাস্তার একপাশে খামারবাড়ি, আরেকপাশে
তেজগাঁও কলেজ। ছুটির দিনে কলেজ বন্ধ থাকলে রাস্তাটা বেশ লাগে। যদিও একটু ভেতরে
ঢুকলেই চাপা গলি আর ভাঙ্গা রাস্তায় জমে থাকা কাঁদাজলের জঞ্জাল, হার্ডওয়ারের
দোকান। তারপরেও এই রাস্তাটা সবকিছু থেকে একটু আলাদা।
রাস্তাটা অনেকটা ক্যাফেটেরিয়ার
মত, লোকমানের কাছে অন্তত তাই মনে হয়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে খ্যাপ
ট্যাপ না পেলে, বা খ্যাপ ট্যাপ না মারতে ইচ্ছা
করলে, সিএনজির মধ্যেই একেবারে আরামে ঘুম দেয় লোকমান। আশেপাশে কিছু
সস্তার খাবারের দোকানও আছে। আঁখের রস ভাঙ্গানোর গাড়ি আছে পাশেই। দুটা সিঙ্গারা আর
একগ্লাস আঁখের রস ঢকঢক করে গিলে ছুটির দিনে প্রায়ই সিএনজির মধ্যে গুটলি পাকিয়ে
ঘুম দেয়। ওইদিন আর খ্যাপ ট্যাপ মারে না। সিএনজি ড্রাইভার হিসাবে ওর অবশ্য উপরি
ইনকাম ভাল। কিছু পার্টির সাথে ওর কারবার আছে। মাঝে মাঝে বেশ ভাল ইনকাম হয়। জুতমত
ক্লায়েন্ট ধরতে পারলে, একদিনেই সপ্তাহের ইনকাম উঠে আসে।
ঐ সময়গুলাতে নিজেকে রাজা রাজা মনে হয় লোকমানের। সিটের নিচে যেদিন ছোটখাট টাকার
বান্ডিল গুঁজে রাখে, সেদিনকার ঘুমে যেন অন্যরকম নেশা।
তবে আশার কথা এরকম ভ্যাপসা গরমই
নাকি ঝুম বৃষ্টির লক্ষণ। অন্তত লোকমানের এতদিনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। আর এবার
বৈশাখের বেশ কয়েকদিন চলে গেল, এখনও বৃষ্টি হয়নি একদিনও, ছিটেফোঁটাও
না। মনে মনে আশা করে আছে, আজকে সারারাত ঝুম বৃষ্টি হবে।
এজন্যে সারাদিন একটা খ্যাপও মারেনি লোকমান। নাহলে রাত জাগতে বেশ কষ্ট হয়।
দুই।
প্রথম খ্যাপটার কথা এখনও মনে পড়ে
লোকামানের। তখন লোকমানের বয়স কম। গ্রাম থেকে সদ্য ঢাকা এসেছে। তখনও ঢাকায় সিএনজি
চলে না, চলে সেই পুরোনো বেবিট্যাক্সি ভটভট শব্দ তুলে। কোনকিছু ঠিক ঠাক না
করেই ঢাকা চলে আসা লোকমানের, বাড়ি থেকে রাগ করে। কী করবে
কিছুই জানেনা তখনও। কিন্তু লোকমান চালু ছেলে, যোগাড়যন্ত্র করে ফেলে, কয়েকদিনের
মধ্যেই বেবিট্যাক্সি চালানো শিখে নেয়, লোক ধরাধরি করে লাইসেন্স আর
দরকারী কাগজ-পত্রও যোগাড় করে ফেলে। মাথায় একটু বুদ্ধি থাকলে ঢাকা শহরে কোনরকমে
করে খাওয়া কঠিন কিছু না।
সেদিন ঝুম বৃষ্টি, সেই
আটানব্বই সালের বন্যার বৃষ্টি। বন্যা তখনও শুরু হয়নি। ঐ বৃষ্টি দিয়েই শুরু।
