ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটা। শেষের মাথার দিকে ছোট্ট একটা যন্ত্র থেকে নিয়নের মিহি আলোর একটা রেখা বের হচ্ছে। সেটার আলোতেই নীলাভ আভার একটা গা ছমছম করা অশরীরীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে ওদিকটায়। আকারে অতিমাত্রায় ছোট আর ওজনে অনেক হালকা হলেও Profexa-440 নামের এই পিচ্চি যন্ত্রটাই“Medic-333” জাতির ভাগ্য নির্ধারক। গত ২০ বছর ধরে এই গ্যালাক্সির নামকরা যত চিকিৎসক সবাইকেই উত্তীর্ণ হয়ে যেতে হয়েছে এই Profexa-440-র কাছে। অতি উচ্চমাত্রার গতিসম্পন্ন core i-100 ক্যাটাগরির একটা রোবট Profexa-440, আর হার্ডড্রাইভ ৯৫০০ টেরাবাইট। এর চেয়ে বেশি মাত্রার ক্যাপাসিটি সম্পন্ন রোবট আর শুধু একটাই আছে… Tech-X-001 (এইটা প্রকৌশল ডিপার্টমেন্টের রোবট), যেটা Medic-333 জাতির আওতাধীন নয়।এই জাতির প্রতিটা মানুষের কাছে Profexa-440-র কদরটাও তাই যুক্তিযুক্ত। আর কয়েকজনের পর-ই নিসান-এর ডাক আসবে ভেতর থেকে। আজ এনাটমি প্রথম পত্র পরীক্ষা। নিসান সিনিয়রদের কাছে অনেক শুনেছে এই পরীক্ষার কথা। অনেক কঠিন নাকি 1st Prof-এর এই পরীক্ষাটা। অনেক অনেক বছর আগে (যখন Profexa-440-র আবিষ্কার হয়নি) এই পরীক্ষাটাই নাকি দিতে হত Buul-X নামের একটা রোবটের কাছে। কী যেন যান্ত্রিক গোলযোগের কারনে বাতিল করা হয়েছিল একসময়। আকৃতিতে মোটেও ছোট ছিলো না, বিরক্তিকর হলুদ রং-এর সার্চলাইট বসানো বিশালাকার মাথার উপর, আর তার নিচ থেকে বের হয়ে আসা কিম্ভুতকিমাকার একটা ‘স্পাইরাল প্লাটিনাম ওয়্যার’ লাইব্রেরীর প্রাচীন ডিভিডি আর্কাইভ-এ ঐ রোবট নিয়ে পড়েছে নিসান, ছবিও দেয়া আছে ওখানে।বিদঘূটে আর ভয়ানক বিভৎস চেহারা। পরীক্ষায় প্রশ্নের সামান্য ভুল উত্তর এর জন্য সেই রোবট নাকি বিশাল ভোল্টেজ এর ইলেকট্রিক শক দিয়ে বসত (নিশ্চয়ই প্লাটিনাম ওয়্যারটার কাজ-ই ছিলো ওইটা)!!
নিসান-এর হাসি পায়, কত ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছে তখনকার মেডিকদের দের। অবশ্য তখনকার সময়টাতে প্রযুক্তি এখনকার মত এত উন্নত ছিলো না।এখনকার প্রতিটা মেডিক মেম্বাদের মাথার পেছনে একটি ইউএসবি পোর্ট রয়েছে, সেটা ঐ সময়টায় ছিলো কল্পনাতীত। পরীক্ষা এর পদ্ধতিতেও তাই অনেক পরিবর্তন এসেছে এখন। নিয়নের আলোর ঐ রুমটায় যাও, Profexa-440-র একটা কেবল এসে মাথার পেছনের পোর্ট এ সেট হবে, তারপর হেড রেস্টার-এ একটা স্ক্যানিং ডিভাইস এসে স্ক্যান করে গেলেই শেষ। পুরোটা মাত্র ৩০ সেকেন্ডের ব্যাপার। সবার পরিক্ষা শেষ হবার ১ মিনিটের মধ্যে ফলাফলও দেয়া শেষ হয়ে যায়।
সবই সহজ। সহজ না শুধু পরিক্ষা এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাটাই। জন্মের পর-পর-ই প্রতিটা মেডিক সন্তানের মেমরি স্লটে যে হার্ডডিস্ক সেট করে দেয়া হয়তার ক্যাপাসিটি মাত্র ১০ টেরাবাইট। তার মধ্যে ৯ টেরাবাইট জায়গা থাকে লক করা। মানে এভেইলেবল মেমরি থাকে মাত্র ১ টেরাবাইট। লক করা অংশটুকু আনলক করার প্রসেসটা আরো জঘণ্য। নিয়মিত ক্লাস উপস্থিতি। হ্যা, বিনা প্রয়োজনে ক্লাস মিস করেছ তো, হার্ডডিস্ক আনলক হওয়ার আশা কমাতে থাকো।