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সেদিন লোকজন তেমন বেরোয়নি। মেজাজটা একটু চটেই ছিল লোকমানের। আশা
করেছিল, বৃষ্টির সুবাদে প্রথম দিনেই একটা বড়সড় দান মারা যাবে। দান তো
দূরে থাক, উল্টা রাস্তায় পানি জমে মাঝে মাঝেই ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়না। প্রথম
দিনটাই কুফা দিয়ে শুরু। সারাদিন ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বসে থেকে একটা খ্যাপও জুটল না
ভাগ্যে। এরকম সারাদিন বসে থাকতে থাকতে বৃষ্টির মধ্যেই কখন ঘুমিয়ে গেছে ও নিজেও
বোধহয় জানেনা।
ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাৎ করেই। কেউ
ডাকছে, খট খট খট, টক টক। একটানা বৃষ্টির ঝমঝম
শব্দের মধ্যে বেবিট্যাক্সির সামনের কাচে অস্থির টকটক শব্দ। ধরফর করে উঠে বসে
লোকমান। চোখ রগড়ে নেয়। ধাতস্থ হতে সময় লাগে কিছুটা। কত রাত হয়েছে হুট করে
বোঝার উপায় নেই। আকাশে মেঘের কারণে চাঁদ বা নক্ষত্র কিছুরই অস্তিত্ব টের পায় না।
তখনও বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে, শুধু তীব্রতা একটু কমেছে।
রাস্তায় পানি জমা হয়ে বেবীট্যাক্সির মেঝে পর্যন্ট ডুবিয়ে দিয়েছে। জাগা পেয়ে
নিজেই অবাক হয়ে যায়, কতক্ষণ ঘুমালো একটু আন্দাজ করার
চেষ্টা করে।
তিনজন মাঝবয়েসী লোক। ওরাই
ডাকছিল। চেহারা দেখে মনে হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষ।
বেশ তাড়াহুড়া তাদের ডাকার ভঙ্গিতে। চেহারা দেখেই বোঝা যায় বেশ বিপদে পড়েছে, বা
তাড়া আছে। এত রাতে এই বৃষ্টিতে কোন যানবাহনও পাওয়ার কথা না। লোক তিনজনই ভিজে
চুপচুপে। বেশ অনুরোধের সুরেই বলে একজন,
- যাইবা নাকি
- না মামা, যামু
না, রাইত হইছে অনেক।
- আরে না রাইত বেশি হয়
নাই, ঢাকা শহরে এত তাড়াতাড়ি রাইত হয় না। নতুন আসছ ঢাকা শহরে, ভাও
বুঝ নাই এহনও। ঢাকা শহরে ইনকাম হইল রাইতে। মজাও রাইতে।
পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট
বের করে দেয় সামনের লোকটা। পাঁচশ টাকা তখন অনেক টাকা। তখনও ট্যাক্সি ভাড়া এত
সহজে শ'এর উপর ওঠে না। লোকমানের চোখ কিছুটা চকচক করে ওঠে। কিন্তু মন সায়
দেয় না ওর। একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়, ও যে ঢাকা শহরে নতুন এসেছে, একথা
ওই লোক কীভাবে জানল?
হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে থাকে
লোকমানের। তাছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাট তেমন ভাল করে চেনেনা তখনও ও। বলে,
- যামু না মামা, গাড়ি
জমা দিতি হবে, আর তাছাড়া মামা আমি রাস্তাঘাট চিনিনা, ঢাকা শহরে নতুন আইছি
তো।
পাঁচশ টাকার লোভ উপেক্ষা করা সহজ
কথা নয়। কিন্তু ততক্ষণে ভয়টা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ভয় পাওয়ার মত পরিবেশই বটে
সেটা। চারিদিকে থই থই পানি, নিকষ অন্ধকার, একটানা
বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তার বাতিগুলোও বোধহয় বন্ধ, বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসে
ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ হয়ে গেছে বোধহয়। চারিদিকে ঝুমঝুম শব্দ ছাড়া একটা শব্দও নেই।
পকেট থেকে আরেকটা পাঁচশ টাকার নোট
বের করে লোকটা। এতক্ষণ খেয়াল করেনি লোকমান। এবার লোকটার চেহারার দিকে ভালভাবে
তাকায়। ভয় পাওয়া ভাবটা বেশ স্পষ্ট ওর চোখে। মনে মনে ততক্ষণে জানা সব দোয়া-দরূদ
পড়া শুরু হয়ে গেছে। লোকটার চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর ভয়টা আরও বেড়ে যায়। একটা
মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয় লোকটার চোখ জ্বলছে, ঠিক একটা শ্বাপদের মত।
মুখে কথা সরে না আর লোকমানের। একবার ভাবে মনের ভুল। ভাল করে আবার তাকিয়ে দেখে, পেছনের
লোকদুটোর দিকেও। নাহ চোখের ভুল না। জ্বলজ্বলে চারটে চোখ, অন্ধকারে একেবারে চকচক
করছে। মিনমিন করে বলে,
- ইঞ্জিনে পানি ঢুকছে
মনে হয় মামা। ইঞ্জিন স্টার্ট নিব না। আপনেরা একটু হাটেন, অন্যগাড়ি পাইয়া
যাবেন। আর তাছাড়া মামা, তেলও বেশি নাই, এত
রাইতে মাঝ রাস্তায় আটকায়ে যামু।
- ইঞ্জিন স্টার্ট দাও
দেখি। স্টার্ট না নিলে তো আর যামু না। দাও স্টার্ট দাও। আর তেল নিয়া চিন্তা কইরনা, ওইটা
আমরা ব্যবস্থা করুমনে।
বলতে বলতে লোকমানকে ঠেলে সরিয়ে
দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে ওরা তিনজন। মনে মনে আল্লার নাম নিচ্ছে লোকমান, আর
জানা দোয়া-দরুদ পড়ছে। আর আশা করছে ইঞ্জিন স্টার্ট নিবে না। দুপুরে ঘুমানোর আগে
শেষবার যখন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করেছিল তখন স্টার্ট নেয়নি ইঞ্জিন, একটা
জোড়ালো ঘরঘর শব্দ করেছিল শুধু।
দোয়া-দরুদ কাজে দেয় না। পানি
ভর্তি ইঞ্জিন একেবারে সাথে সাথে গর্জন করে স্টার্ট নিয়ে ফেলে। বৃষ্টির একটানা
শব্দের মধ্যে একেবারে বেমানান বেবিট্যাক্সির ভটভট শব্দ, ইঞ্জিনের কম্পন আশেপাশের
স্থির পানিতে একটা তরঙ্গ তৈরি করে, কিন্তু সেই শব্দ বা পানির মৃদু
আন্দোলন লোকমানের ভয়কে নাড়া দিতে পারে না। পেছনে তাকাতেও সাহস করে
না লোকমান। শুধু কল্পনা করে নেয়, শ্বাপদের মত তিনজোড়া চোখ শুধু
জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একেবারে ওর ঘাড়ের কাছেই।
- কোনদিকে যামু?