আর ক্লাসে না গিয়েই বা উপায় কী? ক্লাসরুমের বাইরে আর কোথাও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই সফটওয়্যার রাখার নিয়ম নেই, গভর্ণরের কড়া নিষেধাজ্ঞা। মাথায় না হয় লোড করে নিলাম, নিজের ইচ্ছামত হার্ডডিস্ক ভর্তি করে ডাটা ইনপুট করলাম, কিন্তু সমস্যা হলো, যতই লোড বেশি হবে সেই হার্ডড্রাইভ ক্র্যাশ করার সম্ভাবনা ততই বাড়তে থাকবে। অগত্যা যেটা করতে হয় সেটা হলো- ডিস্ক ডিফ্যাগমেন্টার, ডিস্ক এরর চেকার, অব্যবহৃত ফাইল রিমুভার জাতীয় ইউটিলিটি প্রোগ্রাম প্রতিদিন রান করে নিতে হয়। এইখানেও মহা ভেজাল। এই প্রোগ্রামগুলো রান করানোর আগে হার্ডড্রাইভের ডাটাগুলো একবার হলেও রিডিং পড়ে নিতে হয়, নাহলে অব্যহৃত হিসেবে ডিটেক্ট করে ডাটা রিমুভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
কাল সারারাত নিসান ঘুমায় নি একবারো। ডাটাগুলো কম করে হলেও একটানা ২০ বার পড়ে দেখেছে, মানে ডিস্ক ডিফ্যাগমেন্টার, ডিস্ক এরর চেকার, অব্যবহৃত ফাইল রিমুভার এইগুলো কমপক্ষে ২০ বার রান করানো শেষ। কই ততোটা কঠিন কিছু তো না এনাটমি, তাহলে এত্ত ভয় ক্যানো যে পাই আমরা। আসলে পড়িই না তাই……মনে মনে ভাবে নিসান।
পরীক্ষা হল-এর মেইন গেট-এর সামনে হাজারো দুশ্চিন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। দুশ্চিন্তা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে না। সে নিজেও জানে আশেপাশের কেউইইউটিলিটি প্রোগ্রামগুলো ২০বার অন্তত রান করায় নি। ভয় একটাই একদিনে এই প্রোগ্রাম গুলো এক নাগাড়ে টানা ৫ বারের বেশি রান করানো নিষেধ। সবার কাছেই এই জ্ঞান পেয়ে এসেছে সে ছোট থেকে। সে রান করিয়েছে ২০ বার। আচ্ছা, ৫ বারের বেশি রান করালে কী ক্ষতি? পুরো মেমরি ড্রাইভ ক্র্যাশ হয়ে যাবে না তো? ভয় পায় নিসান। Profexa-440-এর কাছে ধরা পড়ে গেলে শাস্তি দেবে না তো?? জীবনের প্রথম প্রোফেশনাল পরীক্ষায় অকৃতকার্য না হয়ে যাই।
ভাবতে ভাবতে বেল বেজে উঠলো। নিসান-এর টার্ন। ভয় আর শত অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে আস্তে আস্তে নিসান প্রবেশ করতে থাকলো অন্ধকার সেই রুমটায়।নিয়নের নীল আভাটা ওইতো কাঁপছে। সামনের দিকের চেয়ারটায় আধাশোয়া অবস্থায় নিসান অপেক্ষা করতে থাকে। একটা ইউএসবি কেবল মাথার পেছনের পোর্ট-এ এসে ঢুকেছে, বুঝতে পারে নিসান। নিসান-এর চোখ বন্ধ, কপাল বেয়ে ঘাম কানের পাশ দিয়ে পড়ছে। ভয়ে ওর এটা প্রায়ই হয়। হঠাৎ কিসের যেন একটা ইলেকট্রিক স্পার্কিং টাইপ শব্দ শুনে চোখ খোলে নিসান। সামনে তাকিয়ে যেটা দেখল ও তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। একটা স্পাইরাল প্লাটিনাম ওয়্যার-এর মাথায় বিদ্যুতের ঝলকানি ওর দিকে এগিয়ে আসছে। বিরক্তিকর হলুদ রং-এর সার্চলাইট বসানো বিশালাকার মাথার উপর………হ্যা, Buul-X …….. নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে নিসান………নাআআআআআআ……
চিৎকারে পাশের রুম থেকে মা ছুটে এসেছেন। নিসানের গা ঘেমে ভিজে গ্যাছে একেবারে। “কীরে খোকন, কী হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখছিলি কোনো? কিচ্ছু হয়নি। এই তো তুই ঘুমাচ্ছিলি সোনা……। হুম এখন ওঠ…ওঠ। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হয়ে নে? পরীক্ষা ১০ টা থেকে শুরু না? বাবা অফিস যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবে……”
আজ নিসান- এর ‘এনাটমি ভাইবা’