- সামনে টান, তুমিতো
রাস্তাঘাট চিন না, জায়গার নাম কইলে চিনতে পারবা না।
সামনে যাও, রাস্তা বইলা দিবনে।
লোকমান সামনে আগায়। রাস্তায়
হাঁটুপানি। খুব জোড়ে আগানো যাচ্ছে না। পানি ভেদ করে শ্যালো নৌকার মত ঢেউ তুলে
এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। পেছনের লোকগুলোর ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ কানে আসছে, বোঝার
চেষ্টা করছে, কিন্তু বেবির ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ আর পানি কেটে এগিয়ে যাওয়ার
শব্দের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে ওদের কথার আওয়াজ। শুধু মাঝে মাঝে ওদের তীক্ষ্ণ
হাসির শব্দ সব আওয়াজ ভেদ করে একেবারে লোকমানের বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ও নিজেকেই
স্বান্তনা দিচ্ছে, প্রবোধ দিচ্ছে, যে
ভয়ের কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই।
পেছনে তাঁকিয়ে দেখার সাহস নেই
লোকমানের। সোজা চলে যেতে থাকে। পেছন থেকে ডানে বামে যাওয়ার কথা আসে না। এত রাতে
আর রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় সিগনাল বা থামাথামির বালাই নেই। একঘেয়ে শব্দে পানি
কেটে সামনে এগিয়ে চলা। কতক্ষণ চলেছে সেটা লোকমানের পক্ষে বলাটা বেশ কঠিন। এরকম
মুহূর্তে এক-একটা সেকেন্ডকেও মনে হয় ঘন্টার সমান। এরকম চলতে চলতে বোধহয় একযুগ
পার হয়ে গেছে, অন্তত লোকমানের কাছে সেরকমই মনে
হয়েছে। লোকমানের চিন্তাভাবনা অনেকটাই আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। নাহলে ওর বোঝার কথা ও
যেখানে এসেছে সেখানে ওর আসতে পারার কথা না। কেমন একটা ঘোড়ের ভেতরে চলে এসেছে। ওকে
কেউ থামাতে বলেনি, ওখানে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে
একা একাই, হয়ত তেল শেষ, কিন্তু লোকমান এখন ওসব কথা ভাবছে
না, একটা রাস্তার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, সামনে যাবার জায়গা
নেই আর একদমই।
একেবারে রাস্তার শেষমাথায় এসেই
বন্ধ হল ইঞ্জিনটা? কাকতালীয় ব্যাপার বটে। লোকমানের
পা'দুটো যেন প্রচণ্ড ভারী হয়ে গেছে। সিট থেকে নড়তে পারছে না। চোখ
নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে যেন। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখার কথা যেন মনে নেই লোকমানের। যদি
মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাত, তাহলে দেখতে পেত, ওর
জীবনের সবচেয়ে অবাক করা দৃশ্য, একেবারে খালি একটা ট্যাক্সি টেনে
এনেছে। পেছনের লোক তিনজন একেবারে হাওয়া।
বেশ কিছুক্ষণ এরকম ঝিম ধরে বসে
থাকে ওখানে। এরপর আস্তে করে নেমে পড়ে সিট থেকে। অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে এখন ওর।
প্রচণ্ড ভয়ের অনুভূতিটাও ঘিরে ধরেছে এখন। বুঝতে পারছে, বেশ ভাল রকমের একটা
ঝামেলায়ই ফেঁসে গেছে হয়ত। পেছনের তিনজন প্যাসেঞ্জারকে আশেপাশের কোথাও দেখতে
পাচ্ছে না। চারপাশটা বেশ ভাল করে দেখে নেয় লোকমান। বৃষ্টির জোড় এখানে অনেকটাই কম, যে
জায়গাটায় দাঁড়ানো, পানিও জমে নেই একটুও। আকাশটাও বেশ
পরিষ্কার, মধ্যবয়স্ক চাঁদটাও এখন বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান। ভেজা রাস্তায়
চাঁদের আলো চিকচিক করছে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করে
লোকমান। কিন্তু তেল একেবারে শেষ হয়ে গেছে। আন্দাজও করতে পারছে না, ঠিক
কোথায় এসে আটকে গেছে এই মধ্যরাতে।
সামনে একটা দোতলা বাড়ি। আর
রাস্তার দুইপাশে বেশ উঁচু প্রাচীর। ঢাকায় এরকম উঁচু প্রাচীর আগে দেখেছে কিনা মনে
করতে পারে না। মাঝারি উচ্চতার লোকমান প্রাচীরের ওইপাশে কী আছে ঠিক ঠাহর করতে পারে
না। দেয়ালের গায়ে নোনাধরা, দেয়াল ঘেষে বেশ কয়েকটা গাছ, বেশ
বড়সড়, অন্ধকারে কী গাছ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, সেটা বোঝা অবশ্য এখন
ওর প্রথম কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে না, গাছগুলো যদি অশ্বত্থ বা পাকুরও
হয় তাতেও ওর কিছু করার নেই এখন। বাতাস বেশ ঠান্ডা, বৃষ্টি হালকা হলেও বেশ
কিছুক্ষণ টিপটিপ করে পড়েও গায়ের গেঞ্জি একেবারে ভিজিয়ে দিয়েছে, বেশ
শীত লাগছে, শীত আর ভয় মিলে একটা অন্যরকম শিরশিরে অনুভূতি কাজ করছে। ঢাকা শহরে
এরকম এলাকা আছে কোন ধারনা ছিল না, আশে পাশে কোন লোকজন তো দূরের কথা, দোকান
পাট বা ল্যাম্পপোস্ট বা এরকম কোনকিছুই চোখে পড়ে না। একেবারে জনশূণ্য এলাকাও তাহলে
ঢাকা শহরে আছে!
সময়টা জানা দরকার। শেষ পর্যন্ত
রাস্তা বন্ধ করা বাড়িটাতেই ঢুকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়িটার সামনে লোহার গেট
বন্ধ করা। গেটের বাম দিকে একটা ছোট্ট পকেট গেট, ওটা হয়ত খোলা থাকতে
পারে, ভেবে সামনের দিকে আগায়, আস্তে করে ছোট গেটটাতে ধাক্কা
মারে, মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে গেটটা খুলে যায়।
কোন দাড়োয়ান বা কাউকে চোখে পড়ে
না। গেটের একেবারে গা ঘেষেই শুরু হয়েছে বাড়িটা। কোন সিঁড়িঘর-টর নেই। একেবারে
বেশ বড় একটা কাঠের দরজা। বেশ পুরোনো বোঝাই যায়। চাঁদের আলোয় বেশ আধিভৌতিক মনে
হয় বাড়িটাকে। নিচ থেকে ওপর তলার বেশ কয়েকটা জানালা চোখে পড়ে। বেশ বড়সড়
বাড়িটা, কম করে হলেও সাত-আটটা রুম থাকবে বাড়ির এপাশেই, কিন্তু
কোন ঘরেই কোন রকম আলো জ্বলছে না। বাইরে থেকে দেখে একেবারে পরিত্যক্ত বাড়ি বলে মনে
হয়। লোকজন থাকলে কোন না কোন ঘরে তো আলো জ্বলবে!
কিন্তু কাছাকাছি আর কোন বাড়িঘর
নেই। সারারাত এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব না। তাছাড়া
বাড়িতে কাউকে পাওয়া গেলে, একটু কথা বার্তা বললেও ভয় কাটবে।
দরজার বাইরেও যদি রাতটা কাটানো যায় সেটাও খুব একটা খারাপ হবে না হয়ত।
দরজায় মৃদু নক করে প্রথমে। কোন
আওয়াজ আসে না ভেতর থেকে। এতরাতে আসার কথাও না অবশ্য, বাসায় কেউ থাকলেও
ঘুমিয়ে যাবার কথা। আর দুই-একবার নক করে দরজা আস্তে করে ঠেলা দেয়, একটু
পরখ করে দেখার জন্য। ওকে অবাক করে দিয়ে দরজা ভেতরের দিকে একটু সরে যায়। বেশ ভারী
দরজা, ভয়ে ভয়ে আরেকটু জোড়ে ঠেলা দিয়ে বেশ খানিকটা ফাক করে ফেলে, মাথা
ঢুকিয়ে একটু উঁকি দেখে ভেতরটা। কাউকে চোখে পড়ছে না এখনও। মনে মনে নিজেকে সাহস
দেয়, কেউ না থাকলে নাই, রাতটা ঘরের এক কোনায় বসে পার করে
দিতে পারবে, সকালের আলো ফুটলে ঠিকই বোঝা যাবে, লোকজন পাওয়া যাবে, তখন
ঠিক ফিরে যাওয়া যাবে।
বেশ বড়সড় একটা রুমে এসে ঢুকেছে
লোকমান। হাতের বামদিকে তিনটা জানালা, হাট করে খোলা। ঘরে কোন বাতি বা
সুইচবোর্ড চোখে পড়ছে না। অবশ্য জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় অত স্পষ্ট করে কিছু
বোঝাও যায় না। তবে বাড়ি যে অনেক পুরোনো এটুকু বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়, দেয়ালের
জায়গায় পলেস্টার খসে পড়েছে, ছাদের দিকে তাকালে চোখে পড়ে
পুরনো আমলের সেই কাঠের তৈরি বিম। সেই তুলনায় ঘরের মেঝে বেশ মসৃন, পাথরের
তৈরি বোধহয়, দেয়াল আর ছাদ বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মেঝে এখনো বিগতযৌবনা নয়।
ঘরে কোন আসবাব চোখে পড়ে না। একবার ভাবে এখানেই রাতটা কাটিয়ে দেবে কিনা। কিন্তু
ভয়ের সাথে সাথে একটা অদ্ভূত কৌতূহলও ভর করে।
ঘরে অন্যপ্রান্তে তিনটা দরজা, পেছনের
ঘরে ঢোকার জন্য হবে। আর হাতের ডান দিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে, দোতলার
দিকে। পুরনো আমলের লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি। কী ভেবে দোতলায় যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিঁড়ি বেয়ে ভয়ে ভয়ে দোতলার
দিকে উঠতে থাকে। উপরে উঠতে উঠতে একটা তীব্র পঁচা গন্ধ এসে নাকে লাগে। কোন জীবজন্তু
মরে পচে গেলে এরকম গন্ধ বের হয়। পুরনো বাড়ি, হয়ত ইঁদুর বা এরকম
কিছু পচে গন্ধ বেরিয়েছে হয়ত, ভাবতে ভাবতে ওপরে উঠতে থাকে।
বেশ প্যাঁচালো সিঁড়ি, আর
পুরোনো দিনের বাড়ি, দোতলার ছাদ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ
খানিকটা উঁচুতে। অন্ধকারে ঠিকমত দেখাও যাচ্ছে না, ওপরে উঠতে বেশ সময়
লেগে যায়। আর এরকম গা ছমছমে পরিবেশে এক-একটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে এক এক যুগের সমান।
দোতলায় উঠতেই একটা ঠান্ডা জঘন্য পঁচা গন্ধ নাকে এসে লাগে। এরকম জঘন্য গন্ধ কল্পনা
করাও অসম্ভব।
কিচ্ছু চোখে পড়ে না। একেবারে
ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালা থাকলেও সবগুলো বোধহয় বন্ধ করা। শুধু জঘন্য গন্ধটা
নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিতে চায়। চাইলে পেছন ফিরে চলে যেতে পারে, কিন্তু
কিছু একটা যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছে।
ধীরে ধীরে অন্ধকার চোখে সয়ে আসে।
রেটিনার কম আলোতে সংবেদনশীল কোষগুলো কাজ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে
স্পষ্ট হয়ে আসে ঘরের ভেতরটা। স্পষ্ট না হলেই বোধহয় ভাল হত, কারণ
যে দৃশ্য লোকমান দেখল, সেটা কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে
সহ্য করা সম্ভব নয়।
প্রথমে চোখে পড়ে শত শত জ্বলজ্বলে
চোখ, অন্ধকারের মধ্যে শ্বাপদের চোখের মত জ্বলে আছে। ওর দিকে কেউ ঘুরেও
তাকাচ্ছে না। পুরো দোতলাটাই একটা কষাইখানার মত। কষাইখানায় যেভাবে উপর থেকে
গরু-ছাগলের কাটা পা ঝুলিয়ে রাখা হয়, ওভাবে পুরো দোতলা জুড়ে মানুষের
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঝুলিয়ে রাখা, কোথাও বা ছাদ থেকে ঝুলছে
পূর্নাঙ্গ মানুষ, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা।
পঁচে গলে আশে পাশে পড়ে আছে আরও অনেক লাশ। দুর্গন্ধের কারণটা পরিষ্কার হয়, এর
চেয়ে ভয়াবহ কারণ বোধহয় আর হওয়া সম্ভব নয়।
জ্বলজ্বলে চোখের লোকগুলোর কোনদিকে
খেয়াল নেই, ওরা ওইসব ঝুলন্ত, ফেলে রাখা, পঁচে
যাওয়া লাশগুলো থেকে খাবলে খাবলে বের করে আনছে মাংস, দাঁত দিয়ে কামড়ে
খাচ্ছে। ওদেরকে দেখে এখন আর মানুষ মনে হচ্ছে না। মানুষের মত অবয়বের ভয়ংকর কোন
পশু হয়ে গেছে যেন ওরা।
ছুটে বের হয়ে যেতে চায় ওখান
থেকে। নিজের ভবিষ্যত টের পেয়ে গেছে লোকমান। দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চায় ওখান থেকে।
উল্টা ঘুরে ছুটতে যেয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। মেঝেতে একটা নরম শীতল কোন কিছুর
একেবারে উপরে নিজেকে আবিষ্কার করে। বুঝতে দেরি হয় না, কোন পঁচে যাওয়া লাশের
একেবারে ওপরে এসেই পড়েছে।
ইচ্ছার সবটুকু দিয়ে উঠে দাঁড়াতে
চায় লোকমান। কিন্তু হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে একেবারে। ভয়ডর কেটে যায় হুট করেই।
লাশের ওপর নিজেকে বেশ আরামদায়কভাবে আবিষ্কার করে হঠাৎ। পঁচা গন্ধটাও এখন আর তেমন
পাচ্ছে না, বরং একটু আগের সেই লাশপঁচা গন্ধেই যেন নেশা ধরে যায় ওর। নিজের ওপর
কোন নিয়ন্ত্রন নেই আর, খাবলে খাবলে লাশের মাথা থেকে একটা
চোখ বের করে এনে মুখে পুরে দেয়। কামড়ে খুবলে নিতে থাকে পঁচে যাওয়া লাশটার নাক
কান আর গালের নরম অংশ।
লোকমান টের পায়, কীভাবে
টের পায় ও জানেনা, কিন্তু বুঝতে পারে, ওর
চোখগুলোও জ্বলছে।
তিন।
সকালে যখন ঘুম ভেঙ্গেছে, গত
রাতের কথা বেশ স্পষ্টভাবেই মনে পড়ে লোকমানের। মনে পড়ে ভূড়িভোজ শেষে আবার সেই
তিনজন লোককে নিয়ে কী এক ঘোরের মধ্যে আবার ফিরে এসেছে আবার এই ইন্দিরা রোডে। তখনও
রাত বেশ বাকি। লোকগুলার সাথে আর কোন কথা হয় না লোকমানের। যাওয়ার সময় শুধু
অদ্ভূত একটা হাসি দিয়ে বিদায় নেয় লোকগুলো। যেই হাসির মানে, আবার
দেখা হবে কোন একদিন।
চার।
সেই থেকে বৃষ্টি হলেই ছটফট করতে
থাকে লোকমান। একটা সানগ্লাস চোখে দিয়ে বসে থাকে, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে, তিনজন লোকের আশায়, প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে,
যেই ক্ষুধা মেটাবার সাধ্য ওর নেই। কোথায় যেতে হবে সেটা ও জানে,
কিন্তু ঠিকানা জানে না।
আজকেও অপেক্ষা করছে, বৃষ্টির
জন্যে। ওর মন বলছে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। অস্থির
হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে। লোক তিনটা
কি আসবে?
সোর্স- http://www.sachalayatan.com/shopnobaz/44705